Search

Saturday, May 1, 2021

বিয়ের মেহেদি হাতে শহীদ হয়েছিলেন যে কিংবদন্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা

 আহমাদ ইশতিয়াক


ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের
(ফে
ব্রুয়ারি ১৯৭১)। ছবিটি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, (বীরপ্রতীক) এর কাছ থেকে পাওয়া।


সময়টা ১৯৬৯ সালের ১৪ নভেম্বর। সবে লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন হয়েছেন আফতাবুল কাদের। নিয়োগ তখন তার পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদের ৪০ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে। এর মধ্যে কদিন পরপর চিঠি আসে দেশ থেকে। তার ভালোবাসার মানুষ জুলিয়ার চিঠি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়া মুর্শেদা বাহার জুলিয়া আত্মিয়তার সম্পর্কে খালাতো বোন। দারুণ সুন্দর জুলিয়া। আফতাব কাদের‌ও কম নন, তার গলায় ইংরেজি গান শুনে অন্যান্য অফিসাররা তাকে বিখ্যাত হলিউডের নায়ক রক হাডসনের নামে ‘রকি’ বলে সম্বোধন করতেন।

জুলিয়ারা তখন থাকে চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারের সিরাজ-উদ-দৌলা রোডে। আর আফতাবের বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের সাবেক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের। যদিও তারা থাকতেন পুরাতন ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লালমোহন পোদ্দার লেনে।

জুলিয়া এবং আফতাব দুজনের পরিবারেরই ইচ্ছে বিয়েটা সেরে ফেলার। কারণ সেনাবাহিনীর চাকরি, সহসা ছুটি মেলে না। ১৯৭১ এর জানুয়ারি মাসে তাই এক বছর ছুটির জন্য আবেদন করলেন ক্যাপ্টেন আফতাব। কিন্তু ছুটি মঞ্জুর হলো দুই মাসের।‌ পাঁচ ফেব্রুয়ারি দেশে এলেন আফতাব। ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ মহা ধুমধাম করে জুলিয়াদের বাড়ি চট্টগ্রামের দেওয়ান বাজারের সিরাজ-উদ-দৌলা রোডে বিয়ে হলো তাদের। এরই মধ্যে দেশের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেল। ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে নববধূসহ  ঢাকার বাড়িতেই  ছিলেন আফতাব। গণহত্যার পর আফতাব সিদ্ধান্ত নিলেন আর ফিরে যাবেন না পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মস্থলে। মার্চের ২৮ তারিখ আফতাব ঢাকা ছেড়ে ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে। 

বিয়ের মাত্র একমাস পার হয়েছে মাত্র। প্রিয় মানুষ জুলিয়াকে নিয়ে মায়ার সংসার। অথচ এক রাতে সব মায়া ত্যাগ করে দেশমাতৃকার টানে বাড়ি থেকে চলে গেলেন আফতাব কাদের। শুরু করলেন এক অনির্দিষ্ট পথে যাত্রা। লক্ষ্য দেশ স্বাধীন করার। চট্টগ্রাম তখনো মুক্তাঞ্চল। ঢাকা চটগ্রাম মহাসড়ক জুড়ে বিভিন্ন পজিশনে ক্যাপ্টেন রফিক (পরবর্তীতে মেজর এবং ১ নং সেক্টর কমান্ডার) এর নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী নিয়েছিল শক্ত অবস্থান। 'জান দেব, তবু রাস্তা ছাড়বো না' -এই মূলমন্ত্র নিয়ে মাটি কামড়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহগুলোতে স্বল্প রসদে লড়ে যাচ্ছিল সেদিন হাজার হাজার ইপিআর। 

১৩ এপ্রিল, ১৯৭১

এদিন দুপুরে  রামগড় থানার ওসির অফিসে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম আর ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান আলোচনায় ব্যস্ত। এমন সময় থানায় এলেন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির এক  সুঠামদেহী  যুবক। এসেই মিলিটারি কায়দায় সালাম ঠুকে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের, আর্টিলারি, রিপোর্টিং প্রেজেন্ট স্যার।’ মেজর জিয়া পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে আফতাবের কোর্সের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। ইতোমধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের ৮ ইস্ট বেঙ্গলের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে মহালছড়িতে ডিফেন্স নিলেন।


সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত দ্বিতীয় লে. আফতাবুল কাদের। ছবিটি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, (বীরপ্রতীক) এর কাছ থেকে পাওয়া।


সেই যুদ্ধের আগে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়টা বলে নিই। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ইকবালের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে। যদিও তাদের পৈত্রিক নিবাস ছিল লক্ষ্মীপুর জেলাএ রামগঞ্জ থানার তেওড়ি গ্রামে। তার বাবা আবাস গড়ে তোলেন পুরান ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লালমোহন পোদ্দার লেনে। সে বাড়িতেই শৈশব কেটেছিল আফতাবুল কাদেরের। বাবা আব্দুল কাদের ছিলেন ইংরেজ আমলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আর মা রওশন আরা বেগম গৃহিনী।

বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কেটেছে দেশের নানা জায়গায়। ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। কিন্তু সে বছরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন আফতাব কাদের। দু বছর পর ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশনপ্রাপ্ত হলেন আর এর পরের বছর ১৯৭০ সালে হায়দারাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দিলেন।

ক্যাপ্টেন কাদির যখন এই ইপিআর সৈন্যদের সঙ্গে ফেনীর ছাগলনাইয়ার শুভপুর প্রতিরক্ষায় যোগ দিলেন। পাকিস্তানিরা হেলিকাপ্টারের সাহায্যে শুভপুরে সৈন্য নামানোর সময় গ্রামবাসীদের সহায়তায় ধরে ফেলেন একজন সৈন্যকে। পরবর্তীতে তিনি রামগড় ফিরে আসেন। এখানে তিনি ৫০০ জন তরুণকে নিয়ে গড়ে তোলেন একটি মুক্তি ক্যাম্প। এসব তরুণদের তিনি নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন।

নিজের অধীনস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বীবিত করতে একটা কথা প্রায়ই বলতেন ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের। “একজন পাকিস্তানি সৈন্যকে খতম করার অর্থ হলো এদেশের অন্তত এক লক্ষ নিরীহ মানুষ ও নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা।”

ফেনীতে গিয়ে তিনি শুভপুরের যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর সাথে যোগ দেন। শুভপুর ব্রিজ এলাকায় তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টারের সাহায্যে ছত্রী সেনা নামাচ্ছিল। পাকিস্তানি ছত্রীসেনাদের একজনকে ক্যাপ্টেন আফতাব গ্রামবাসীর সহায়তায় ধরে ফেললেন। বন্দি ছত্রীসেনাকে নিয়ে ২ এপ্রিল ১৯৭১ রাতে পৌঁছান রামগড় শহরে।

২৪ এপ্রিল ১৯৭১

সেদিন খবর এলো মেজর শওকতের কাছ থেকে। এখনই তাকে মহালছড়িতে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়া হলো। নির্দেশ মতো ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের রওনা দিলেন মহালছড়ির উদ্দেশ্যে। বুড়িঘাটে এসে দেখা হলো লেফটেন্যান্ট মাহফুজ, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, হাবিলদার সায়ীদ এবং হাবিলদার তাহেরসহ আরো অনেকের সাথে। বুড়িঘাট থেকে রওনা হয়ে যখন ক্যাপ্টেন কাদেরদের লঞ্চটি একটি দ্বীপে (কাপ্তাই লেকের মধ্যে পাহাড়গুলোকে দ্বীপের মতোই মনে হয়) এসে ভিড়লো তখনই পাক বাহিনীর একটি ধাবমান লঞ্চ এসে পৌঁছাল সেখানে। বন্দুকভাঙ্গায় ক্যাপ্টেন আফতাব এর বাহিনীকে না পেয়ে শত্রুপক্ষ কয়েকটি লঞ্চে করে পুরো লেক এলাকায় তাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণে ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের কোম্পানির সদস্যরা এদিক সেদিক ছিটকে পড়লেন।

