Search

Sunday, September 27, 2020

Fine words butter no parsnips

Imran Rahman


Although it is nearly half century since Bangladesh gained independence, bilateral ties with Pakistan have not improved at all. Rather the relation has gone to the dogs in last one decade. Experts are of strong opinion that return of these two nations to normal relationship is not so easy. Points made in support of their arguments gain ground in consideration of the scar left deep in Bangladeshi people's heart during the War of Liberation in 1971.Besides, reluctance, lack of goodwill and sincerity on the part of Pakistan's subsequent governments to repair the damage done to Bangladesh by its military rule were equally responsible for ballooning this gap. Even none of the Pakistani governments as a part of redemption felt any necessity to seek a formal apology, a long overdue to the common people of Bangladesh.


Recent phone call from Pakistani Prime Minister Imran Khan to his Bangladeshi counterpart Prime Minister Sheikh Hasina may not be warm enough to melt down the ice that froze the bilateral ties for decades. But it is of no less importance in the spectrum of current geopolitical whirlwind. The phone-call from Islamabad to Dhaka during mounting tension between Delhi and Dhaka over China factor has added an insult to injury of India. This was the second time Mr. Khan called Hasina after he came to power in 2018. Questions can appear if China had any instrumental role behind the curtain in connection to this phone diplomacy and if the phone call prompted Indian foreign minister Harsha Bardhan Shringla to a hectic Dhaka visit just the following month that was not fixed earlier. The way the course of regional politics is changing so fast under present global order, the idea that the relations between Pakistan and Bangladesh will not improve in near future may not prove correct.



The diplomatic efforts of the then Bangladesh government that helped return of the body of Bir Shrestha Motiur Rahman in 2006 and hinted a renewed bilateral ties, later fell through during next governments of Bangladesh due to undeserved interventions of Pakistani leadership, especially in war crime trial in Bangladesh. In an attempt to dispute the trial process, Islamabad forgot that interferences like verbal reaction in internal affairs of an independent country with emerging economic prospect are threat to its sovereignty. Islamabad's effort to form global opinion against this trial and thwart it was not taken well by a significant number of common people in Bangladesh.


Experts view, such violation of diplomatic etiquette gave Delhi a diplomatic win and reflected Islamabad's authoritarian attitude towards Bangladesh in 1971once again and this time to a new generation which is very reactive to the state sponsored repression against Kashmiris, Rohingyas and Palestinians and much vocal for stateless floating people irrespective of their race and religion all over the world.


The statement on behalf of Bangladesh government that the scrapping of Article 370 by Indian BJP government that seized the autonomy of Kashmir is India's internal matter could not satisfy this young generation. Far from dancing to the government's tune they protested on Kashmir issue and sent message that along with their `Bengali' identity their `Islamic' identity in Bangladeshi society which was existent even after the formation of new state is equally important.


Asked about the phone conversation and formal apology to Bangladesh, Kiran Siddiqie, a Pakistani writer from Karachi said, "This is very significant in the South Asian political context and moving bilateral ties between Bangladesh and Pakistan forward is a crying need of time and urgent. Imran Khan's phone to Sheikh Hasina is the expression of brotherly sentiment of common Pakistani people towards Bangladesh. But one-sided friendship does not last long. I believe Bangladesh is our brotherly state and the general sentiment of common peace-loving Pakistani people for Bangladesh is as it was before." She further added that it was a historical mistake for Pakistan not to handover the state power to Sheikh Mujibur Rahman even after his overwhelming victory in the 1970 General Election and the Bengalese were deprived of their due rights as the state power was not handed over to him and if someone has to be accountable to Bangladesh for 1971 tragedy it must be the then Pakistani government, not the peace-loving general people of Pakistan.


We can have a better understanding from the reading of Ahmed Tepantor, a Bangladeshi journalist, as he said, "It will not be unwise for Bangladesh to enter into bilateral ties with Pakistan in the context of Chinese-Turkish implications. But Pakistan will have to step forward first with open mind to cure the wound it inflicted on Bangladesh around five decades back. And what India is doing for Bangladesh in the name of friendship is nothing but some false assurances. Advantageous position of Bangladesh in the regional politics needs to be utilized to yield fruit."


Time will better say how positively Mr. Khan will move ahead in dealing with existing bilateral crises with Bangladesh or whether he will at all be able to get out of military influence to do something meaningful. Fine words butter no parsnips.


  • The writer is a poet 
  • Published : The daily observer/ 27 September, 2020


Sunday, September 13, 2020

অপরাধীর রাজনৈতিক প্রশ্রয়

— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ


ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, জালিয়াতি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে কথা বললে সমর্থকরা বলেন এদের তো সরকারই গ্রেপ্তার করছে। যুক্তির বিচারে এটি খুবই হাস্যকর কথা। সরকার ছাড়া অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার আর কেউ থাকে কোন দেশে? অপরাধীদের গ্রেপ্তার তো সরকারই করবে। কিন্তু কথা হলো, আসলেই কি সরকার অপরাধীদের স্বপ্রণোদিত হয়ে গ্রেপ্তার করছে? নাকি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হাতেগোনা কিছু অপরাধীকে ধরতে বাধ্য হচ্ছে?

সর্বশেষ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদা খানম হত্যাচেষ্টার বিষয়টিই দেখা যাক। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে যাকে ধরা হয়েছে সেই জাহাঙ্গীর স্থানীয় যুবলীগের আহ্বায়ক। যুবলীগের নেতা হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করেছে এটা তো নিঃসন্দেহে বিরাট খবর। তাকে নাও তো ধরতে পারত। সুতরাং এর কৃতিত্ব সরকার দাবি করতেই পারে। কিন্তু জাহাঙ্গীরকে আরো আগে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর কি আছে আমাদের কাছে? তিন-চার বছর আগে থেকেই জাহাঙ্গীরের দাপটে খোদ সরকারি দলের নেতারাই অতিষ্ঠ ছিলেন। তার মাদকদ্রব্য সেবন ও মাদক ব্যবসার কথা তো স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের সবাই জানত। স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির ওপর হামলার চেষ্টা করায় এই জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় যুবলীগকে চিঠি দিয়েছিলেন এমপি নিজেই। পৌর মেয়রের ওপর হামলার অভিযোগও আছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। তার নামে চারটি মামলা। এত কিছুর পরেও জাহাঙ্গীর না হয়েছে গ্রেপ্তার, না হয়েছে বহিষ্কার। এখন সেই জাহাঙ্গীর যখন দলবল নিয়ে রাতের বেলা ঘরে ঢুকে উপজেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক অফিসার ও তার বাবাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যার চেষ্টা করে, তখন গ্রেপ্তার করে কৃতিত্ব দাবি করতে চায় সরকার? অথচ এই জাহাঙ্গীরকে আরও আগে সে যে সব অপরাধ করেছে তার জন্য গ্রেপ্তার বা দল থেকে বহিষ্কার করলে হয়তো একজন ইউএনও’র এ মর্মান্তিক পরিণতি হতো না।

কিছুদিন আগে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হলো। গ্রেপ্তারের পর জানা গেল এই চক্রটি অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আর নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে। সেটা নিয়েও কত দাবি! তাদের দলের নেতা। তবুও ছাড় দেওয়া হয়নি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একেই বলে আইনের শাসন। কিন্তু এখানেও সেই একই প্রশ্নটা যদি করি? এদের ধরা হলো কখন? জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল সাহার বাসায় যদি তারা হামলা না করত, তাহলে কি এই নেতাদের পাকড়াও করা হতো? তারা যে এত টাকা পাচার করল, এত ধন-সম্পদের মালিক হলো তা কি কারও নজরেই আসেনি? আওয়ামী লীগের নেতা, স্থানীয় প্রশাসন এমনকি গোয়েন্দা বিভাগ কেউই কি জানত না তাদের এসব কর্মকা-ের কথা?

এই যে চৌকস জালিয়াত রিজেন্ট সাহেদ। প্রায় অর্ধশত মামলা ঘাড়ে নিয়ে তরতর করে কোথায় উঠে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যপদ বাগিয়ে নিয়েছিল। কেউ জানল না এই হীরের টুকরো জালিয়াতকে? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে একাই এ কাজ করল? এত বছর ধরে এভাবে লালন পালন করে আজ যখন করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল তখন গ্রেপ্তার করে বলা হলো, সব কৃতিত্ব সরকারের।

সবার চোখের সামনে এই ঢাকা শহরে ফাইভস্টার হোটেলে রঙমহল বানিয়ে দিনে লাখ লাখ টাকা রুমভাড়া ও বারের বিল দিত যুব মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া। কত রথি-মহারথিদের যাতায়াত ছিল সে রঙমহলে। পাপিয়ার সে রাজত্বে কী কারবার চলে, কারা এসে আতিথেয়তা নিত সেটাও কি আওয়ামী লীগ নেতা, প্রশাসন ও গোয়েন্দাদের নজরে আসেনি কোনো দিন? কক্সবাজারের টেকনাফের ওসি প্রদীপের হাতে যে এতগুলো মানুষ বছরের পর বছর খুন হলো তা কি জানত না আমাদের পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ?

এই আলো ঝলমল ঢাকায় বছরের পর বছর জুড়ে চলল ক্যাসিনোকা-। কেউ জানল না? হঠাৎ করেই আবিষ্কৃত হলো জি কে শামীম, সম্রাট, এনু-রূপন? আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা এনু-রূপনের বাড়িতে ক্যাশ টাকাই পাওয়া গেছে ২৭ কোটি টাকা। আর সোনা ছিল বেশুমার। যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের টাকার খনি কি হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছে? তাদের কেন আগে ধরা হয়নি? আর এত ঢাকঢোল পিটিয়ে তাদের কয়েকজনকে ধরেই অভিযানটি বন্ধ করে দেওয়া হলো কেন? যে কয়জনকে ধরা হয়েছে তারাও আরাম-আয়েশেই আছে হাসপাতালের বেডে।

এই যে ভয়াবহ সব দুর্নীতির খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে, তার কয়টাকে সরকার নিজ দায়িত্বে ও উদ্যোগে ধরেছে? আইসিইউ’র পর্দাকান্ড, বালিশকান্ড, বঁটি-দা কান্ড, গগলসকান্ড, ল্যাকটোমিটারকান্ড, মাস্ক জালিয়াতিকান্ড  হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। নয় কোটি টাকার করোনার সরঞ্জাম কেনার কথা বলে তার থেকে আট কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রে এসেছে। বাঁশের সাঁকো মেরামতের কথা বলে মেরে দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এর কোনোটাই কিন্তু সংবাদমাধমে প্রকাশ হওয়ার আগে সরকার ধরেনি। সংবাদমাধমে প্রকাশ হওয়ার পর ভার্চুয়াল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় সরকার কাউকে কাউকে ধরতে বাধ্য হয়েছে।