শুরু হয় বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি বিনিময়। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আফতাবের পাশে থেকে যান হাবিলদার সায়ীদ এবং হাবিলদার তাহের। এদের দুজনের হাতে ছিল এলএমজি। তিনটি এলএমজির অনবদ্য গুলি বর্ষণের ফলে শত্রুপক্ষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে গেল। এক ঘণ্টা ধরে চলছিল বুড়িঘাটের এই যুদ্ধ। শত্রুপক্ষ পিছু হটে যাবার পর নিজ বাহিনীর সদস্যদেরকে একত্রিত করে মহালছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন ক্যাপ্টেন আফতাব। সাথে লেফটেন্যান্ট মাহফুজ, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানসহ আরো বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিবাহিনীর অবস্থান তখন সুবিধাজনক ছিল না। উপর্যুপরি বিমান আক্রমণ চলছিল। রামগড় দখলে নেবার জন্যও পাকিস্তানি বাহিনী তখন সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মহালছড়িতে তখন বিক্ষিপ্ত সেনা দলগুলোকে একত্রিত করার কাজ চলছিল। উদ্দেশ্য শত্রুপক্ষের উপর শেষ আঘাত হানা।

এদিকে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড হামলার মুখে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাকবাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলো। তাঁরা মিজোরামের দু’টি বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্যদের নিজ দলে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। অন্যদিকে স্থল আক্রমণের সাথে সাথে বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যেও শুরু করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য অবস্থান-ঘাঁটির উপর প্রবল হামলা। এ অবস্থায় পার্বত্য এলাকায় পূর্ব ট্রেনিংবিহীন মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। রসদ এবং গোলাবারুদ সংকটও দেখা দিলো তাদের।


                                    শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের স্ত্রীর কাছে লেখা 

জেনারেল ওসমানীর ডিও লেটার।



২৭ এপ্রিল ১৯৭১


সেদিন সকাল থেকে মহালছড়ির অবস্থা থমথমে। এই প্রতিকূল ও দুর্বল মুহূর্তে ২৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬ জন) এবং একটি মিজো ব্যাটালিয়নকে (১০০০ জন) সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। মেজর মীর শওকত এবং চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের প্রকৌশলী ইসহাকের নেতৃত্বে ওই সময় শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছিলো। এর মধ্যে হানাদার বাহিনী  হেলিকপ্টারযোগে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আরও এক কোম্পানি সৈন্য এখানে নামিয়ে দিয়ে যায়।

দুই পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলি। এ যুদ্ধের মধ্যে বেলা ৩টায় ক্যাপ্টেন আফতাবের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি মহালছড়ি এসে পৌঁছালেন। সুদক্ষ যুদ্ধ কৌশলে টগবগে তরুণ ক্যাপ্টেন  আফতাব সঙ্গীদের নিয়ে নামলেন শত্রু মোকাবিলায়। তাদের এ সম্মিলিত কঠিন প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনী প্রথম অবস্থায় পিছু হটতে শুরু করে। এতে হানাদারেরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা মিজোদের সামনে রেখে একটার পর একটা আক্রমণ চালিয়ে অগ্রসর হতে থাকলো।

প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা জবাব দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে শত্রুদের। মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায়। তিন চারগুণ অধিক সংখ্যক শত্রুপক্ষ বীভৎস উল্লাস ধ্বনি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। চরম এ বিপজ্জনক অবস্থায় সহযোদ্ধারা পিছু হটার পরামর্শ দেয় ক্যাপ্টেন আফতাবকে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন আফতাব তার সহযোদ্ধা ছাত্র শওকত, ফারুক এবং দুই ইপিআর সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে তিনটি এলএমজির অবিরাম বৃষ্টির গুলিবর্ষণে কোণঠাসা করে ফেলে শত্রুদের। এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ এক সহযোদ্ধার এলএমজির ফায়ারিং বন্ধ হয়ে গেল! শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার জীবনকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার তিনটি এলএমজির একটি অচল হয়ে পড়ায় অস্থির হয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন আফতাব।

মেরামতের জন্য দ্রুত অস্ত্রটি তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশের পরও সহযোদ্ধা শওকতের আসতে খানিক দেরি হওয়ায়, ক্যাপ্টেন আফতাব নিজেই ক্রলিং করে এগিয়ে যেতেই শত্রুর অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে বেধে তার ডান বগলের কয়েক ইঞ্চি নিচে এবং পেটের বাম পাশে।



বৃষ্টির মতো গোলাগুলির মধ্যেই গুরুতর আহত আফতাবকে বহন করে একটু নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন শওকত, ফারুক ও ইপিআরের ড্রাইভার আববাস। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য জিপ গাড়িযোগে রামগড় আসার পথে শহীদ হন অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। অথচ শহীদ আফতাব কাদেরের হাতের মেহেদীর রঙ তখনো শুকায়নি।

ক্যাপ্টেন আফতাব শহীদ হওয়ার পরে তার রক্তভেজা শার্ট আর বিয়ের আংটি সহযোদ্ধারা জেড ফোর্স হেডকোয়ার্টার্সে পাঠিয়ে দেন। যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে মায়ের হাত হয়ে জুলিয়ার হাতে আসে শহীদ স্বামী আফতাবের শার্ট ও আংটি। সেই শার্ট আর আংটিই ছিল শহীদ স্বামীর একমাত্র স্মৃতি।

সময়ের পরিক্রমায় ১৯৭৫ সালে আবার বিয়ে হয়েছিল জুলিয়ার। স্বামী ড. শামসুল হুদা যুক্তরাষ্ট্রের জেভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। আজও প্রতিবছর একবার হলেও দেশে আসেন জুলিয়া আর শামসুল হুদা। এয়ারপোর্টে নামার আগেই এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষায় থাকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ। প্রথমেই তারা সেই জিপে করে ছুটে যান খাগড়াছড়ির রামগড়ের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে। যেখানে শুয়ে আছেন ক্যাপ্টেন আফতাব। স্বামীর কবরের সামনে দাঁড়ান জুলিয়া। যেখানে শেষ আশ্রয় বাংলার নক্ষত্র বীর সেনানী ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরের। মুক্তিযুদ্ধের ২৭ এপ্রিল আজকের দিনে শহীদ হয়েছিলেন কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম)।  যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন শহীদ আফতাবুল কাদের থাকবেন চির ভাস্বর হয়ে। শহীদ হওয়ার দিনে এই দুর্ধর্ষ বীর যোদ্ধার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র -

মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের (বীরউত্তম)/ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। ( বীরপ্রতীক)

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস- প্রথম খণ্ড (মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)

  • লেখক আহমাদ ইশতিয়াক। ইমেইল  ahmadistiak1952@gmail.com

ফ্যাসিবাদের স্বরূপ বিশ্লেষণ

মোহাম্মদ আবুল হাসান 




ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট ক্যোঁতের পজিটিভিজমের সাথে অ্যারিস্টটলের অ্যাক্টিভ ফিলোসোফির ফিউশন ঘটিয়ে বেনেতো মুসোলিনি ও তার শিক্ষামন্ত্রী জেন্টিল জিহোভান্নি ১৯৩২ সালে ডক্ট্রিন অব ফ্যাসিজমের তত্ত্ব হাজির করেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে সহিংস ও যুদ্ধংদেহী ইচ্ছায় গড়ে তোলা কর্মীবাহিনীর সাথে করপোরেট শক্তি, কিছু আমলা ও সেনাবাহিনীর মদদে বেশির ভাগ মানুষের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের প্রতিভ‚ রূপে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় আসীন থাকার আয়োজনই ফ্যাসিবাদ।

মুসোলিনি দাবি করেছিলেন, ফ্যাসিবাদের দলীয় কাঠামো, শিক্ষাপদ্ধতি এবং শৃঙ্খলা তখনই কেবল উপলব্ধি করা যাবে, যখন তার বাস্তবিক প্রকাশকে জীবনের স্বাভাবিক ঝোঁক বা প্রবণতার সাথে মিলিয়ে বিবেচনা করা যায়। তিনি আরো দাবি করেন, অন্যান্য পর্যাপ্ত রাজনৈতিক ধারণার মতো ফ্যাসিবাদও একটি রাজনৈতিক কর্ম ও চিন্তা, যা ঐতিহাসিক শক্তির স্রোতধারায় প্রোথিত ও সেখান থেকে উৎসারিত হয়ে, এর অভ্যন্তরে থেকেই কাজ করে থাকে।