সরকারি দল যা-ই বলুক না কেন, এটা সবাই জানেন যে দেশে সংবাদমাধ্যম মোটেও স্বাধীনতা ভোগ করছে না। এর মধ্যেও যারা সরকারের সমালোচনা কিছুটা করছেন, তারা কী ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সেটা করছেন তা তারা আর তাদের কাছের মানুষরা জানেন। ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে পত্রিকায় নিবন্ধ লেখার ‘অপরাধে’ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। করোনার সময়ে কার্টুন আঁকার ‘অপরাধে’ জেলে যেতে হয়েছে কার্টুনিস্ট কিশোরকে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তাহলে এত দুর্নীতির খবর আসছে কী করে? আসলে দুর্নীতির যে খবরটুকু আমরা পাচ্ছি তা একেবারেই নগণ্য। যেখানে বণ্টনে গ-গোল লাগে, তখন বঞ্চিতজন সেই দুর্নীতির খবরটা জানিয়ে দেন। আবার প্রশাসনের কিছু সৎ কর্মকর্তা ভেতরে দুর্নীতি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে পরে সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দেন। এভাবেই খুব সামান্য অংশই সংবাদমাধ্যমে আসে। বেশিরভাগই থেকে যায় আড়ালে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এলেও যে সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাও নয়। সেই দুর্নীতির পরিমাণ কত আর তার ভাগ কতদূর পৌঁছেছে তার ওপরও অনেক সময় নির্ভর করে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিংবা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না।

আর সরকারি দলের প্রভাবশালী কেউ বা অন্যায্য কাজের সহযোগী কোনো সরকারি অফিসার হলে তো কোনো কথাই নেই। তারা থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে গেলেও তাকে রক্ষা করার লোকের অভাব নেই। প্রয়োজনে নির্বিঘ্নে দেশত্যাগের ব্যবস্থাও করে দেওয়ার লোকও আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আফজাল নামে একজন কর্মচারীর দেড় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ধরা পড়ার পর নিরাপদে বিদেশে চলে যেতে পারার কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে।


  • লেখক- চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি - দেশরূপান্তর/ সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০

Tuesday, September 8, 2020

একজন কিংবদন্তী অর্থমন্ত্রী

 এ এম এম নাসির উদ্দিন



আজ বাংলাদেশের কিংবদন্তী সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের এগারোতম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খড়িয়াখাল এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন এ কীর্তিমান পুরুষ । দেশের উন্নয়ন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরতে পরতে মরহুম এম সাইফুর রহমানের স্পর্শ রয়েছে যা অনস্বীকার্য। দেশের প্রায় প্রতিটি খাতের উন্নয়নে রয়েছে তাঁর অবদান। রয়েছে তাঁর হাতের ছোঁয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় দু'মেয়াদে দশ বছর এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও মরহুম বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এর আমলে প্রায় এক বছর তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে ১২ টা জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন মরহুম এম সাইফুর রহমান।


১৯৯২ সালে চরম প্রতিকূলতার মাঝেই তিনি এদেশে প্রথম VAT চালু করেন যা এখন সরকারের আয়ের মূল উৎস। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্য বিধান এবং শৃঙ্খলা আনয়ন এর লক্ষ্যে নানা বিপত্তির মধ্যেই তিনি Public Procurement Rules 2003 (যা পরবর্তীতে আইনে রুপান্তরিত হয়) চালুর ব্যবস্থা নেন। ১৯৮১ সালে বিচারপতি মরহুম আব্দুস সাত্তার এর আমলে ব্যাংকিং খাতে কর্মচারী ইউনিয়নের উশৃঙ্খলতা তিনি কঠোর হস্তে দমন করে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। আমলাতান্ত্রিক ঘোর বিরোধীতার মধ্যেই তিনি ১৯৯২ সালে আয়কর বিভাগে প্রথমবারের মত ব্যাপক সংস্কারের ব্যবস্হা নেন। দেশের সব সেক্টরের খুটিনাটি ছিলো তাঁর নখদর্পণে এবং নিয়মিতই তিনি সব সেক্টরের খোঁজ খবর রাখতেন।


সরকারি চাকরির সুবাদে তাঁকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ ছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের সুযোগ আমি পেয়েছি। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, নিবেদিত প্রাণ, কর্মঠ এ কর্মবীর বিরামহীনভাবে দেশের জন্যেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। দুর্ণীতি ও দুর্ণীতিবাজদের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান। তিনি দেশ বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন,কানাডার বেগমপাড়া, আমেরিকা, লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় বাড়ি করেছেন এমন অভিযোগ তাঁর চরম দুশমনরাও করতে পারবে না। সরকারি কাজ করতে গিয়ে আমি তাঁর ব্যাপক সহযোগিতা ও সমর্থন পেয়েছি। তাঁর কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ এবং ঋণী।


কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় তিনি রাগারাগি করতেন। এটা ছিল তাঁর কাজের স্টাইল। অত্যন্ত ক্ষণস্হায়ী এ আপাত রাগের পিছনে তাঁর যে দরদী মন, কোমল হৃদয় ও পিতৃসুলভ আচরণ লুকিয়ে থাকত তা কাছে থেকে না দেখলে বুঝার উপায় ছিলো না। তিনি যা কিছু বলতেন এবং করতেন তা দেশের স্বার্থেই, নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে তাঁর অনেক সরস মন্তব্য আমি খুবই উপভোগ করতাম।


একবার তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরা ক্রয়ের জন্যে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ পেতে তাঁর সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে বললেন,' তোমারে টেহা দিয়া লাভ কি? তোমার বিটিবি ত আমারে দেহায়না। ফারলামেন্টে আমারে এট্টু হানি দেহাইয়া কেমেরা ফুচুৎ কইরা ফরধান মন্ত্রীর দিকে গুরাইয়া দেয়।'  আমি বললাম, স্যার, বিষয়টা এখন থেকে আমি মনিটর করব। আমি জানতাম, তিনি রসিকতা করে কথাগুলো বলেছেন।


একবার একনেক সভায় বাংলাদেশ রেলওয়ের এক প্রকল্প বিবেচনার সময় তিনি রেলওয়ের মহাপরিচালককে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'তুমি যে কি রেল চালাও,চা মুখে দিলে নাখে ডুখিয়া যায়। এটা কি বন্ধ খরতে ফারবা?' সভায় হাস্যরোল পড়ে যায়।এরকম অনেক স্মৃতি রয়েছে আমার মানষপটে। জ্বালানি সচিব হিসেবে আমি তাঁর ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে জ্বালানি তেল আমদানিতে তাঁর সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এর পক্ষে অব্যাহতভাবে তেল আমদানি ও সরবরাহ সম্ভবপর হত না। একবার তেল আমদানির একটা প্রস্তাব ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বিবেচনাধীন ছিল। দেশে তেলের মজুদ কমে এসেছে, ক্রয় কমিটির সভাও হচ্ছিল না। আমি একদিন সন্ধ্যার পর তাঁর বাসায় গেলাম ক্রয় কমিটির সভা আহ্বানের অনুরোধ জানাতে। আগে থেকেই বেশ কয়েকজন তাঁর সাথে কথা বলছিলেন। আমাকে উপরে ডেকে তাঁর বেডরুমের পাশের ড্রইং রুমে অপেক্ষা করতে বললেন। সবাইকে বিদায় করে আমাকে তাঁর ছোট অফিস কক্ষে ডেকে নানা বিষয় আলাপ করলেন। আমি বললাম, স্যার প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে আছেন। জ্বালানি উপদেষ্টাও দেশের বাইরে। দ্রুত তেল আমদানির অনুমোদন না পেলে দেশে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দেবে। দ্রুত ক্রয় কমিটির সভা আহ্বান করা প্রয়োজন। তিনি তাঁর লুংগি ডান পায়ের হাঁটুর বেশ উপরে উঠিয়ে আমাকে বললেন, দেখ, আমার পায়ের অবস্থা। দেখলাম,পুরো পায়ের চামড়া খোস  পাঁচড়ার মত ক্ষত বিক্ষত। তিনি আরো বললেন, চিকিৎসার সময়ও পাচ্ছিনা। আগামীকাল চিকিৎসার জন্যে সিংগাপুর যাচ্ছি। ফেরার বিষয়টা ডাক্তারের উপর নির্ভর করছে। তেল আমদানির কথা চিন্তা করে আমি ঘাবড়ে গেলাম। তিনি ক্রয় কমিটির সভাপতি , কমিটির সভা অনিশ্চয়তায় পড়ে যাচ্ছে। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি সপ্তাহান্তে ক্রয় কমিটির সভার একটা তারিখ দিলেন এবং বললেন, চেষ্টা করব ফিরে এসে সভায় যোগ দিতে। সভার দিন আমার খুবই খারাপ লেগেছিল যখন তিনি জানালেন ডাক্তারের অমতে এবং চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি ফিরে এসেছেন শুধুমাত্র ক্রয় কমিটির সভায় যোগ দিতে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে তেল কিনে ভর্তুকি মূল্যে বাজারজাত করে বিপিসি যেভাবে লোকসান দিচ্ছিল তা মোকাবিলায় মরহুম এম সাইফুর রহমান সাহেবের সহায়তা আমি কৃতার্থ চিত্তে স্মরণ করছি।


  • লেখক - এ এম এম নাসির উদ্দিন, সাবেক সচিব
  • কার্টসি - মানবজমিন, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

Friday, September 4, 2020

বিএনপি’র জন্মদিন

— আজিজুল বারী হেলাল 


১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিণতিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে  গ্রহণ করে সমগ্র দেশবাসীর সামনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটান। শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদশকে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার এক অভুতপূর্ব রাজনৈতিক স্বপ্নযাত্রা।    

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের  স্বাধীনতার মাত্র  বছর কয়েক অতিক্রান্ত না হতেই  তৎকালীন ক্ষমতাসীন  শাসকগোষ্টীর দুঃশাসন, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি’র মহামারীতে স্বাধীন দেশের মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। পঞ্চান্ন হাজার একশত ছাব্বিশ বর্গমাইল আয়তনের ভূখন্ডে বসবাসরত জনগনের সম্মিলিত জাতিগত পরিচয়ের সংকট ও রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংকট তীব্রভাবে দেখা দেয়। রাষ্ট্র ক্ষমতা একদলীয় শাসন ব্যাবস্থার কবলে পড়ে গণতন্ত্রের অকাল মৃত্যু ঘটে। একটি দল ব্যাতিত সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ফলে দেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও চরমপন্থা’র এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।  দেশের মানুষ পতিত হয় চরম  নিরাপত্তাহীনতা’য়। একদলীয় লুটেরাদের দৌরাত্মে দেশের নবীন অর্থনীতি মূখ থুবড়ে পড়ে। দেশে দেখা দেয় ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়া   দুর্ভিক্ষ। দেশের মানুষ অপুষ্টি অনাহারে ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করেন।

দেশের এই হতাশাজনক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীতে সৃষ্টি হয়  অস্থিরতা এবং অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার পালা বদলের ষড়যন্ত্রে সংগঠিত হয় ক্যূ এবং পাল্টা ক্যূ’ । মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্যূ’দেতা’দের হাতে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী হন। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা ধীরে ধীরে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে থাকে। এমনই এক বিপন্ন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সিপাহি জনতার অভূতপূর্ব সংহতি’তে একটি নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। দেশপ্রেমিক সিপাহীরা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে   বন্দী তাদের প্রিয় সেনাপ্রধান ও ৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযাদ্ধা জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে মুক্ত করেন ।  সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সংগঠিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম অথচ তাৎপর্যপূর্ণ বিপ্লব । ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলেশনে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যেমন বিপ্লবের সন্তান হিসাবে ফ্রেঞ্চ জনগণের কাছে মুক্তিদাতা হিসাবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তেমনি জেনারেল জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর সংগঠিত বিপ্লবের সন্তান হিসাবে  বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নপুরণে রাষ্ট্রক্ষমতায় ও রাজনীতিতে আবির্ভুত হন। 