ফ্যাসিবাদ প্রচলিত সব ধর্মীয় আখ্যান ও রাজনৈতিক তত্ত্বগুলোকে খারিজ করে নতুন এক রাজনৈতিক ধর্ম ও আধ্যাত্মিক সময় দাবি করে, যেখানে রাষ্ট্রের ইচ্ছার কাছে ব্যক্তির ইচ্ছা গৌণরূপ ধারণ করে। ব্যক্তি ততটুকুই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে যতটুকু পর্যন্ত রাষ্ট্রের ইচ্ছার সাথে এর সঙ্ঘাত তৈরি না করে। অনেকেই দাবি করেন, ফ্যাসিবাদ বাম রাজনীতির উপাদানগুলো গ্রহণের মাধ্যমে ডান রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। ফ্যাসিবাদী তত্ত্বে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থার স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়ে গণতন্ত্রের মোড়কে বাজারজাত হয়।

ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রাভ্যন্তরে চিরায়ত গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকির অজুহাতে কোনো সম্প্রদায়কে বেছে নিয়ে তাদের ধ্বংস অব্যাহত রাখে। কিন্তু সম্ভব হলেও পুরোপুরি নির্মূল করে দেয় না। ফ্যাসিস্ট ইতালি ও নাৎসি জার্মানি ইহুদি ও সোস্যালিস্টদের বেছে নিয়েছিল। যেমনটা সাদ্দাম হোসেন বেছে নিয়েছিলেন কুর্দিদের, একুশ শতকের ইউরোপ অভিবাসীদের, আমেরিকা ও ইউরোপ গত শতকে সমাজতন্ত্রীদের ও মুসলমানদের, তালেবান, লাদেন একই আদলে তৈরি। আমাদের দেশেও বর্তমানে ইসলামপন্থীদের দমাতে একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

ফ্যাসিবাদ জনগণের সামনে সোনালি অতীতের গল্প হাজির করে, জাতিকে সেই সোনালি দিনগুলোর মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুখ-স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। ১৯২৩ সালের এক বক্তৃতায় মুসোলিনি বলেন, ‘ফ্যাসিজম শ্রমিক ও শ্রমদাতাদের নিয়ে একটি বিরোধশূন্য সম্পর্ক গড়ে তুলে, উৎপন্ন দ্রব্যের সংখ্যা যতদূর সম্ভব বাড়াতে জাতির স্বার্থে প্রায়ই শ্রমিক শ্রেণী ব্যক্তিগত স্বার্থ বলি দিয়েছে। এর মাধ্যমে সিন্ডিক্যাটিজমের করপোরেট স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদ বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাসের গতিধারায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত সমস্যাগুলো সমাধানের অজুহাতে প্রতিপক্ষ নির্মূলের বয়ান হাজির করে। মুসোলিনি বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর জাতিরাষ্ট্রকে তৈরি করার ধারণা সেকেলে হয়ে গেছে বরং রাষ্ট্রই জাতিকে তৈরি করে, যেখানে প্রকৃত জীবনের চাহিদা ও জাতিগত ইচ্ছা ব্যক্তি তার নৈতিক সমর্থনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সপে দেয়। রাষ্ট্র কেবলমাত্র ব্যক্তি ইচ্ছাকে সীমাবদ্ধ করে শাসন করার কর্তৃত্বই নয়, বাস্তবিকভাবে প্রমাণগুলো আত্মস্থ করে উন্নয়ন নিশ্চিত করে থাকে, যার সাইনবোর্ড সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও শাসকশ্রেণীর মহাকর্মযজ্ঞের ডামাডোলে পরিলক্ষিত।

অর্থনৈতিক চরম মন্দাবস্থায়ও মুসোলিনি ১৯৩৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করেছিলেন। শুনতে অবাক লাগলেও পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেল প্রকল্পের মতো মেগা কাজগুলোও চিরায়ত এই চরিত্রের প্রকাশ বলে মনে হয়। মুসোলিনি সুচতুরভাবে আরো বলেন, যারা ফ্যাসিবাদের আধ্যাত্মিকতাকে সুবিধাবাদের বাইরে চিন্তা করতে পারেন না, তারা বুঝতে অক্ষম যে, ফ্যাসিবাদ কেবল একটা সরকার-পদ্ধতিই নয়, চিন্তার ধরনও বটে। তিনি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নাকচ করে দেন এভাবে যে, ‘সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের সংখ্যাধিক্যে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র যা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে তেমন গণতন্ত্রের চেয়ে সেই গণতন্ত্রে তারা বিশ্বাস করেন, সংখ্যার তুলনায় জাতির প্রকৃত গুণকে প্রাধান্য দিয়ে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পারস্পরিক দোষারোপে গণতন্ত্র দেশকে পিছিয়ে দেয়, পক্ষান্তরে ফ্যাসিবাদ দ্রুত এগিয়ে চলে বলে দাবি তার।

বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় এসে দেশকে পিছিয়ে দেবে, এমন কারণ দেখিয়ে নিরপেক্ষ ভোটের তুলনায় বর্তমান সরকারেরই ক্ষমতায় থাকা শ্রেয়তর বলে বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান এখন দেশে চলমান আছে। সুসংগঠিত, কেন্দ্রীভূত এবং কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রই হলো ফ্যাসিজম, এমন হাস্যকর বুদ্ধিবৃত্তিক অপবয়ানও দেশে নিয়তই প্রতিধ্বনিত হয়।

শাসন ক্ষমতার পরিবর্তনের পথ খোলা আছে বলে দাবি করেন মুসোলিনি এবং বলেন, এতে তারা ভীতও নন। শাসনক্ষমতা যদি পরিবর্তন হয়েও যায়, সে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অধিকার কেবল তাদেরই। কারণ তারাই কেবল জয়ের পথ বাতলে দেয়ার নেতৃত্ব দিতে পারেন।

‘তিনিই পারেন, তিনিই পারবেন’ এমন বয়ান রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনকে পরোক্ষভাবে নাকচ করে দেয়। আমাদের সরকার শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে চান না, আদতে আগের রাতে ভোট হয়ে গেলে ভোটাররা ভোট দিতেই যাননি।

রাষ্ট্রীয় মদদে একটি উগ্র জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার প্রয়াস ফ্যাসিবাদের অভ্যন্তরে লুকায়িত আছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে রাষ্ট্র অপরাধে উৎসাহিত করছে। খুন ও ধর্ষণকে, ফ্যাসিবাদী পুরুষোচিত আচরণ হিসেবে দেখছে রাষ্ট্র। এমন পুরুষরাই ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়ে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রাখতে দেখা গেছে।

গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও উদার নীতিবাদের ছায়াতলে টিকে থাকা ভালো গুণগুলোর নির্যাসে ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠেছে বলে দাবি মুসোলিনির। সে জন্য ফরাসি উদারনৈতিক চিন্তক রঁম্যারঁলা বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের মুখোশ একটি নয়, বহু। এর অঙ্গে সামরিক বেশ ও পরনে ধর্মযাজকের পোশাক। এটা কখনো পুঁজিবাদী, আবার কখনো সমাজতন্ত্রী। কিন্তু যে মুখোশই এর মধ্যে থাকুক না কেন, এটা উগ্র জাতীয়তাবাদী। এটা সব কিছুকে জাতির সাথে একীভূত করে জাতিকে একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রাধান্য স্বীকারে বাধ্য করে, যাতে সবকিছু সে শৃঙ্খলিত করতে পারে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে সবকিছুকে একীভূত করে। সেজন্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় রাষ্ট্র কোনোরকম ফাঁক রাখেনি। রাষ্ট্রকে উঁচু করার অর্থে ফ্যাসিবাদ সরকারকে উঁচুতে তুলে ধরে। ফ্যাসিবাদ প্রতিনিয়ত জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির কথা বলে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। উগ্রপন্থার আক্রমণের মতো নানা কল্পকাহিনী তৈরি করে আমলাতন্ত্র ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। সব মানুষকে ফ্যাসিস্ট দলে নাম লিখিয়েছিলেন মুসোলিনি। যেমনটা এ দেশেও ঘটেছিল। ফ্যাসিস্ট দলে নাম না লেখালে কারো চাকরি হতো না এবং বহু মানুষকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল নাম না লেখানোতে। সংবাদপত্রগুলোকে বাধ্য করা হয়েছিল ফ্যাসিস্টদের গুণকীর্তন করতে। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার তকমা লাগিয়ে গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যা করা হতো।

১৯৩৪ সালে বামপন্থী রাজনীতিবিদ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপ ঘুরে এসে ‘ফ্যাসিজম’ নামক বই লিখে শতাব্দীর অশনিসঙ্কেত দিয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জিও দিমিত্রভ তার থিসিসে বলেন, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, লগ্নিপুঁজির প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব। মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার ল্যাকুয়ার তার ‘ফ্যাসিজম; পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার’ বইয়ে বলেছেন, ‘একটি বৈশিষ্ট্য ফ্যাসিবাদকে অতীতের সব স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা থেকে আলাদা করেছে। ফ্যাসিবাদী শাসনে একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকে আর এই দলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের মাধ্যমে একচেটিয়া ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। এটা করতে গিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে বিরোধী পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই ধরনের দলের নেতৃত্বে এমন একজন নেতা বা নেত্রী থাকেন যিনি দৃশ্যত সীমাহীন ক্ষমতাবান। তাকে তার অনুসারীরা দেব-দেবীর মতোই পূজা-অর্চনায় সিক্ত রাখে। তাদের এই আনুগত্য প্রায় ধর্মীয় ভক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এই রাজনৈতিক দলটি শুধু তাদের নিজেদের জন্যই নয় বরং তাদের মতাদর্শিক বিশ্বাসকে বাকি সব নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করে তোলে। একটি শক্তিশালী প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে এই মতাদর্শিক বিশ্বাসকে তারা প্রতিনিয়ত প্রচার করতে থাকে।’



  • লেখক   সাবেক যুগ্মসম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল 

স্মৃতির মণিকোঠায় শফিউল বারী বাবু

-------------------------------

মো: হারুন-অর-রশিদ

-------------------------------


তিনি মরে গিয়েও প্রমাণ করলেন মরেন নাই। লাখ লাখ নেতাকর্মীর অশ্রু আর শোকের মাতমই প্রমাণ করেছে, তিনি মরে গেছেন কিন্তু বেঁচে আছেন তাদের হৃদয়ে। তিনি আর কেউ নন, শফিউল বারী বাবু। মানুষ মরণশীল। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবধারিত। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আল ইমরানের ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘কুল্লুনাফসিন জাইকাতুল মাউত’। কিন্তু কিছু মৃত্যু আছে যা দেহের প্রস্থান হয় মাত্র, তবে তার কর্ম তাকে চিরজীবনের জন্য মানুষের হৃদয়ে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে অনন্তকাল। শফিউল বারী বাবু তেমন একটি নাম। মাত্র ৫১ বছর বয়সে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কাঁদিয়ে গত ২৮ জুলাই ভোর ৪টায় জাতীয়তাবাদী আদর্শের এই অগ্রসৈনিক না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার মৃত্যুতে তার নিজ হাতে তৈরি করা হাজার হাজার নেতাকর্মী শোকে মুহ্যমান।


জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর

আদর্শের রাজনীতিতে আপসহীন, অত্যন্ত সাহসী এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অধিকারী এই নেতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন সেরা সংগঠকদের অন্যতম। ছাত্ররাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে সাংগঠনিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতা, দৃঢ়তা ও আপসহীনতা তাকে রাজনৈতিক প্যারামিটারের এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। সব স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার ছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদী ভূমিকা। বিশেষ করে এক-এগারোর সময়ে ফখরুদ্দীন, মইনউদ্দীনের অবৈধ মাইনাস রাজনীতির বিরুদ্ধে তার সাহসি ভূমিকা ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে একটি আলাদা অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। সর্বদায় দুই ঠোঁটের মাঝখানে হাসির রেখা ফুটিয়ে মৃদুভাষী শফিউল বারী বাবু নেতাকর্মীদের কথাই শুনতেন। সিদ্ধান্তের বেলায় বুঝা যেত, তিনি কত বড় মাপের সংগঠক ছিলেন। তার মেধা ও বিচক্ষণতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাই তাকে একজন সত্যিকারের রাজনৈতিক সংগঠকে পরিণত করেছিল। তিনি কর্মীদের কাছে এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘তার সব সদস্যই তার জন্য বুলেটের বিপরীতে বুক পেতে দিতে কুণ্ঠাবোধ করত না।’

আমার সাথে এই মহান নেতার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনের প্রাক্কালে। তিনি ওই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। আমি তার হলের (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমান হল) ছাত্র। এই কারণে আমাকে অনেক বেশি আদর করতেন এবং ওই নির্বাচনে আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও দিয়েছিলেন। তখন থেকেই যখন দেখা হতো সালাম বিনিময় করলেই তার জবাব দিয়ে কেমন আছিস জিজ্ঞেস করতেন। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপিত ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাত সদস্যের কমিটি ঘোষণা করলে আমি স্বেচ্ছাসেবক দল করতে আগ্রহী হই। সাইফুল ইসলাম ফিরোজ ভাই (সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) এই কমিটিতে থাকায় আরো বেশি আগ্রহী হই। যদিও আমাকে জাসাসের দফতর সম্পাদক করার ছিল। ফিরোজ ভাইকে বলার পর তিনি বাবু ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। স্বেচ্ছাসেবক দল করব শোনে বাবু ভাই খুব খুশি হলেন। কিছু দিন পরই দফতরে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দিলেন। দফতরে কাজ করার সুবাদে ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। আমি লেখালেখি করি এটা তিনি খুব পছন্দ করতেন। মাঝে মধ্যে কিছু উপদেশও দিতেন।

দফতরে দায়িত্বপালনরত অবস্থায় ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হই।

মঙ্গলবার, মার্চ ৬, ২০১৮, জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখ থেকে গ্রেপ্তার হন শফিউল বারী বাবু


কারাগারে গিয়ে প্রিয় নেতা আবদুুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, ইয়াছিন আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর সাক্ষাৎ পাই। ৬ মার্চ মিন্টুরোডস্থ ডিবি অফিসে তৃতীয়বারের মতো রিমান্ডে গেলে শুনতে পাই বাবু ভাই গ্রেফতার হয়েছেন। সংবাদটা শুনেই বুকের মধ্যে একটা চাপ সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মিছিলে ম্যাডামের মুক্তি চেয়ে ‘আমার নেত্রী আমার মা বন্দী থাকতে পারে না’ রাজপথে এই স্লোগান দেয়ার আর কেউ থাকল না। যাই হোক তাকেও ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হলো। তিন দিন রিমান্ড খাটার পর একই দিনে আলাদা আলাদা পুলিশ প্রিজন ভ্যানে করে কোর্টে নেয়া হলো। কোর্ট থেকে সোজা কারাগারে। তারপর কারাগারে প্রতিদিনের কত স্মৃতি চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে।

প্রতিদিন সকাল-বিকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীদের আবাসস্থল যমুনা থেকে সূর্যমুখীতে ছুটে যেতাম ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য। গেলেই বিস্কুট, ফল খেতে দিতেন। সুবিধা-অসুবিধা জিজ্ঞেস করতেন। সেখানেও আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জেলের মধ্যে কারা কারা কষ্টে আছে তাদের লিস্ট করার জন্য। কারা আইনের সুবিধা পাচ্ছে না, জামিন হচ্ছে না, টাকার অভাবে উকিল নিয়োগ দিতে পারছে না, কার বাসায় খাবার নেই, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দিতে পারছে না তাদের লিস্ট করে দিলে তিনি সব রকম ব্যবস্থা করতেন। একজন নেতার এমন মহানুভবতায় জেলখানার সব শ্রেণীর বন্দীর মুখে শফিউল বারী বাবু নামটি মানবদরদি নেতা হিসেবে উচ্চারিত হয়। জেলখানায় অনেক নেতা ছিলেন, কেউ কারো খোঁজও রাখতেন না। আমি জেলখানায় গিয়েই সবার মুখে আবদুুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের ব্যাপক প্রশংসা শুনতে পাই। তিনি চলে আসার পর বাবু ভাই জেলে যান। কর্মীর প্রতি একজন নেতার কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকতে পারে তা শফিউল বারী বাবুকে জেলখানায় নিজ চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