সুতরাং  ইতিহাসের এক অনিবার্য পরিস্থিতিতে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা’র প্রতিফলন ঘটাতে রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি’র জন্ম এবং বিকাশ ঘটে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীন এই ভূখণ্ডে পাহাড়ে কিংবা সমতলে বসবাসরত সকল নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে, সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে, সকল ভাষা-ভাষী’র মানুষকে একই সূত্রে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তার মহান দর্শন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশী জাতি হিসাবে স্বাধীন এই ভূখন্ডে বসবাসরত মানুষকে একটি একক আত্মপরিচয় প্রদান করে আমাদের সম্মিলিত আত্মপরিচয়ের সংকট ঘোচান এবং ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করেন। রাষ্ট্রগঠনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান  মহান আল্লাহর প্রতি আস্হা ও বিশ্বাস, অর্থনৈতিক সুষম বন্টনে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সংবিধানের চার মূলনীতিতে সংযুক্ত করে বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতির সূচনা করেন। তিনি দেশের জনগণের আশা আকাংখা বাস্তবায়নে  স্বনির্ভর আন্দোলনের ডাক দেন। যে আন্দোলনকে তিনি শান্তিপূর্ণ বিপ্লব হিসাবে অভিহিত করেন। উৎপাদনের রাজনীতি আর জনগণকে আত্বনির্ভরশীল ও আত্মকর্ম সংস্হানে বলিয়ান করতে ১৯ দফা রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করেন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাঠামোর বাতাবরণে  সুনির্দিষ্ট পরিকল্পিত পথে এগিয়ে নিতে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নসারথী ও অর্থনৈতিক স্বপ্নদ্রষ্টা   শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে  ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।  আর বাংলাদেশ প্রবেশ করে বহুদলীয় রাজনীতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালিত জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের নতুন রাজনৈতিক উন্মুক্ত যুগে। 

প্রতিষ্ঠার ৪২ তম বছরের আজকের এই পবিত্র দিনে  বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আদর্শের   জনক এবং মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বপ্নদ্রষ্টা  শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই।

শহীদ জিয়ার শাহাদাৎ বরণের পর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যান হিসাবে দলকে সুসংগঠিত করেন। ৯০’র দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া’র আপোষহীন ভূমিকায় স্বৈরাচারের পতন হয় ।  অবিসংবাদিতভাবে  এদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন  “দেশনেত্রী” হিসেবে  ।   নিপীড়িত নির্যাতিত ও অসহায় মানুষের  শেষ ভরসাস্থল আজীবন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মানুষের অধিকার আন্দোলনে নিরন্তর পথচলা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের  গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে। “দেশনেত্রী” থেকে “মাদার অব ডেমোক্রেসি” হিসেবে এদেশের মানুষের হৃদয়পটে অধিষ্ঠান তারই চুড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। 

৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর  এই দিনে আমাদের নেত্রী, আফ্রো-এশীয় ল্যাটিন আমেরিকার নির্যাতিত কোটি কোটি গণমানুষের  আপোষহীন নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানাই সালাম শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।

২০০৭ সালে অভিশপ্ত ১/১১’এ সংগঠিত রাজনৈতিক ক্যূ’র ফলে বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি ক্ষমতাচ্যুত হয় ।  বিএনপি’র ভবিষ্যত কান্ডারি, আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে তরুণ প্রজন্মের গর্বিত পথনির্দেশক  জননেতা তারেক রহমানকে বাধ্য করা হয়  বিদেশ-বিভূইয়ে  নির্বাসন যাপনে । যদিও নির্বাসিত জীবনের শুরু থেকে  আজ পর্যন্ত চলমান সকল  অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিষ্ট বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে  তিনি এদেশের জনগণকে নিয়ত অনুপ্ররণা যোগাচ্ছেন। নব্য স্বৈরাচার ও বর্তমান একনায়ক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মিকভাবে লড়াই করে চলেছেন এদেশের লাখ লাখ জাতীয়তাবাদী আদর্শের সৈনিকের সাথে। 

জননেতা তারেক রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সূর্য সৈনিক হিসাবে তেমনি আমাদের দেশের অপশক্তি’র বিরুদ্ধে লড়ছেন।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির  ৪২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’তে তরুণ প্রজন্মের অহংকার,  বিএনপি’র আগামী নেতৃত্ব, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুযোগ্য উত্তরসুরী বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান কান্ডারি এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ    জননেতা তারেক রহমানকে সালাম শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।

স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সকল নারী ও পুরুষের আশা ও প্রত্যাশার একমাত্র বাতিঘর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’র এই দিনে আমাদের অঙ্গিকার, শহীদ জিয়া’র আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রুঁখবো সকল স্বৈরাচার।


শহীদ জিয়া অমর হোক!

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ!

জননেতা তারেক রহমান জিন্দাবাদ!!

বিএনপি জিন্দাবাদ।।

বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।।


রাজনীতিতে বিএনপি কেন এখনও অবিসংবাদিত?

— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

১ লা সেপ্টেম্বর ৪২তম জন্মদিন পালন করলো বিএনপি। ব্যক্তির ক্ষেত্রে রেওয়াজ হল জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো হয়। প্রতিষ্ঠান হলে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলা হয় এবং তার অতীতের সাফল্যকে স্মরণ করে কী করে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করা যায় সে বিষয়ে ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশনা দেয়া হয়। বিএনপি’র জন্মদিনে শুধু তাকে নিয়ে ভালো ভালো কথা হতে হবে এমন কথা নেই; তার ব্যর্থতা, তার সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। একটি গণতান্ত্রিক দল হিসাবে এসব সমালোচনা গ্রহণ করার মানসিকতা বিএনপি রাখে।

বিএনপি'র জন্মদিনে দেশের প্রায় সব পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয় লিখা হয়েছে। কোনো রচনার লিখিত শব্দের বাইরেও রিড বিটুইন দ্য লাইনস বলে একটা বিষয় আছে যা দ্বারা একজন পাঠক লেখকের দেয়া তথ্যের বাইরেও আরও কিছু বিষয় বুঝতে পারেন। পাঠক বুঝতে পারেন ওই রচনার পেছনে লেখকের উদ্দেশ্য এবং এর মূল সুর। এটাই  লিখার ‘প্রেমিস’ যা একজন লেখক সচেতন বা অবচেতনভাবে প্রকাশ করেই ফেলেন; কারণ এটার ওপর ভিত্তি করেই তিনি লিখে থাকেন। গত কয়েক বছরে অদ্ভুতভাবে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আসলেই এক শ্রেনীর বুদ্ধিজীবির লেখার ‘প্রেমিস’ আমাদের দেখিয়ে দেয় যৌক্তিক-অযৌক্তিক সমালোচনার নামে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাদের লেখা বা বলার মধ্য দিয়ে বিএনপিকে খাটো, অযোগ্য প্রমাণ করে হতোদ্যম করে ফেলতে। 
 
অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় বহু বুদ্ধিজীবি শীতনিদ্রায় চলে যান। তখন আর ২৯ ডিসেম্বর রাতের ভোট, নজিরবিহীন দুর্নীতি, সাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়া, বিচার ব্যবস্থার বেহাল দশা, টুঁটিচাপা গণমাধ্যম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-গুম সহ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে টু শব্দটিও তারা করে না। অথচ গত ১৩ বছর ধরে ভোটে বা বিনা ভোটে নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় দলটি।

অবশ্য একটি দলের সমালোচনা না করলে অন্য কোনো দলের সমালোচনা করা যাবে না বিষয়টি তেমন নয়। তবে পাঠক সব সময়ই আশা করেন সমালোচনা, সেটা যারই হোক না কেন, তা যেন বাস্তবতার নিরিখে যৌক্তিকভাবে করা হয়। না হলে লেখা তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষোভ উদগীরনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘বিএনপি কি রাজনীতি করছে?’ শিরোনামের কলামে লেখক জনাব মারুফ মল্লিক এর একটা চমৎকার উদাহরণ হতে পারেন।

কলামটির প্রথম অনুচ্ছেদটি এমন – “প্রতিষ্ঠার ৪২ বছরের মাথায় কেমন আছে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি? সার্বিক বিষয়াদি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দিশাহীন, এলোমেলো সময় পার করছে দলটি। অগোছালো রাজনীতির ভারে ডুবে গেছে বিএনপি। কখন কী করবে, দলটির কে কী বলবে, বোঝা মুশকিল। বুদ্ধিদীপ্ত, গঠনমূলক রাজনীতি থেকে বিএনপির অবস্থান যোজন যোজন দূরে”।

অথচ বাংলাদেশে এখন মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে এদেশে ‘রাজনীতি’ আদৌ আছে কি নেই? এরকম একটি টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলই দিশাহীন, এলোমেলো, অগোছালো সময় পার করবে, সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে সেই রাজনৈতিক দলটি যদি হয় সরকারের অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার পথের প্রধান বাধা, এবং গত এক যুগ ধরে দলটিকে সম্পুর্ণভাবে নিঃশেষ করে রাজনীতির মাঠ থেকে হটিয়ে দেবার চেষ্টা হয় তাহলে দলটির কেবলমাত্র টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে আলাদা করা কিংবা বিএনপি’র কাছ থেকে ‘পিকচার পারফেক্ট’ রাজনীতি আশা করা ইউটোপিয়ান চিন্তা ছাড়া  আর কিছুই নয়।

দেশের রাজনীতি হীনতার এই কালে ক্ষমতাসীন দলটিরও রাজনীতিও যে খুব দেখা যায় তেমনটি নয়। কিভাবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে জায়গা করে নেয়া যায় আর সেটা ব্যবহার করে কিভাবে লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনা যায় এর বাইরে এই দলটির কর্মী দের আর কোন কাজ আছে বলে তো দেখি না। ক্ষমতায় আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে তাদের এলোমেলো অগোছালো মনে হয় না, কিন্তু ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার সাথে সাথে দলটির কাঠামো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে এই আশঙ্কা দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারাই করেন। 

লেখক অবশ্য তার লিখায় স্বীকার করেছেন শুরুতে বিএনপি’র রাজনীতি ছিল ‘ক্ষিপ্র, দ্রুতগামী, চমকে ভরপুর’, কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে গেছেন সেই সময় এবং অব্যবহিত আগের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। তিনি বলেছেন যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দীর্ঘ সময় লাগে দলটির, দোনোমনো ভাব স্পষ্ট। অহেতুক পরিস্থিতিকে জটিল করে ফেলে। যে দলের চেয়ারপার্সন ব্যক্তিগতভাবে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে ৭৪ বছর বয়সে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামালায় জেলে, দ্বিতীয় প্রধান দেশে ফিরতে পারছেন না, সেখানে ক্ষিপ্র গতিতে দল সিদ্ধান্ত নেবে সেটা খুব বাস্তবসন্মত নয়।  