অনেক জনদরদি নেতার নাম শুনেছি, তাদের জীবনী পড়েছি। কিন্তু শফিউল বারী এক ও অনন্য। মধ্যবয়সী একজন নেতা কী করে সব শ্রেণীর নেতাকর্মীর এত ভালোবাসা অর্জন করতে পারেন তা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে।

সেবার ব্রত নিয়েই রাজনীতির হাতেখড়ি বাবুর। দেশ ও জনগণের পক্ষে আজীবন কাজ করে যাওয়া শফিউল বারী বাবু ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালে শহীদ জিয়া প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী আদর্শ বুকে ধারণ করে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর তার রাজনৈতিক গুণের জ্যোতির্ময় আলো সারা দেশের হাজার হাজার ছাত্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদেরকে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হন। একজন শফিউল বারীর রাজনৈতিক গুণাবলি লিখে শেষ করা যাবে না।

আমরা যারা একসাথে জেলখানায় ছিলাম, তাদের মধ্যে কাজী ইফতেখায়রুজ্জামান শিমুল, আব্দুর রহিম হাওলাদার সেতু, করিম সরকার, এইচ এম রাশেদ, আলমগীর, মামুন, মোর্শেদ, রমিজ ও আমি নিজেসহ অনেকের সাথে প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। মামুন, আলমগীর, রমিজ এবং আমাকে কাশিমপুর কারাগারে চালান করে দেয়ার জন্য নিয়ে গেলে বাবু ভাই নিজে জেলগেটে গিয়ে চালান ঠেকিয়ে ছিলেন। তারপর সবাই আমাকে বলেছিলেন, বাবু ভাই, কারো জন্য এতটা উদ্বিগ্ন হননি যতটা আপনার জন্য হয়েছিলেন। এই ঋণ কোনো কিছুর বিনিময়েই শোধ করতে পারব না। আমার লেখা একটি বই তাকে দেয়ার জন্য বাসায় গেলে তিনি সেটি হাতে নিয়ে ছবি তোলার জন্য সাহাবউদ্দিন সাবুকে বললেন এবং ছবি ভালো তুলতে না পারায় সাবুকে বকা দিয়েছিলেন। এই স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা খুব সহজ হবে না।

বাবু ভাই তার স্ত্রী বিথিকা বিনতে হুসাইনকেও মানবতার কল্যাণে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। ‘অর্পণ বাংলাদেশ’ নামে সেবা সংগঠনের মাধ্যমে শত শত দুস্থ, অসহায় মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। এমন একজন নেতাকে হারিয়ে আমরা বাকরুদ্ধ। তার রেখে যাওয়া দু’টি মাসুম সন্তানের জন্য এবং তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনাই প্রতিটি নেতাকর্মীর ব্রত হওয়া উচিত। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতের উচ্চ স্থান দান করে।


Wednesday, April 28, 2021

নিরাপদ সড়ক আইন স্রেফ এক ‘প্রতারণা’!

রুমিন ফারহানা

মেয়েটার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ব্যাংকে। সেখানেই কাজ করে সে। বয়স ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে হবে; দেখতে গড়পড়তা বাঙালি মেয়ে যেমন হয়। আমার অ্যাকাউন্ট সে দেখাশোনা করতো বলে তার সঙ্গে সম্পর্কটা কেবল কাজের মধ্যেই আটকে থাকেনি। আলাপে আলাপে একসময় মেলে ধরেছিল তার জীবনের কথা। পরিবারটি ছোট, বাবা-মা এক ভাই আর সে। বাবা অসুস্থ, মারও বয়স হয়েছে, একমাত্র ভাইটি বিছানায়। উপার্জনশীল ব্যক্তি বলতে সে একা। সুতরাং পরিবারকে টিকিয়ে রাখার বাইরে নিজের জীবন নিয়ে তার আর কোনও পরিকল্পনা নেই। প্রথমবার যখন পরিবারের কথা বলছিল মেয়েটি, বারবার আটকে আসছিল গলা, চোখে পানি। ভাইটি ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ভালো গান গাইতো, ছবি আঁকতো, ক্রিকেট খেলতো। একটা সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গত কয়েক বছর ধরে শয্যাশায়ী। এখন হুইল চেয়ার আর বিছানায় তার জীবন বন্দি। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছর হলো। সংসারের পুরো ভার এখন মেয়েটির ওপরে। 

একটা সড়ক দুর্ঘটনা কেবল একটি ব্যক্তি নয়, আঘাত হানে পুরো পরিবারের ওপর। মেয়েটি তো তবু নিজেকে ভুলে হলেও টিকিয়ে রাখতে পেরেছে পরিবারটিকে, কিন্তু এমন দুর্ঘটনার পরে বহু পরিবার স্রেফ পথে বসে যায়। হাল ধরার মতো একটা মানুষও থাকে না। 

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে একেবারে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ জানায়, ২০১৯ সালে মোট চার হাজার দুইটি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ২২৭ জন নিহত ও ছয় হাজার ৯৫৩ জন আহত হয়েছিলেন। আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, ২০১৯ সালে দেশে পাঁচ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত হয়েছে। তবে উভয় সংগঠনের মতেই আগের বছরের চাইতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি আর নিরাপদ সড়ক চাই’র মতে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে প্রাণহানি বেড়েছে যথাক্রমে ৮.০৭ এবং ১৭.৭৫ শতাংশ। 

নিশ্চিতভাবেই ২০২০ সালেও এই ঊর্ধ্বমুখী ধারা বলবৎ থাকতো, কিন্তু সেটা কিছুটা কম দেখাচ্ছে  করোনার কারণে। লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধসহ নানান কারণে মানুষের চলাচল ছিল অতি সীমিত। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ৬৮৬ জন।  আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬০০ জন। আর নিরাপদ সড়ক চাই’র মতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৯৬৯ জন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৫ হাজার ৮৫ জন। গত বছরের এক- চতুর্থাংশ সময় করোনার কারণে সারা দেশে ‘সাধারণ ছুটি’র কারণে মালবাহী গাড়ি ছাড়া দূরপাল্লার যানবাহন প্রায় চলেইনি। অর্থাৎ গত বছরের মৃত্যুর সংখ্যা মূলত নয় মাস বা তারও কম সময়ের পরিসংখ্যান। 

বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিসংখ্যান একটা ভগ্নাংশই জানায় আমাদের। আলোচিত সংস্থা দুটি পত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই তথ্য পেয়ে থাকে। এসব রিপোর্টের প্রধান সমস্যা হলো, এতে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত মানুষের সংখ্যা জানা যায়; জানা যায় না মারাত্মক আহত মানুষ যারা দুর্ঘটনায় কয়েকদিন পরে মারা যান। এ কারণেই দেখা যায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন মারা গেছে। সরকারি–বেসরকারি ও নিজস্ব সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা এত বেশি। 

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা জানলেও আমরা জানতে পারি না, খোঁজ রাখি না আহতের কথা। আহতদের মধ্যে যারা মারা যায়নি তাদের একটা অংশ পুরো সুস্থ হয়ে ওঠে। আর তাতে তাদের চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য পরিবারকে কতটা চাপের মধ্যে পড়তে হয় সেই পরিসংখ্যানও আমরা জানি না। আমরা জানি না মারাত্মক আহতদের মধ্যে কত মানুষ আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে নিজের এবং পরিবারের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, যেমন আমি শুরুতেই আমার ব্যক্তিগত পরিচিতার পরিবারের কথা বলছিলাম। 


জুলাই ২৯, ২০১৮, বাসচাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম, ১৬ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব, ১৭ 