লেখক বিএনপি’র সংসদ সদস্যদের সংসদে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তিনি এড়িয়ে গেছেন এই সত্য যে কেবলমাত্র বিএনপি সংসদে যাবার কারণেই বিএনপি’র নারী সাংসদ সংসদে দাঁড়িয়ে সংসদের বৈধতা নিয়ে তীব্র ভাষায় প্রশ্ন তুলেছেন, সকল সাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ক্রিয় করে সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছেন।

লেখক বলেছেন বিএনপি’র এক সাংসদ মাদকব্যবসায়ী এবং সন্ত্রাসীদের ক্রসফায়ারে দেয়ার দাবি তুলেছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লেখক বলেন নাই বিএনপি’র এক সাংসদ সংসদে দাঁড়িয়ে সাংসদদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্ররোচনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন যেটা সর্বাধিক পঠিত জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো রিপোর্ট করেছিল ‘বিচার বহির্ভূত হত্যা সম্ভবত বৈধ হতে যাচ্ছে’ শিরোনামে। শুধু তাই নয় বিএনপি সাংসদরা দুর্নীতি, বাজেট, পররাষ্ট্রনীতি, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন সব কিছু নিয়েই কথা বলেছেন। একেবারেই নগণ্য সংখ্যক সদস্য নিয়েও সংসদের 'ডি ফ্যাক্টো' বিরোধী দল যে বিএনপি সেটা সংসদ চলাকালীন সময়ের মিডিয়া একটু খেয়াল  করলেই লেখক দেখতে পেতেন।  

এর চেয়ে বেশি আর কেমন ধরণের ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখার প্রত্যাশা করেছিলেন লেখক? তিনি কি চেয়েছিলেন, বিএনপি কোনো গণবিরোধী আইন প্রণয়ন রোধ করতে পারবে? বাজেটে কোনো অন্যায় বরাদ্দ বন্ধ করতে কিংবা কল্যাণ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে সরকারকে বাধ্য করতে পারবে? কিংবা পারবে বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন (অনুচ্ছেদ ১১৫-১১৬) নিশ্চিত করতে? লেখকের তো জানা থাকার কথা সংবিধানে এখনও ৭০ বলে একটা অনুচ্ছেদ আছে যার কারণে ৭ তো দূরেই থাকুক এমনকি ১৪৯ জন সংসদ সদস্য নিয়েও কোনো দলের পক্ষে সংসদে কোনো আইন পাশ রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের সংসদ তো জন্ম থেকেই অন্তর্নিহিতিভাবে এই দুর্বলতার শিকার।

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে ৭০ অনুচ্ছেদ বর্তমান অবস্থায় রেখে বিরোধী দলের সংসদে যাবার দরকার কী? সংসদের বিতর্ক জনগণের সামনে অন্তত সরকারের ভুল এবং দুর্বলতা প্রকাশ করে। এটা জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অনেক সময়েই সেই চাপে সরকারকে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। তবে স্বপ্ন দেখি কোনদিন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিমার্জিত হবে, যা সাংসদদের শৃঙ্খলমুক্ত করে সংসদকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চর্চার স্থানে পরিণত করবে।

লেখক বলেছেন বিএনপি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে থাকছে না। শুধু আজ না, ২০১৪ সালের পর থেকে এই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোন আন্দোলন সংগ্রামের কথা বাদই দেই, রাজপথে আন্দোলনের ক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠনগুলোর কী অবস্থা সেটা কি লেখক জানেন না? বাংলাদেশে আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটা বোঝার জন্য খুব সাম্প্রতিক একটা ঘটনার দিকে তাকানো যাক।

অতি আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে যাওয়া সিফাত এর বাড়ি বরগুনার বামনায় তার মুক্তির পক্ষে একটি মানববন্ধন আয়োজিত হয়েছিল। সেই মানববন্ধনে বামনা থানার ওসি তার এক অধীনস্থ অফিসারকে চড় দিয়ে ভীষণ সমালোচিত হন এবং শেষে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ওই চড়ের ঘটনার পরপরই মানববন্ধনে আসা বহু মানুষকে‌ বেধড়ক পিটিয়ে রক্তাক্ত করে মানববন্ধনটি ছত্রভঙ্গ করার কারণ হিসেবে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন নীচের কথাগুলো, যা বিবিসি বাংলা প্রকাশ করে - 

"আমাদের কারও অনুমতি না নিয়ে তারা হুট করে মানববন্ধন করেছে, আমাদের কাছে কোনো ইনফরমেশন দেয়নি। আমাদের কাউকে এ ব্যাপারে আগে জানায়নি। এটি সরকারের পক্ষে নাকি বিপক্ষে, সেটিও তো আমাদের বোঝার ব্যাপার আছে। কিছু কুচক্রী মহল আছে, যারা বর্তমান সরকারের বিপক্ষে কাজ করছে। তারা কি চোর, ডাকাত, নাকি ছিনতাইকারী, সেটি তো আমরা জানি না"।

এটা শুধুমাত্র একজন ওসি না, এই দেশের প্রায় সব জায়গায় অবস্থা কমবেশি একই। সম্প্রতি আলোচিত হওয়া আরেকজন ওসি, সিনহা রাশেদের ঘটনায় পদচ্যুত হওয়া টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপের গত বছরের বক্তব্যের ভিডিও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি প্রকাশ্যে অবলীলায় বিনা বিচারে মানুষ হত্যার কথা বলছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ৬ টি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পান।   

বিগত বছরগুলোতে কয়েকটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন যেমন কোটা সংস্কার এবং বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ‌ শিশুদের ওপরে সরকারের গুন্ডাবাহিনী হেলমেট পরে কী বীভৎস তাণ্ডব চালিয়ে আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করেছিল সেগুলো আমাদের স্মৃতিতে অন্তত মিলিয়ে যায়নি। তারও আগে রামপাল বিরোধী আন্দোলনে খুব অল্প কিছু মানুষের রাজপথে থাকাও এই সরকার মেনে নিতে পারেনি - পিটিয়ে এবং টিয়ার গ্যাসে আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। 

আলোচ্য কলামটির লেখক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপি'র ব্যর্থতা দেখানোর জন্য হালে ঘটতে থাকা আরেক আন্দোলনকে সামনে এনে বলেন, 'বেলারুশে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে লাখো মানুষ পথে নেমেছে'। তিনি কি আদৌ কোনো খোঁজখবর নিয়েছেন 'ইউরোপ'স লাস্ট ডিক্টেটর' বলে পরিচিত লুকাশেঙ্কোর মতো একজন সর্বস্বীকৃত একনায়ক, যিনি তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ ২০০৬ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার মুখে আছেন, তিনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে আদৌ কতটা বাধা দিচ্ছেন? এই আন্দোলনের মধ্যেই তিনি শ্রমিক অসন্তোষ কবলিত বিভিন্ন কারখানা সফরে গেছেন এবং সেখানে তাকে প্রকাশ্যে সরাসরি দুয়ো এবং গালি দেয়া হয়েছে, কিন্তু কারো বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে এই লোককে আমার কাছে মহান গণতন্ত্রী মনে হয়। লাখো মানুষের এই সরকার পতনের আন্দোলনে কিছু দিন আগে মাত্র দ্বিতীয় মানুষটি মারা যায়। এবার লেখক নিরাপদ সড়কের মত আন্দোলন, যেটা আদৌ সরকার পতনের জন্য ছিল না তার কিছু ভিডিও, ছবি এবং সংবাদ দেখে নিন। আশা করি বুঝে যাবেন কেন বাংলাদেশ বেলারুশ হয়ে উঠেনি এখনও। 

সনাতন মাঠ এবং রাজপথের যখন এই অবস্থা তখন রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা রাজনীতির নতুন মাঠ ডিজিটাল মাঠে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেখানেও আছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বীভৎস নিপীড়ন। এই করোনাকালীন সময়েও শুধুমাত্র সরকারের সমালোচনা করার কারণে নির্দলীয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এমনকি কার্টুনিস্টকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের যত মামলা আমিসহ বিএনপি নেতাকর্মীর উপরে ঝুলে আছে সেই সংখ্যা অকল্পনীয়। 

বিএনপি'র সর্বশেষ সরকারের সময়েও যে প্রথম আলো বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বড় সব নেতা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ করত, সেই প্রথম আলো আজ কার্টুনশুণ্য। জনাব মল্লিক খেয়াল করেছেন তো এটা?

কোন ব্যক্তি বা দলের আচরণ অথবা অবস্থাকে কেউ যদি নৈর্ব্যক্তিকভাবে মূল্যায়ন করতে চায় তাহলে কন্টেক্সট বিবেচনা না নেয়াটা হয় অজ্ঞানতা নয়তো অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কোন প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে রাজনীতি করতে হচ্ছে সেটা এই দেশের মানুষ জানে। সেটা যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে যথেষ্ট ভাল করছে। এর মানে এই না, দলটির কোন উন্নতির জায়গা নেই। এক দশকের বেশি সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মিথ্যা-মামলার মতো নানাবিধ নিপীড়ণের মুখে থাকার পরও লেখক যখন বলেন, 'বিএনপি একটি বড় দল। জনসমর্থন আছে, ভোটারও আছে', তখন তিনি তার অজান্তেই বিএনপিকে একটি বড় সার্টিফিকেট দিয়ে দেন।

এই দেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দল বিএনপি। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার এবং প্রয়োজনে সেটা গ্রহণ করার মানসিকতা রাখে দলটি। তাই দলটির আরো শক্তিশালী দল হয়ে গড়ে ওঠার জন্য যে কোনো রকম পরামর্শকে দলটি স্বাগত জানায়। তবে শুরুর দিকে যেমন বলেছিলাম ইদানিংকার অনেক লেখার 'প্রেমিস' আমাদের বলে সমালোচনার ছলে বিএনপিকে হতোদ্যম এবং ধ্বংস করার একটা চেষ্টা আছে। বিএনপি দূর্বলতর হতে থাকলে বর্তমান বিশ্বের আইডেন্টিটি পলিটিক্সের চরম ডামাডোলে দেশে কোন রাজনীতির উত্থান হতে পারে এবং তাতে দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে যেতে পারে সেটা বোঝার মত বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞা লেখকদের আছে বলে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাস থেকেই আশা করি ভবিষ্যতে তাদের সমালোচনার উদ্দেশ্য থাকবে বিএনপিকে আরও শক্তিশালী দল হয়ে উঠতে সাহায্য করা, যাতে দলটি বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠতে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।

গুমবিরোধী সনদে কেন সই করেনি বাংলাদেশ

— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ










ঠিক এক বছর দুই মাস আগে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের আলোড়ন তোলা কথাগুলো কি মনে পড়ে! একটু মনে করিয়ে দিই। তার ভাগ্নে গুম হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজির কাছে আবেদন করেও কোনো কূল কিনারা না পেয়ে তিনি আসেন প্রেস কনফারেন্স ও ফেইসবুক লাইভে। তখন তার যে কথাটি সবার মনে দাগ কেটেছিল তা হলো, ‘আজ হয়তো আমার ভাগ্নের ক্ষেত্রে হয়েছে, কাল হয়তো আপনার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এটা আরেকদিন আপনার সন্তান হতে পারে। কার কী পরিচয় সেটা মুখ্য বিষয় নয়, আমার কী পরিচিতি আছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। আইনের শাসন রাখতে হবে এবং ন্যায়বিচার এবং সুবিচারের রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের এরকম একটি পরিণতির সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়। আমি আশা করব, আইনবহির্ভূত এবং ক্ষমতার অপব্যবহার যদি কেউ করে থাকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’ সোহেল তাজের ভাগ্নের বিষয়ে হয়তো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সোহেল তাজ ফিরে পেয়েছিলেন তার ভাগ্নেকে। তারপর আরও কত মামার কত ভাগ্নে নিখোঁজ হয়ে গেল, কত মায়ের বুক খালি হলো, কত সন্তান হলো পিতৃহারা আর কত স্ত্রী হলেন স্বামীহারা তার খোঁজ হয়তো রাখেননি এই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

কিন্তু গুম থেমে নেই। ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবসকে সামনে রেখে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের গুম বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ২৮ আগস্ট ২০২০। এতে যেমন বাংলাদেশে দুটি সংগঠন ‘অধিকার’ ও ‘মায়ের ডাক’ আছে। তেমনি আছে অ্যাডভোকেট ফর হিউম্যান রাইটস, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসএপেয়ারেন্সেস (এএফএডি), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআর ডব্লিউ), রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড আরগানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার-এর মতো সংগঠনও। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩১ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তত ৫৭২ জন মানুষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গুম করেছে। এরমধ্যে কিছু সংখ্যককে ছেড়ে দিয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কিছু মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর বড় একটা অংশ এখনো নিখোঁজ! যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে এই সময়ে গুমের শিকার মানুষের সংখ্যা ৬০৩ জন। যৌথ বিবৃতিতে গুরুতর যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, গুমের বেশিরভাগ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচনকে ঘিরে। সবচেয়ে বেশি গুম করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। আর ২০২৮ সালের নির্বাচনের সময় গুম করা হয়েছে অন্তত ৯৮ জনকে। আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা হলো, দেশের যে সব এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো ছিল, সেখানে গুমের সংখ্যাও বেশি। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক।

বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীরের মতো আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গুম হয়েছেন। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে এ সরকারের সময়ে বাংলাদেশে গুমের শিকার ছয়শ জনের বেশি হলেও বিএনপির মতে এ সংখ্যা সহস্রাধিক। গুমের শিকার ব্যক্তিদের কারও লাশ পাওয়া গেছে। আর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কিছু মানুষকে। এখনো নিখোঁজ কয়েকশ মানুষ! সবগুলো গুমের ঘটনায় অভিযোগের তীর নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকেই। কিন্তু সরকার সব সময়ই অস্বীকার করে আসছে এ অভিযোগ। এমনকি এই জঘন্যতম অপরাধ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কখনো কখনো নির্মম রসিকতাও করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা নাকি পাওনাদারের ভয়ে বা প্রেমের কারণে আত্মগোপন করে আছেন। গুমের কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে মানবাধিকার সংগঠন ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ ভিত্তিহীন কিনা।

অতিসাম্প্রতিক ঘটনা। ফটোসাংবাদিক ও পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল ১০ মার্চ ২০২০ বাসা থেকে বের হয়ে আর  ফেরেননি। দুই মাস পরে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। নিজ দেশে অনুপ্রবেশ করার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার দেখায় বেনাপোল থানা পুলিশ। তিনি এখনো জেলে। বাংলাদেশের আলোচিত রাজনীতিবিদ বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদকেও ভারতের শিলংয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করেছিল সে দেশের পুলিশ। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০১৫ সালে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে অন্তরীণ। সে সময় দলের পক্ষ থেকে যিনি প্রেস ব্রিফিং করেন, তাকেই গ্রেপ্তার করা হয়। তাই দলের মুখপাত্র হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অজ্ঞাত স্থানে থেকে প্রতিদিন দলের কর্মসূচি ও নেতাকর্মীদের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা সংবাদমাধ্যমের কাছে পাঠাতেন তিনি। সে সময় হঠাৎ নিখোঁজ হন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। পরিবার, দল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তার দুই মাস পরে তাকে অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখে গ্রেপ্তার করে শিলং পুলিশ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মুবাশ্বার হাসান সিজারকে নিখোঁজের ৪৪ দিন পর রাতে ছেড়ে দেওয়া হয় বিমানবন্দর এলাকায়। নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু গুম দিয়েই। তাদের লাশ পাওয়া না গেলে সে গুমের সঙ্গে যে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য ও একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাই জড়িত তা জানাই যেত না।

পরিবেশবাদী আইনজীবী সমিতি ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পরে স্বামী এবি সিদ্দিককে ফেরত পেয়ে বলেছিলেন, ‘টাকার জন্য এই অপহরণ করা হয়েছে বলে আমি প্রাথমিকভাবে মনে করছি না। প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের চাপ তো ছিলই। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্দেশনা দিয়ে পুরো বিষয়টি তদারকি করছিলেন।’ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেই। কিন্তু যথারীতি তা অস্বীকার করেছিল সবগুলো বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টা গুম করে রাখার পর পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায় তাকে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানকে অপহরণ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। গুমের অভিযোগের তীরটি ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই। নিখোঁজের ১ বছর ৩ মাস পরে বাবাকে ফিরে পাওয়ার পর সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের মেয়ে বলেছিলেন, বাবার গুমের বিষয়ে তারা বিস্তারিত কিছু বলতে চান না।

গুমের মতো ভয়াবহ পরিণতির অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা ফেরত আসতে পেরেছেন তারা আর কেউ মুখ খুলছেন না। মানবাধিকারকর্মীরা নানাভাবে আশ্বস্ত করেও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারে না। তারা হয়তো দ্বিতীয়বার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চান না। এমনকি ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সংঘটিত বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহারকে অপহরণ বিষয়টিও রয়ে গেল অন্ধকারেই। কিন্তু সরকারি বাহিনীগুলো যদি এর সঙ্গে জড়িত না থাকত, তবে তো তারাই ফেরত আসা ব্যক্তিদের অভয় ও নিরাপত্তা দিয়ে তাদের থেকে তথ্য বের করতে পারত। দায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু গত একযুগে এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি। শুরুতে তুলে নেওয়ার কথা অস্বীকার করে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে অনেককে। এই মানুষগুলোকে গ্রেপ্তার না দেখালে তারাও হয়তো থেকে যেত গুমের তালিকায়। ফলে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, গুমবিরোধী সনদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসএপেয়ারেন্স’-এ কেন সই করেনি বাংলাদেশ?


  • লেখক চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি — দেশ রূপান্তর/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০২০ 

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-চীন-ভারত সম্পর্ক: কারা কী চায়? কেন চায়?

—  সুলতান মোহাম্মেদ জাকারিয়া 

 

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ হয়েছে যে চীন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। একইভাবে সিলেটের উন্নয়নেও দেশটি বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন প্রকল্প যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণেও চীনের সম্পৃক্ততার কথা রয়েছে। সাবমেরিন ঘাটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে চীন কেন আপাতদৃষ্টিতে ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে এত বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগে আগ্রহী হলো? আমার বিশ্লেষণ হলো এর সম্ভাব্য কারণ এই দুটি অঞ্চলের কৌশলগত অবস্থান। তেঁতুলিয়া জেলার বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। চীন নেপালের সাথে কৌশলগত মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং এ অঞ্চলে চীন ও ভারতকে ঘিরে দ্বিপক্ষীয় কিংবা আমেরিকা-ভারত-চীনকে ঘিরে ত্রিপক্ষীয় ভবিষ্যত যেকোনো সংঘাতে চীন এ কৌশলগত সম্পর্কের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চাইবে। এর পাশাপাশি আপনি যদি বাংলাদেশের রংপুর বিভাগকে রাখেন এবং রংপুর অঞ্চলে যদি চীনারা তাদের কৌশলগত অবস্থান তৈরি করতে পারে তাহলে কাঁকরভিটা ও বাংলাবান্ধার ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ভারতের শিলগুড়ি করিডোর, যেটি ভারতীয়দের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট, সেটির উপর রিয়েল টাইম নজরদারি সহজ হয়। এবং যেকোনো সামরিক মৈত্রিতার ক্ষেত্রে চীন উভয়দিক থেকে (পিনসার মুভমেন্ট) প্রচেষ্টা চালালে এই চোক পয়েন্টটি ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে দখল করে নেওয়া সম্ভব এবং এর মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যেটির সাথে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সেভেন ভারতের সিস্টার যুক্ত করলে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের উপর তীব্র সামরিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব।

এই একই ভূরাজনৈতিক কৌশলের আরেকটি কানেক্টিং ডট হচ্ছে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। সিলেট থেকে চীনের কুনমিং এর মধ্যবর্তী স্থান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মনিপুর রাজ্য এবং মিয়ানমার, যেটি আবার চীনের কৌশলগত মিত্র। এর সাথে আপনি যদি মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের ইতোমধ্যে বিদ্যমান ভারত-বিরোধী মনোভাব ও চলমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে এক করে দেখেন আপনি একটি পরিষ্কার চিত্র পাবেন যে কী হচ্ছে কিংবা কী হবে।




বর্তমানে চীনের কাছে যে পরিমাণ নগদ ও উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে সারা বিশ্বে আর কারো সেটি নেই। ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিন কয়েকদিন আগে এক প্রতিবেদনে বলেছে যে আমেরিকা, জাপান, ও ব্রিটেন এই তিন দেশ মিলে সারা বিশ্বে যত ঋণ কিংবা অর্থ সহায়তা দিয়েছে, চীন একাই তার চেয়ে বেশি দিয়েছে। আমার বিবেচনায় চীন প্রধানত তিনটি কারণে এতটা উদার হস্তে বিশ্বে ঋণ দিয়ে বেড়াচ্ছে কিংবা বিনিয়োগ করছে: (১) নিখাঁদ অর্থনৈতিক কারণে (অর্থাৎ উদ্বৃত্ত টাকা অলস পড়ে থাকলে সেগুলোর প্রকৃত মূল্য হ্রাস পাবে, সুতরাং ঋণ প্রদানই উত্তম বিকল্প), (২) বন্ধু দেশগুলোতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করা (যেমন, আফ্রিকা, এশিয়ার, লাতিন আমেরিকা, এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ), এবং (৩) সামরিক বিবেচনায় কৌশলগত বিনিয়োগ (পাকিস্তানের গোয়াদর, শ্রীলংকার হাম্বানতুতা, ইরানের চাবাহার প্রভৃতি স্পর্শকাতর ভূরাজনৈতিক অবকাঠামোয় বিনিয়োগ ও সেগুলোতে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা)।