বহু মানুষের দুর্বিষহ আহত পঙ্গু জীবন, মৃত্যু আর হাহাকারের পরও সড়কে নিরাপত্তা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছিল সরকার। এরমধ্যেই ঘটে সেই বীভৎস দুর্ঘটনা। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত ও দশ শিক্ষার্থী আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় পুরো দেশ। স্কুল-কলেজে পড়া শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা, এই লক্ষ্যে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ, আইন ভঙ্গকারী চালকদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন, মিছিল, রাস্তা অবরোধ, গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের দাবির মুখেই সরকার পাস করতে বাধ্য হয় ‘নিরাপদ সড়ক আইন, ২০১৮’।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আইনটি পাস হলেও সেটি কার্যকর করা হয় পরের বছর পহেলা নভেম্বর থেকে। কিন্তু তখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও কর্মবিরতির মুখে সরকার চারটি ক্ষেত্রে আইনটির প্রয়োগ ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বন্ধ রাখে। পরে সেই বন্ধ থাকার মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ফলে আইনটি আংশিকভাবে কার্যকর হলেও এখন পর্যন্ত প্রধান কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ আটকে রয়েছে। আইনের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা – সংসদে পাস করা একটা আইনের কিছু ধারা অকার্যকর থাকছে সংসদে আইনের কোনও সংশোধন ছাড়াই। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখে সরকারের টালবাহানা আমাদের কাছে নিশ্চিত পূর্বাভাস দিয়েছিল এই আইন নিয়ে আখেরে কী ঘটতে যাচ্ছে। ঘটেছেও তাই।

এ আইনটি এখন সংশোধন করার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। শাস্তির আওতা কমানো, শাস্তি কমানো, চালক হবার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অন্যান্য যোগ্যতা শিথিল করা, গাড়ির আকার পরিবর্তন করার অনুমতি দিয়ে মালিক-শ্রমিক পক্ষের প্রায় সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। যে মালিক পক্ষ আর শ্রমিক পক্ষের মূল নেতা সংসদ সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দল এবং ‘সরকারি’ বিরোধী দলের অতি প্রভাবশালী নেতা তাদের স্বার্থ রক্ষা না করে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা হবে, বর্তমান বাংলাদেশকে ন্যূনতম চিনলে এমন প্রত্যাশা কেউ করবেন না। 

বাংলাদেশে আইন থাকা মানে সেটার সুষ্ঠু প্রয়োগ হবে সেটা নয় কোনোভাবেই। এই দেশে আইন তার নিজের গতিতে চলে না। একটা মোটামুটি কঠোর আইন থাকলেও অতি ক্ষমতাশালী মালিক-শ্রমিক সমিতিগুলোর প্রভাবে খুব কঠোরভাবে প্রযুক্ত হবে এমন আশা এই দেশবাসী করে না। তবে এমন একটা আইনের একটা প্রতীকী মূল্য আছে, এতে বোঝা যেত – এই রাষ্ট্র সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, পঙ্গুত্ব এবং মানুষের শারীরিক, আর্থিক ভোগান্তিকে আমলে নিয়েছে। আইনের শাস্তির ভয় এক ধরনের রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সতর্ক করতে পারতো যেটা দুর্ঘটনার পরিস্থিতিকে কিছুটা হলেও ভালো করতে পারতো। কিন্তু সেই আই ওয়াশটাও মালিক-শ্রমিক-সরকার জোট মানতে রাজি না।   

নিরাপদ সড়ক আইন কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, বেপরোয়া চালকদের নিয়ন্ত্রণ করা এর কোনোটাই সরকারের উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল যেকোনোভাবে আন্দোলন ধামাচাপা দেওয়া। ২০১৮ সালে এই দেশের কিশোর-কিশোরীরা একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল, তারা রাস্তায় নিরাপত্তা চেয়েছিল। সবকিছুর পরে তখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল তাদের এই ত্যাগ স্বীকার সফল হয়েছে। কিন্তু আইনটি নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে একটা শব্দই মনে আসে – ‘প্রতারণা’।



লেখক  আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।  সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ


Monday, April 26, 2021

দুঃসময়ে খুব দরকার ছিল মওদুদ আহমদকে

— মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর



কয়েক দিন আগে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সহধর্মিণী বেগম হাসনা মওদুদ আমাকে তাঁর গুলশানের ফ্ল্যাটে ডেকেছিলেন। হাসনা মওদুদের আরেকটি পরিচয় তিনি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের মেয়ে। এ ছাড়াও তার নিজস্ব পরিচয় বেশ উল্লেখ করার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ পাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন।

এ ছাড়াও তিনি জাতিসংঘে কাজ করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাসনা মওদুদ এখন বড় একা, দুই ছেলে হারিয়েছেন অনেক আগেই। মেয়ে থাকেন নরওয়েতে স্বামী-সন্তানসহ। এই নিঃসঙ্গ জীবনে ব্যারিস্টার মওদুদের স্মৃতিই তাঁর সঙ্গী। হাসনা মওদুদ আমাকে ডেকেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদের লাইব্রেরি দেখার জন্য এবং সেই সঙ্গে তাঁর অপ্রকাশিত বইয়ের বিষয়ে কথা বলার জন্য।

লাইব্রেরি দেখে আমার মনে হলো একজন শীর্ষ আইনজীবী, বরেণ্য রাজনীতিবিদ এবং উঁচুমানের লেখক ছাড়াও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ একজন পাঠক এবং গবেষক। তাঁর লিখিত সব কয়টা বই সে প্রমাণ বহন করে। ব্যারিস্টার মওদুদের জীবনী এত বেশি বর্ণাঢ্য যে, স্বল্প পরিসরে তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। আমি লেখক নই। যেটুকু অভ্যাস ছিল, রাজনীতির ডামাডোলে তাও নিঃশেষ প্রায়। ব্যারিস্টার মওদুদ এই দেশের রাজনীতিতে একজন কিংবদন্তির পুরুষ এ কথা বললে অনেকে ভ্রু কুঁচকালেও এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েই বাংলাদেশে রাজনীতি করেছেন। আমার কাছে মনে হয় তিনি আপাদমস্তক একজন উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রাজনীতির বিভিন্ন বাঁকে তাঁর অবদান রেখেছেন। ছাত্রজীবনে স্কুল থেকেই রাজনৈতিক সচেতন এক কিশোর বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যে আইন পড়ার সময় থেকে দেশের স্বাধিকারের জন্য, পরবর্তীতে স্বাধীনতার জন্য, মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি কাজ করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁর ভূমিকা, অবদান এবং স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা, নিঃসন্দেহে ইতিহাসের অংশ হিসেবে থাকবে। ১৯৭২-এর পরে তৎকালীন সরকারের গণবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান গ্রহণ এবং ভুক্তভোগীদের পক্ষে আইনি সহায়তা নিয়ে অবস্থান গ্রহণ তাঁর সেই পরিচয়কেই স্পষ্ট করে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তিনি হয়তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন, সে জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিতর্কিত হলেও সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে তিনি সব সময়ই ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে কর্তৃত্ববাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। বহুবার সামরিক শাসনের ফলে নির্যাতিত হয়েছেন এবং জীবনের শেষ দিকে ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে অসংখ্য মামলার শিকার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন এবং নিজের বসতবাড়ি পর্যন্ত হারিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন নিখাদ আলোকিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ। তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় পরিমিত বক্তব্য প্রদানে। গণমাধ্যমের কর্মীদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন সেই কারণেই। ঠিক যতটুকু বলার দরকার যা গণমাধ্যমের গ্রহণীয় হবে তিনি সেটুকু বলতেন। আইনমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রণীত বেশ কিছু আইন বিচারব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করেছে। উঁচুমাপের লেখক হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত এবং সমাদৃত। তাঁর বেশ কয়েকটি বই বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপরে লিখিত বইগুলো বিদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাঁর শিক্ষা, জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি একটি গণতান্ত্রিক সমাজকে হয়তো অনেক বেশি সমৃদ্ধ করত, বর্তমানের এই কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচার এবং একনায়কতন্ত্রের অন্ধকার সমাজে তাঁর চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে অনেক শূন্যতার সৃষ্টি করল। এই দুঃসময়ে তাঁর খুবই দরকার ছিল। । ব্যক্তিগতভাবে ব্যারিস্টার মওদুদের কাছে আমি অনেক ঋণী।