বাংলাদেশে পদ্মা সেতুতে চীনা বিনিয়োগ উপর্যুক্ত দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত এবং সিলেট ও তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব উপরের তৃতীয় কারণে বলে আমি মনে করি। এবং যে ভূরাজনৈতিক সমীকরণে চীন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে (তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের মাধ্যমে) ও সিলেটে বিনিয়োগ করতে চায় (ইন মাই ভিউ, টু পজিশন ইটসেল্প স্ট্র্যাটেজিক্যালি উইথইন বেঙ্গল ডেল্টা টু কনফ্রন্ট ইন্ডিয়া ইন এনি ফিউচার কনফ্লিক্ট), সেই একই কারণে ভারত এসব স্থান/প্রকল্পে চীনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধীতা করে। ভারতের জন্য অসুবিধার বিষয় হচ্ছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার/থাকার সুবিধা করে দেওয়ার আশ্বাস ছাড়া তাদের হাতে খুব বেশি স্ট্র্যাটেজিক লেভারেজ নেই যেটি দিয়ে তারা জোর খাটাতে পারে।

অন্যদিকে ম্যাডাম শেখ হাসিনার জন্য এটি শাখের করাত। তিনি জানেন যে, অবৈধ পন্থায় ও জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকতে গেলে তার ভারতীয় গোয়েন্দা এস্টাবলিস্টমেন্টের সহায়তা দরকার। পাশাপাশি তিনি আরো দুটি উপায়ে তার অবৈধ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকে পোক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন (সফলভাবেই): প্রথমত, তিনি গণতন্ত্রের “বিনিময় মূল্য” হিসেবে এলিট শ্রেণিকে রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত একটি ‘স্থিতিশীলতা’ উপহার দিয়েছেন যেখানে তারা নির্বিঘ্নে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে পারেন এবং কিছু অবকাঠামো সমস্যা, যেমন, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ – এসবের সমাধান করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি রাষ্ট্রের জনগণকেও ‘ইটকাঠের উন্নয়নের’ একটি দৃশ্যমান মুলা ঝুলিয়েছেন এই বলে যে ‘গণতন্ত্র না থাকলেও উন্নয়ন আছে’। পাশাপাশি একটি সুবিশাল লুটপাটের রাজনৈতিক অর্থনীতি তৈরি করেছেন যেখানে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে, যেমন - সরকারি কর্মচারিদের বেতন তিন-চারগুণ বাড়িয়ে, সামরিক বাহিনীকে উন্নয়ন প্রকল্পে লোভনীয় বেতনে যুক্ত করে, রেন্ট-সিকিংয়ের সুবিশাল নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে সমাজের উপর দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার মাধ্যমে (যেমন, কওমী আন্দোলন হেফাজতে ইসলামের কিছু লোককে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে কো-অপ্ট করে, দেশব্যাপী উন্নয়নের চুইয়ে পড়া অর্থনীতির ‍সুবিধাভোগী স্থানীয় পেটি বুর্জোয়াদের তোষণের মাধ্যমে)। মুশকিল হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী আসন্ন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে উপরের দুটি উপায়ই চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

করোনা পরবর্তী সংকটপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থায় এই মুহূর্তে চীন ছাড়া আর কোনো দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক দাতার পক্ষে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে চলমান বড় বড় কয়েক ডজন মেগাপ্রকল্পে এই বিশাল অংকের বিনিয়োগ এবং ঋণ প্রদান ছাড়া (বেইল আউট) শেখ হাসিনার পক্ষে প্রথমত উন্নয়নের ন্যারেটিভ এবং দ্বিতীয়ত লুটপাটের রাজনৈতিক অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আর সেটি সম্ভব না হলে আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের তীব্রতা সমাজে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে সেটি ভারতের গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করতে পারবে না। সুতরাং গদি রক্ষায় ভারতের রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা এস্টাবলিস্টমেন্টের সহায়তার পাশাপাশি শেখ হাসিনার ‘চীনা টাকা’ লাগবেই।

মুশকিল হচ্ছে চীন তখনই শেখ হাসিনার তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ ন্যারেটিভ এবং রেন্ট সিকিং কাঠামো টিকিয়ে রাখতে টাকা দিবে যখন বাংলাদেশ চীনের চাহিদামতো বাংলাদেশের স্পর্শকাতর স্থান/কৌশলগত-প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে রাজি হবে। অন্যদিকে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে দিলে ভারত তার দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত স্বার্থ হানির আশঙ্কায় এসব প্রকল্পে বাধা দিবে বা হতে দিতে চাইবে না। এই শাখের করাত ম্যাডাম শেখ হাসিনার ‘ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার’ প্রকল্পটিকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশের জনগণকে বাদ দিয়ে ভারত ও চীন উভয় মিত্রকে খুশী রেখে ক্ষমতা ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা সেটি এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে অতি-রাজনীতি করার ফলও এটি।

তবে এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা তার স্বভাবজাত অতিচালাকীর আশ্রয় নিয়ে উভয় মিত্রকে খুশী রাখতে চাইবেন। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে যেটি ক্ষমতার শর্ট গেম, ভারত ও চীনের কাছে সেটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত স্বার্থের লং গেম। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টাটি অনেকটা সুতোর উপর দিয়ে হাঁটার মতো। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শঙ্কা হচ্ছে এ খাদে কেবল তিনি একলাই পড়বেন না, বাংলাদেশকে নিয়েই পড়বেন।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ পরিস্থিতি তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবেলা করতে পারতেন। বাংলাদেশের জনগণকে জানিয়ে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যেকোনো চুক্তি, সমঝোতা, কৌশলগত ছাড় ও মিত্রতার জোর হতো অন্যরকম। মানুষকে সচেতন করলে, উদ্বুদ্ধ করলে, দেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষকে নিয়ে এ ধরনের বিপদ মোকাবেলা করা যেতো। এবং এটি করা গেলে বিদেশী শক্তিগুলোও তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা কৌশলগত লাভক্ষতি বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বার্থহানি হয় এরূপ যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে বহুবার ভাবতো। কিন্তু বর্তমানে শেখ হাসিনার সাথে জনগণের কোন আস্থার সম্পর্ক নেই। তার কথায় তার নিজ দলের মানুষেরও বিশ্বাস, আস্থা আছে কিনা সন্দেহ। তিনি একাধিকবার রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে দেওয়া কথা বরখেলাপ করেছেন। এই জটিল, সংকটময় মুহূর্তে তার এই একাকীত্বই তার ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারে।


Thursday, September 3, 2020

বিএনপি'র সাফল্য যেখানে

খায়রুল কবীর খোকন


খায়রুল কবীর খোকন

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার এক মহাসংকটকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন একটানা সাড়ে পাঁচ বছর প্রায়। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে সেই সাড়ে পাঁচ বছর ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র, যে গণতন্ত্র ও মানবিক-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়নে এক অসাধারণ প্রচেষ্টা।


বাংলাদেশের সব ধরনের রাজনীতিককে এক কাতারে শামিল করে মিত্রতার বন্ধনের লক্ষ্যে একটা জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠাই ছিল বিএনপি প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। জিয়াউর রহমান ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার আমলে 'দুর্নীতিবাজ স্বজন-চক্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারেনি। তাই রাজনীতিতে তার সঙ্গী-সাথীরাও দুর্নীতি করার দুঃসাহস দেখাননি- সেখানেই ছিল জিয়াউর রহমানের আসল সাফল্য।


রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি বড় কাজ ছিল- স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সারাদেশে খাল কাটা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। এর ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে সাফল্য অর্জন, ফসলি জমিতে সেচ কাজে বিশেষ সহায়ক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন এবং প্রাকৃতিক জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির তৎপরতা এবং গ্রামীণ নৌকা ও ছোট মোটরলঞ্চ চলাচলের নৌপথ সুগম করতে সাফল্যের পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল। আর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে 'আলসেমি-আক্রা' মানসিকতার অবসান ঘটিয়ে কর্ম-উদ্দীপনার পথে আগুয়ান করার তৎপরতার গতিলাভ ঘটেছিল। 'চির-আলস্যপ্রিয়' আমলা-গোষ্ঠী বেশ খানিকটা কর্ম-উদ্যোগী স্বভাবে উদ্বুদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল।


জিয়াউর রহমানের শিল্পায়ন কর্মকাণ্ডও ছিল প্রবলভাবে গতিশীল। তার উদ্দীপনাময় কর্মতৎপরতা দেখে নতুন একটা শিল্প বিনিয়োগকারী গ্রুপ 'কর্মহীন আলস্যে দিনযাপন' ছেড়ে বেরিয়ে এসে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কাজে উৎসাহী হয়েছিল। বিশেষভাবে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠা ও বিকাশের সুযোগটাই পেয়েছিল জিয়ার আমলে। দেশের ভেতরে জিয়াউর রহমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছিলেন এবং পাশাপাশি কর্মজীবী-শ্রমজীবী বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও জোরদার করেছিলেন।


তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সুস্থ শিক্ষানীতির পরিচালনায় আনার চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের নিজের উৎসাহে একটি শিক্ষা কমিশন বসেছিল, দেশসেরা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উন্মুক্ত অধিবেশনে বসে তারা অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি রিপোর্ট তৈরি করে উপস্থাপন করেছিলেন। সেই রিপোর্টটি এ দেশের শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি সেরা কাজ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। রিপোর্টটি পেশের পরে সুবিধাবাদি ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্র সেটা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।


জিয়াউর রহমানই রাজনৈতিক দলগুলোর রেজিস্ট্রেশন প্রদানের ব্যবস্থা করেন, সেখান থেকেই অনুমোদন লাভ করে 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ'। একইভাবে অন্যসব রাজনৈতিক দলও অনুমোদন লাভ করে। জিয়াউর রহমান নিজে প্রথমে জাতীয়তীবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (জাগো-ছাত্রদল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটান। এর পর পরই জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগো-দল) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি ও জাসদ এবং অন্য কয়েকটি দলের নেতাকর্মী-সংগঠকদের একটি বড় অংশ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়ায়, বেশ কিছু নেতা প্রথম দিকে এসেও 'বিভ্রান্তিকর রাজনীতি'র নানা বিবেচনায় আবার ছিটকে পড়েন।


শেষ অবধি ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিনটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে তার চেয়ারম্যান পদে আসীন হন জিয়াউর রহমান। অবশ্য এর আগেই তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন এবং একটি গণভোট করে ব্যাপক জনভোটে জয়লাভ করেছিলেন এবং বিএনপির উনিশ দফা উন্নয়ন-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেটি ছিল নিঃসন্দেহে বড় মাপের বিপ্লবাত্মক কর্মসূচি। তার মধ্যে দেশ গঠন ও উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার প্রক্রিয়া শক্তিশালী ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানোর একটি সুবিশাল পথযাত্রার সূচনা পর্ব ছিল। ছিল স্বদেশের তরুণ ও যুবসমাজকে 'চির আলস্য ছেড়ে দিয়ে একটি পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনমূলক জাতীয় কর্মকাণ্ডে' সরাসরি সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী করার যারপরনাই প্রচেষ্টা।


জিয়াউর রহমানের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনকালে (উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠানকাল ধরে) তিনি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে চীনা সহায়তা-অর্জনের প্রচেষ্টায় অগ্রসর হন। রাষ্ট্রপতি জিয়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য তার কূটনৈতিক সুবিধা লাভের প্রয়াসে অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালী রাষ্ট্রের সরকারগুলোকে কার্যকর লবিং করার মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ লাভ করেন।


জিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ-বিদেশে শক্তিশালী-ভূমিকা এবং বিএনপির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা একে অন্যের সম্পূরকরূপে বিবেচিত হবে। বস্তুত, 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি' দিয়ে বিএনপি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশীয় নয়া উপনিবেশবাদী ও আধিপত্যবাদী রাজনীতি-কূটনীতি সামাল দেওয়ার কাজে যে ভূমিকা রাখতে সক্ষম, তা এ দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। সেখানেই জিয়াউর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির সাফল্য, সেখানেই সার্থকতা।


  • লেখক - খায়রুল কবীর খোকন
  • যুগ্ম মহাসচিব; সাবেক সংসদ সদস্যও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক, বিএনপি
  • কার্টসি - সমকাল/ সেপ্টেম্বর ২, ২০২০ 

Wednesday, August 26, 2020

ভূ -রাজনীতির টানাপোড়েন: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ডক্টর এম মুজিবুর রহমান



এক: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়া বিশ্লেষণমূলক লেখা প্রকাশ করছে । সম্প্রতি চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের পর থেকে এটা এখন আর মিডিয়ার আলোচনায় সীমাবদ্ব নেই। কূটনীতি ও রাজনীতি এ নিয়ে সরগরম। ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার করোনার মধ্যেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এক ঝটিকা সফরে ঢাকা আসেন । ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রিংলার ঝটিকা সফরের খবর এমন সময়ে এলো যখন বাংলাদেশ খুব দ্রুত তিস্তা নদী প্রকল্পে চীন থেকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার পেতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা হয়েছে ।  এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা ইস্যুর আশু সমাধান হবে বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিলেও এখন পর্যন্ত এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সেই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি । ভারতীয় মিডিয়া বলছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদেশ দূত হিসাবে শ্রিংলা একটি বিশেষ বার্তা হস্তান্তর করেছেন।  বলা হচ্ছে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, সম্প্রতি প্রকাশিত একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার বহুল আলোচিত সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ নাকি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো হাই প্রোফাইল বৈঠক প্রশ্নে মিডিয়াকে তেমন কিছু জানানো হয়নি।

বাস্তবিক অর্থে দু'দিক থেকেই পরিষ্কার করে কিছু বলা হচ্ছে না। বাংলাদেশের মিডিয়া মনে হচ্ছে খুবই হিসেবে নিকেশ কষে সতর্কতার সাথে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যতটুকু দেয়া হচ্ছে ততটুকু ছাপছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখানে নেই বললেই চলে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়াতে এ সফর নিয়ে নানারকম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে । বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া সেই রিপোর্ট তথ্য সূত্র দিয়ে প্রকাশ করছে। 

কূটনীতিতে সাবধানতার সাথে শব্দচয়ন করার চেষ্টা করা হয়। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকেরা রুঢ় বাস্তবতাকে  জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন । যেসব দেশে তুলনামূলকভাবে সহনশীল রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন সর্বোপরি জনগণের ভোটাধিকার বিদ্যমান সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতার একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের বিশেষজ্ঞরা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য দেশের সাথে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক বা চুক্তিসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, যাতে করে নিজ দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকে। আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে মেঠো বক্তৃতার একটা রেওয়াজ থাকলেও  কূটনীতিতে দেয়া-নেয়ার বিষয় জড়িত। তাই বিভিন্ন পক্ষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে নিজের স্বার্থটুকু আদায় করে নিতে হয়। এখানে অন্য দেশের প্রতি দায়বোধ বা আবেগের  বিষয় প্রাধান্য পাবার কথা নয় । তবে এটা নির্ভর করে আভ্যন্তরীন রাজনীতি ও দেশের জনগণের স্বার্থের ব্যাপারে দায়বোধ ও জবাদিহিতার উপর । 

ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিরোধী কুৎসিত প্রচারণার ব্যাপারে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশন প্রতিবাদ জানিয়েছে । চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্বে ভারত তাদের ভূমি হারিয়ে এবং পরিবর্তিত আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে হয়তো পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপালের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চাইছে । বিশ্লষেকেরা মনে করেন, বিগত দিনগুলোতে প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অবজ্ঞা, অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা না দেয়া, সীমান্ত হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান, মুসলমান হিন্দু বিভাজনকে উস্কে দেয়া ইত্যাদি নানা ইস্যূতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের ইমেজ একেবারে তলানিতে। এর পরে গত দু'তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে দেশের জনগণ, সুশীল সমাজ ও বিরোধীদলসমূহের চাপা ক্ষোভ রয়েছে বলে মনে করা হয় ।  এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বিতর্কিত ভূমিকার  বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত । ঐ সময় তিনি দেখা করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ এম এরশাদের সাথে। সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেই এরশাদ ঘোষণা দেন, ‘ওনারা বলেছেন, নির্বাচন করুন। আমি নির্বাচন না করলে নাকি জামায়াত-শিবিরের মতো মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসবে ।’ বলা হয় - তিনি তাকে অনুরোধ করেছিলেন পরের বছর ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য। বিষয়টি মিডিয়ার কাছে এরশাদ ফাঁস করে দিলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। (সূত্র: প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর ২০১৩) ।  তাই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যা বলা হচ্ছে বিষয়টি হয়তো এতো সাদামাটা নয়। অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের এই বাস্তবতা বিশ্বাস করার সাহস দেয় না। আগেই যে চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে। কথায় আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।


দুই:

চীন ও ভারত উভয়ে যার যার স্বার্থে বাংলাদেশকে ঘিরে আগ্রহ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই শক্তি বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন তাদের মধ্যেও ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানী ও কাঁচামাল সরবরাহে জল প্রবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। শিপিং লাইন দিয়ে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার সমপরিমাণের পণ্যদ্রব্যাদি এবং তৈল-গ্যাসের বাণিজ্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই এ শিপিং লাইন কোনো কারণে বন্ধ বা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে উন্নয়নের চাবিকাঠি আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্য সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও রয়েছে সমুদ্র থেকে অফুরন্ত সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, জ্বালানি-ভান্ডার ও নৌ-পথে মালামাল সরবরাহে নিষ্কন্টক নিরাপত্তা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক দেশের বিদেশ নীতি পরিচালিত হয়। 

বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভূখণ্ড বঙ্গোপসাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত। পশ্চিম তীরে রয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ড । আর বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড অবস্থিত। তীরবর্তী দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে নৌ পথে যেতে পারে। স্বভাবতই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী  দেশগুলো বঙ্গোপসাগরে তাদের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখতে চাইবে । এক্ষেত্রে কোনো দেশ একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখবে নাকি সম্মানজনক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে তা নির্ভর করে দেশগুলোর আভ্যন্তরীন রাজনীতির ধরণ, দেশের স্বার্থ রক্ষায় পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক শক্তির ওপর।

ভারত যেমন বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে চায়, তেমনই চীনও নিজের বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে চাইতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কমন সীমান্ত না থাকায় চীনকে মিয়ানমারের সীমান্ত হয়ে বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করতে হয় । এক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ অর্থনীতির দেশ শুধুমাত্র একটি দেশের উপর নির্ভর করে থাকতে চায় না। তাই বাণিজ্যিক স্বার্থের পাশাপাশি ভূ-কৌশলগত  কারণে বাংলাদেশে চীনের আগ্রহ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।   

চীন একটি বৃহৎ দেশ। এর পূর্ব থেকে পশ্চিমের দৈর্ঘ্য কল্পনা করাই কঠিন। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ থেকে চীনের মালামাল যদি সমুদ্র পথে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় নিতে হয়, তাহলে সেই মালামাল প্রথমে নিতে হবে চীনের পূর্ব অংশের বন্দরে। এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। তাই চীন যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সময় ও খরচ বাঁচাতে পারে, তাহলে তার অর্থ সাশ্রয় হয়। অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি চীন চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। 

ব্রস ভৌগন (Bruce Vaughn) নামে একজন এশীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ 'বাংলাদেশ: পলিটিক্যাল এন্ড স্ট্রাটেজিক ডেভেলপমেন্টস এন্ড ইউএস ইন্টারেস্টস' (Bangladesh : Political and Strategic Developments and US Interests) শিরোনামে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট আমেরিকান কংগ্রেস সদস্যদের জন্য একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেন । এটি কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস (Congressional Research Service) (সিআরএস-CRS) রিপোর্ট সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। ওয়েবসাইটে যে কেউ তা দেখতে পারেন। 

রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চারজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী বা মূল খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন (১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, (২) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, (৩) ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং (৪) সামরিকবাহিনী। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বক্তব্যটি এই রিপোর্টে লেখা হয়েছে তা হচ্ছে- ‘Bangladesh is situated at the northern extreme of the Bay of Bengal and could potentially be a state of increasing interest in the evolving strategic dynamics between India and China. This importance could be accentuated by the development of Bangladesh’s energy reserves and by regional energy and trade routes to China and India’ (‘বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। তাই এখন ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত কারণে যে ধরনের গতিশীল সম্পর্কের সূচনা হয়েছে তাতে করে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে (মার্কিন) স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের জ্বালানি মজুদ বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক জ্বালানি-ভান্ডার এবং চীন-ভারতের মধ্যেকার বাণিজ্যপথের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়বে’) ।  

চীন, ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বাংলাদেশের ওপর নানা রকম চাপ বাড়বে । বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার আগামীর কৌশলগত স্বার্থে সহযোগিতা পেতে বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। পর্যবেক্ষকদের মতে এই শঙ্কাও একদম উড়িয়ে দেয়ার মত নয় যে, তারা এমন চুক্তি করতে চায় যাতে বাংলাদেশে প্রয়োজনে তার সামরিক উপস্থিতির পথ সুগম হয়। সে লক্ষ্য অর্জনেই দেশটিকে অতিমাত্রায় সক্রিয় মনে হচ্ছে। নিজের স্বার্থ এবং শুধু স্বার্থই তাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য। এই পরিস্থিতি অনেকটাই যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধের ছায়া হিসেবে দেখা দিয়েছে।


তিন:

বাংলাদেশকে নিয়ে এখন অনেকেরই জোর আগ্রহ। সে আগ্রহ ক্রমবর্ধমান। বলা যায়, প্রতিবেশী বা নিকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ। নেতৃত্ব বা অন্য কিছু নয়, বাংলাদেশের এই গুরুত্ব ভূ-রাজনীতি ও বিশাল জনসংখ্যার বাজার এর অন্যতম কারণ। ভারত যে কোনো অবস্থায় বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। উত্তরপূর্ব ভারতের ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত থাকতে এটাই তার একমাত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এসব রাজ্যসমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে  নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অখণ্ড ভারতে একীভূত রাখাও ভারতের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে রাখতেও তার বাংলাদেশকে প্রয়োজন। ভারতের ব্যাপারে চীন-বাংলাদেশকে অন্তত নিষ্ক্রিয় রাখার আশা হয়ত পোষণ করে। 

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি কারো কাছেই আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠূ নির্বাচন অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তারা বাংলাদেশকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহার করছে ও করতে চায়, যা কিছু নেয়া সম্ভব নিচ্ছে ও নিতে চায়। অতীতে এতো কিছু দেখা না গেলেও সাম্প্রতিক ইতিহাস তার ব্যতিক্রম। ২০১৮ সালের মে মাসে ভারত সফর শেষে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে’ । এর আগে ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকা ‘বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘আপনি কোন প্রতিদান চেয়েছেন কিনা? চাইলে কোনও আশ্বাস পেয়েছেন কিনা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কোনও প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’

কিছুদিন পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইস্ট এশিয়া ফোরাম 'চায়না এন্ড ইন্ডিয়া'স জিওপলিটিক্যাল টাগ অব ওয়ার ফর বাংলাদেশ' । অর্থাৎ 'বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ব' নামে একটি নিবন্দ্ব প্রকাশ করে। আর নিউইয়র্ক ভিত্তিক 'ওয়ার্ল্ড পলিসি রিভিউ' ঠিক এ বিষয়েই 'উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের' একজন গবেষকের অভিমত প্রকাশ করে । লেখাটির শিরোণাম ছিল, হোয়াই ইন্ডিয়া এন্ড চায়না আর কম্পিটিং ফর বেটার টাইস উইথ বাংলাদেশ।" অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে কেন ভারত আর চীনের মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা? 