তিনি বর্তমানের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন অভিভাবকের মতো, উপকৃত হয়েছি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এবং পথনির্দেশনায়। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় উন্নত চিকিৎসায় সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগে অসুস্থ হয়ে যখন এভারকেয়ার হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমিসহ অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। অত্যন্ত অসুস্থ, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তখনো বললেন “এবার আর স্টান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে হয়তো থাকতে পারব না, ইনশা আল্লাহু পরের শনিবার থাকব। ” ব্যারিস্টার মওদুদের পরের মিটিং-এ উপস্থিত থাকা হয়নি। আর কোনো মিটিং থাকবেন না। থাকবেন আমাদের হৃদয়ে আমাদের অন্তরে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে, লাখো মানুষের আন্দোলনে। । ভাবী বাসায় বলছিলেন, “উন্নত চিকিৎসা চেয়েছিল মওদুদ। চেষ্টা করেছি, এই করোনাকালে কোয়ারেন্টাইনের মধ্যেও নিয়ে গেছি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। জীবিত ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।   আপনারা তাঁকে মনে রাখার চেষ্টা করবেন।” 

আমি উত্তরে বলেছিলাম, 

উনি জীবিত থাকবেন তাঁর এলাকায় মানুষের হৃদয়ে, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে, সংগ্রামে, আন্দোলনের ইতিহাসে।




লেখক মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি

Thursday, April 22, 2021

এদেশের মাটিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের কবর হবে তো?

— ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা

গত ১১ই এপ্রিল একটি অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ শিরোনাম হল প্রতিটি গণমাধ্যমের। সংবাদটি যতটা দুঃখজনক, ঠিক ততটাই ভীতিকর – করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৭৪ বছর বয়সী তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যে কেবল সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী কিংবা বিএনপির মতো বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান তাই নন, তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা, দৃঢ়চেতা আপসহীন মনোভাব, ঋজু, প্রখর ব্যক্তিত্বের কারণে দলের বাইরেও আপামর জনসাধারনের হৃদয়ে তাঁর একটা বিশেষ জায়গা আছে। স্বাভাবিকভাবেই করোনার এই দ্বিতীয় ধাক্কায় যখন চারপাশে কেবল বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা তখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এই খবরটি নিঃসন্দেহে দেশে এবং দেশের বাইরে থাকা কোটি মানুষের হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মানুষ নীরবে চোখের পানি ফেলেছে, স্রষ্টার দরবারে প্রিয় নেতার রোগমুক্তির প্রার্থনা জানিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া


বাংলাদেশের ৫০ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে তিনি কেবল প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীই নন বরং তিনি এমন এক নেতা যিনি কোনও দিন কোনও নির্বাচনে কোনও আসন থেকে পরাজিত হননি। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে আছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়, বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে তাঁর নাম অমোচনীয় কালিতে খচিত হয়ে আছে। আর তাই বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ প্রার্থনায় নত হয়েছে তার এই খবর শুনে।

এর মধ্যে গত ১৮ই এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে চমকে উঠেছি আমি, চমকে উঠেছে দেশের মানুষ। করোনা আক্রান্ত খালেদা জিয়ার জন্য গত ১২ এপ্রিল বাদ আসর সোনামিয়া মেস্তরি বাড়ির দরজা জামে মসজিদে দোয়ার আয়োজন করেন ফেনী সদর উপজেলার পশ্চিম ফাজিলপুর ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদ। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন মসজিদের ইমাম মেরাজুল ইসলাম। স্থানীয়রা বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে মসজিদ কমিটির সভাপতি নুরুল আফসার এ বিষয়ে হুজুরকে কৈফিয়ত তলব করেন। কৈফিয়তের সঠিক জবাব দিতে না পারায় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।



বাংলাদেশে যখন নির্বাচন হতো সে সময়ের কথা বলছি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেই নির্বাচনগুলোতে সকল আসন থেকে জয়লাভ করলেও সবসময়ই নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন ফেনী। আর তাই তাঁর নিজ এলাকা ফেনীতে তাঁর জন্য দোয়া আলাদা গুরুত্ব বহন করে। তাঁর এই গভীর সঙ্কটে তাঁর নিজ এলাকায় দোয়া না হওয়াটাই তো ভীষণ অস্বাভাবিক। শুধু তাই না, একজন অসুস্থ মানুষের জন্য, তিনি যেই হোন না কেন, যে কেউ যে কোনও সময় তাঁর জন্য দোয়া করতে পারেন। এখানেও যখন রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হয় এবং দোয়া করবার অপরাধে ইমাম চাকুরিচ্যুত হন, তখন আমরা আবারও দেখতে পাই গত এক যুগে এই রাষ্ট্রটির মূল কাঠামটিকে কীভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই রাষ্ট্রের সংবিধান এবং আইন এই নিশ্চয়তা দেয় যে নাগরিকদের মধ্যে যে কোনও পরিচয়ের কারণে বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না। রাষ্ট্র কিংবা একজন নাগরিক ওপর নাগরিকের প্রতি তাঁর কোনও পরিচয়ের কারণে সেটা করলে তা হবে স্পষ্ট সংবিধান লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এই দেশে বহুকাল থেকেই এসব কেবল কথার কথা।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়লো দু’টি ঘটনার কথা। তথাকথিত কঠোর/সর্বাত্মক লকডাউনে ঢাকার রাস্তায় চিকিৎসকের সাথে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট এর তীব্র বাদানুবাদের ঘটনাটি এখনো ভীষনভাবে আলোচনায় আছে। একজন নাগরিক স্রেফ একজন নাগরিক হিসাবে তাঁর সাংবিধানিক, আইনগত অধিকার ভোগ করবেন। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা (সংবিধানের ভাষায় ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’) তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন শুধুমাত্র তাঁর প্রশাসনিক পরিচয়ে। কিন্তু একজন উচ্চ শিক্ষিত নাগরিক এবং প্রজাতন্ত্রের দুইজন ক্ষমতাশালী কর্মচারী এসব থেকে সরে গিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ পরিচয়কে বড় করে তুললেন। কারণ তারা খুব ভালভাবেই জানেন এই রাষ্ট্র এখন আর সাধারণ নাগরিকদের জন্য নয়; শুধু ক্ষমতার বলয়ে থাকা একটি বিশেষ গোত্রের মানুষের।


পটুয়াখালী জেলা শহরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পটুয়াখালীবাসী’র ইফতার আয়োজন দেশের মানুষের প্রশংসায় ভেসেছিল। পটুয়াখালী জেলা শহরের সার্কিট হাউজ থেকে সোনালী ব্যাংক মোড় পর্যন্ত সড়কটি ইফতারের আগে সাজানো থাকে সারি সারি প্যাকেট ও পানির বোতলে। এগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাশেই রাখা থাকে একটি ছোট ব্যাগ। রোজার শুরু থেকে প্রতিদিন ইফতারের আগে এ দৃশ্য দেখা যায় সড়কটিতে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া রোজাদাররা যে যার মতো করে একটি প্যাকেট নিয়ে চলে যান। ইতোমধ্যে এই দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদিন না যেতেই খবর এলো ইফতার দানকারী সংগঠনটির আহ্বায়ক মাহমুদুল হাসান রায়হান মারধরের শিকার হয়েছেন। তিনি জানান, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি কাজী আলমগীর ও চার-পাঁচটি মোটরসাইকেলে করে তার সহযোগীরা তার ওপর এ হামলা চালান। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাকে তিনি বলেন, "প্রথমে তারা এসে বলে যে তুই কী হয়ে গেছস? তোকে ফান্ড দেয় কে? তোমরা  প্রোগ্রাম করো আমাদের জানাইছ?" "আমি ইফতারের আয়োজন করি বলে জানালে, তারা আমাকে প্রোগ্রাম করতে নিষেধ করে চলে যায়", বলেন রায়হান। "এর পাঁচ মিনিট পর তারা আবার ঘুরে আসে। এসে কোনো কথা ছাড়াই মারধর শুরু করে। লাঠিসোটা ছিল না। হাত দিয়েই মারে। শুধু আমাকেই মারে", যোগ করেন তিনি।

দেশের একজন সাধারণ নাগরিক এমন একটি আয়োজন করে বাহবা নেবে ক্ষমতাসীন দলকে পাশ কাটিয়ে কিংবা তাদের সাথে আলোচনা করে অনুমতি না নিয়ে, সেটা এই দেশে হবার নয়, সেটা না জানার কিংবা ভুলে যাবার মাশুল দিলেন রায়হান। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যই প্রকাশিত করে এই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি। ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত না থাকলে তাকে মার খেতে হবে এবং তার আগে শুনতে হবে অনিবার্য প্রশ্ন – ‘তুই কী হয়ে গেছস?’