এসব লেখাতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন এবং ভারতের সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাংলাদেশর রাজনীতি ও নির্বাচন এবং দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ রয়েছে। এ নিয়ে বিবিসি বাংলার 'কার অবস্থান কোথায়?', 'অবকাঠামো খাতে প্রতিযোগিতা', 'আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রশ্নে অবস্থান', 'বাংলাদেশ যেভাবে খেলছে', 'প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শেষ কথা নয়', উপ শিরোনাম থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে চীন ও ভারতের মনোভাবকে অনেকটা উপলব্দি করা যায় ।  

বাংলাদেশকে নিয়ে চীন এবং ভারতের প্রতিযোগিতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসে'র মাইকেল কুগেলম্যান তার পর্যবেক্ষণে বলেন, দুটি দেশ একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে। যুক্তরাষ্ট্রের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের ঘনিষ্ঠতা বহু বছর ধরেই বাড়ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়নি। মাইকেল কুগেলম্যান অবশ্য ভারত যে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রেখেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্বি করছে তা উল্লেখ করেননি। 

তিনি মনে করেন যে, দিল্লি হয়তো এক সময় এই বাস্তবতা মেনে নেবে যে, ঢাকা অবশ্যই চীনের পুঁজি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করবে। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চাইবে। তবে এক্ষেত্রে ভারত হয়তো চাইবে চীন যেন কেবল অর্থনৈতিক খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তারা যেন বঙ্গোপসাগরে কোন ধরণের নৌ স্থাপনা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর না হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও দিল্লীকে এখনো প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অনেকের ধারণা ভারতের ইশারাতেই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ চীন পায়নি। বরং সঠিকভাবে সম্বাভ্যতা যাচাই ছাড়া এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে জাপানকে পায়রা বন্দরের কাজ দেয়া হয়েছে।  

আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রশ্নে অবস্থান নিয়ে 'ইস্ট এশিয়া ফোরামে' প্রকাশিত নিবন্দ্বে ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক মনে করেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসলে সেটা ভারতকে বিচলিত করবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ বিষয়ে দিল্লির কৌশল একেবারেই স্বলমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা তাড়িত। তাদের কৌশলটা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা, সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে দেয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে চীন খেলছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য সামনে রেখে। তারা এক দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে তারা একটা ভারসাম্য রাখছে।

অনেক বিশ্লেষকেরা মনে করেন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বিমাতাসুলভও বটে । এটা হয়তো তার নিজের বৃহত্তর স্বার্থেই করতে হয়। আর এজন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্বি ও মর্যাদাবান উত্থানে ভারত বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে । কারণ বাংলাদেশের মর্যাদাবান উত্থান ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং এর বাইরের রাজ্যসমূহে স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে আরো বেগবান করবে বলে ভারত শংকিত থাকতেও পারে ।


উপসংহার:

ভূ-রাজনীতির প্রতিযোগিতা ও সহযোগীতাকে কাজে লাগিয়ে কূটনীতিতে দর কষাকষির সুযোগ থাকে। যেনতেন উপায়ে ক্ষমতায় ঠিকে থাকার স্বার্থে নাকি জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে এই শক্তি কাজে  লাগানো হবে সেটা একটা দলের সাথে জনগণের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। জনবিচ্ছিন্ন সরকার ও রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটের উপর আস্থা রাখতে পারে না বলেই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, গোটা দুনিয়ার সাথে অর্থনীতির সংযোগের প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা আত্মমর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করে নয়। পৃথিবীতে যারা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতিতে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করছে তাদের অতীত ইতিহাস যে খুব মসৃণ  ছিল, তা কিন্তু নয় । পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্বে বাংলাদেশের জনগণ সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখতে না পারলে আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতো তারা। 


ব্রিটেন-ফ্রান্স, জার্মানি-ফ্রান্স, ব্রিটেন-আমেরিকা সভ্যতার সৃষ্টি থেকে এরকম শত শত উদাহরণ রয়েছে যারা  একে অন্যের সাথে যুদ্ব করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনিভাবে প্রতিটি জাতি ঐক্যবদ্ব হয়ে ত্যাগ স্বীকার করে তাদের আত্মিনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরেই একে অন্যের সাথে মর্যাদার  ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে মাত্র । অনেকে মনে করেন সশস্র যুদ্বের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিকে যারা 'খয়রাতি' বলে অবজ্ঞা করে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে জবাব দিতে হবে। অন্যথায় সামনে আরো অনেক কিছু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পপুলিস্ট ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ডামাডোলের বিপরীতে উদার গণতন্ত্র, সহনশীল ও মধ্যপন্থী রাজনীতির প্রতি এ অঞ্চলের জনগণ ও সুশীল সমাজকে ঐক্যবদ্ব হয়ে কাজ করা উচিত । গ্লোবাল বিশ্বে এখন একা চলার অবকাশ নেই। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সাথে মর্যাদাপূর্ণ ভারসাম্যের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতেই পারে । একবিংশ শতকের আধুনিক দুনিয়ায় বন্ধুত্বকে জোরদার করতে হবে ন্যায্য হিস্যা দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে। অন্য কোন রাস্তা খোলা নেই এখানে। শুধু দেয়ার অভ্যাস থাকলে ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যায় না।  আর ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে প্রয়োজন আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা।  অন্যথায় শুধু দিয়েই যেতে হয়। কারণ সমর শক্তির চেয়ে ঐক্যবদ্ব জাতির শক্তি অনেক বেশি।   

      

আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে থাকাই তাহলে দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেখতে পাই যে, প্রধানত দুটি বা তিনটি রাজনৈতিক দল পালাক্রমে দেশ শাসন করে আসছে ।  এক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া ও মর্যাদার আসনে উন্নীত করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্রমান্বয়ে জবাবদিহিতার কাঠামোতে নিয়ে আসতে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক ধরনের 'লিভ এন্ড লেট লিভ'র  সমঝোতা থাকা চাই ।  যাতে সুযোগ সন্ধানীরা রাজনীতিকদের ক্ষমতাপ্রীতি ও দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ নিয়ে যাচ্ছেতাই খেলা করতে না পারে। আর এতে করেই রাষ্ট্র পেতে পারে একটি আত্মমর্যাদাবান ও অগ্রসর জাতি আর জনগণ পাবে একটি কল্যাণকর মানবিক রাষ্ট্র । 


তবে আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির লড়াইয়ে মগ্ন থাকে, তখন গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার, দুর্নীতি, আইনের শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পরে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তির উচিত বাকসর্বস্ব রাজনীতির বিপরীতে মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির চর্চা এবং গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে নিজ দেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্ভুদ্ব করা । এখানে অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই । অতীত ইতিহাস ঘাটলে এর অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। আর অতি সাম্প্ৰতিক বালির অভ্যুত্থান, বেলারুশের জনআন্দোলন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।


পরিশেষে বলা যায়, অন্য দেশের সাথে দেয়া-নেয়ার মর্যাদা ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্ভর করে সরকারের প্রজ্ঞা ও জনগণের প্রতি দায় ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার উপর। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে চলে না । দেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ সর্বোপরি জনগণেরও নিজের প্রাপ্য আদায়ে সচেতন ও সোচ্চার হওয়া জরুরি । ঘটনার সাক্ষী হয়ে শুধু পর্যালোচনা নয়, যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না।


রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক মহল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মনে করেন যে, বাংলাদেশ সরকার দেশের কৌশলগত অবস্থান ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রতি আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি সমূহের আগ্রহ ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জাতীয় ঐক্য গঠনে সুবিবেচনার পরিচয় দেবে। এটাই সর্বতোভাবে কাঙ্খিত । 


  • লেখক: ডক্টর এম মুজিবুর রহমান। সংবাদ বিশ্লেষক, সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট। লন্ডন, ২৫ অগাস্ট ২০২০ 


চতুর্থ বছরে রোহিঙ্গা সংকট

সম্পাদকীয়



তিন বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করেছে রোহিঙ্গা সংকট। পরিতাপের বিষয় হল, এ দীর্ঘ সময়েও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনোরকম অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জানা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতিমূলক সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার।

অবশ্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেই ছয় লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, এ ভাবনা ভুল।

তারা মূলত দুটি বড় আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুঃখজনক হল, এ দুটি দেশ কার্যত কোনো চাপ না দিয়ে কেবল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে মিয়ানমারকে, যা মোটেই যথেষ্ট নয়। কূটনীতিকদের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ফলপ্রসূ করতে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ জরুরি। তা না হলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে।

প্রত্যাবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রত্যাবাসনের সুযোগ নেয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মিয়ানমার সরকারের বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ইতোপূর্বে জানা গিয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সুশাসন ও আইনি পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপের আওতায় উত্তর রাখাইন রাজ্যে যাতে কোনো ধরনের বৈষম্য না হয়, সেজন্য স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশকে নির্দেশনা প্রদানের কথা জানিয়েছিল দেশটি।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে গৃহীত বাস্তব কোনো পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করিনি। এটি সহজেই বোধগম্য যে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে বিপদ মাথায় নিয়ে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরতে চাইবে না।

ফিরে গেলেও পুনরায় নিগৃহীত হলে এবং তাদের ওপর হামলা হলে তারা আবারও এ দেশে পালিয়ে আসবে। কাজেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পাশাপাশি সেদেশে তাদের নিরাপদ বসবাসের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এজন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে মিয়ানমার যাতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়টির ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়াও বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়। বর্বরোচিত নির্যাতনের ফলে ওই সময় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অতীতে আসা রোহিঙ্গাদের বড় অংশ এখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি। গত কয়েক দশকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দীর্ঘসূত্রতা ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মিয়ানমার সরকার যাচাই-বাছাইসহ অন্যান্য অজুহাত তুলে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যাতে গড়িমসি করতে না পারে, এ ব্যাপারে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত ও চীন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।

  • কার্টসি - যুগান্তর/ আগস্ট ২৬, ২০২০