গত এক যুগের একটির পর একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, বিরোধী দল মত দমন, সকল সাংবিধানিক আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে সর্বত্র দলীয়করন, সেপারেশন অব পাওয়ারের নূন্যতম বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট না রাখা এই রাষ্ট্রের মূল কাঠামোটিকে ভেঙে ফেলেছে। বর্তমান বাংলাদেশকে দেখলে মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যের বেশি কিছু আর মনে হয় না।

আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশে ক্রমাগত চাষ হয়েছে তীব্র বিভেদ আর ঘৃণার। এখানে একটি দল সরকার, রাষ্ট্র সবকিছুকে পরস্পরের মধ্যে বিলীন করে ফেলেছে। এমন রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলের বাইরের ‘নিরপেক্ষ’ নাগরিকই বঞ্চিত হয় তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে। আর কোনও নাগরিক যদি হয় সরকার বিরোধী, বিশেষ করে সরকারের অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে থাকা দলের রাজনৈতিক কর্মী তাহলে তাঁর কপালে থাকে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, হামলা-মামলার হয়রানি।

এমন একটা টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্রই হচ্ছে এটা ক্রমাগত আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠবে, উঠছেও। এই রাষ্ট্রের একজন অতি সন্মানিত সিনিয়র সিটিজেনের অসুস্থতার জন্য দোয়া করা এই রাষ্ট্রে এখন ইমামের জন্য অপরাধ; চাকুরিচ্যুতি হয় তাঁর। এতেই শেষ হবে এই বীভৎসতা? ইতিহাস বলে হবে না, আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে ক্ষমতাসীন দলটি। শুধুমাত্র সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ দল বিএনপি করাটা অচিরেই হয়তো এত বড় অপরাধ হয়ে উঠবে যে এই ‘সাম্রাজ্যে’ কবর দিতে বাধা দেয়া হবে পরলোকগত বিএনপি নেতা-কর্মীদের মরদেহ।





লেখক — জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী।

Thursday, April 15, 2021

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও একজন জিয়াউর রহমান

 ড. খন্দকার মারুফ হোসেন 



২৬ মার্চ থেকে আমরা বছরব্যাপি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের শুভক্ষণে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি- মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং নাম জানা অজানা লাখো শহীদকে।


তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আশা করেছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে তার ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। অত্যন্ত দূঃখজনক হলেও সত্যি সেদিন তিনি তার ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তার ভাষণে স্বায়ত্বশাসনের দাবি ও জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ছিল। অনেকে দাবি করেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চই নাকি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যদি সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেই থাকেন তবে ১৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে আলোচনায় কিসের দর কষাকষি হয়েছিল। আমরা স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ৭ মার্চ পালন না করে ২৬ মার্চে পালন করি কেন? বাস্তবতা হচ্ছে, তখনও আওয়ামী লীগ চাচ্ছিলো পাকিস্তানে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি এবং আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা।


২৫ মার্চের ব্যর্থ আলোচনার পরে যখন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে চলে গেলেন, তখনও অনেকে আশা করেছিল শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। তাজউদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল আলম খানসহ তৎকালিন অনেক নেতা-ই শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন চারপাশে শোনা যাচ্ছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালির উপর হত্যাযজ্ঞের খবর। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও স্বাধীনতা ঘোষণা না করে সকলকে হতাশায় রেখে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। তার এই গ্রেফতারের পরে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের বেশিরভাগ নেতা সীমানা পাড়ি দিয়ে ভারতে পলায়ন করেন। তখন মুক্তিকামী বাঙালিদের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি হয়।


অপারেশন সার্চলাইটের পরে ২৫ মার্চ গভীর রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালিন মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তিকামী বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদ হিসাবে আভির্ভূত হন। মেজর জিয়াউর রহমানই প্রথম ব্যক্তি যিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি একটি ড্রামের উপর দাড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘We Revolt’, আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছি। তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালিন মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, লেফটেনেন্ট শমসের মবিন চৌধুরীসহ বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈন্যদের নিয়ে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানি কর্ণেল জানজুয়াকে গ্রেফতার করেন এবং নিজ হাতে তাকে পরাজিত করে বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে অস্ত্রাগার বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের জন্য খুলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি সেনা কর্মকর্তাগণ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।


২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে প্রথমে তিনি নিজ নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা বেতারের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ আবারও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালিন কর্ণেল জিয়াউর রহমানের লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি তার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে থাকা একটি জাপানি জাহাজে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। যা পরবর্তীতে রেডিও অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সংগৃহিত হয় এবং সারা বিশ্ব তা শুনতে পায়। এছাড়া আগরতলা থেকে মনিটরকৃত এ ঘোষণা ইন্ডিয়া নিউজ এজেন্সির মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।


বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত কিছু রেফারেন্স নিচে তুলে ধরা হলোঃ


ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দিল্লিতে দেয়া এক রাষ্ট্রীয় ভোজ সভায় বলেছিলেন “Mr. President, your position is already assured in the annals of the history of your country as a brave freedom fighter who was the first to declare the Independence of Bangladesh”, অর্থ্যাৎ “জনাব রাষ্ট্রপতি, আপনার অবস্থান ইতোমধ্যে দেশের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন”।


যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ২৯ মার্চ ১৯৭১ তারিখের দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় “Curfew eased by army in East Pakistan” শীর্ষক নিবন্ধনে বলা হয় “The Indian news agency reported that “Free Bangla Radio” has claimed that a provisional Bangla Desh Government had been set up by Major Jia Khan, commander of the “army”. He had appealed for diplomatic and for recognition and material aid.” অর্থ্যাৎ “ভারতীয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছে যে ”স্বাধীন বাংলা বেতার” দাবি করেছে সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জিয়া খান একটি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং সার্বিক সহায়তার জন্য আবেদন করেছেন।” এখানে মেজর জিয়াউর রহমানকে ‘মেজর জিয়া খান’ হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে।


মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ বীরউত্তম তার ‘Bangladesh at War’ শীর্ষক বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “মেজর জিয়া ২৫ মার্চ রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান”।


মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বইয়ের ৭৯ ও ৮০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এভাবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সাড়ে সাত/আটটা বাজে। এমন সময় ইথারে ভেসে এলো মেজর জিয়ার জলদ গম্ভীর কণ্ঠ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলছেন”।


তাজউদ্দিন আহমেদের রাজনৈতিক সচিব হোসেন তরফদার তার ‘মূলধারা ৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “২৭ শে মার্চ সন্ধ্যায় ৮-ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসাবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন”।


কলম্বিয়া ইউনির্ভাসিটি নিউজ লেটারে প্রকাশিত ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর প্রদত্ত বক্তব্যের একাংশে বলেছিলেন “The cry of Independence arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as I know, has not asked for Independence even now” অর্থ্যাৎ “শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পরই স্বাধীনতার দামামা শুরু হয়েছিল, তার আগে নয়। তিনি নিজেও, যতদূর আমি জানি, এখনও স্বাধীনতার দাবি করেন নি”।


ড. ওয়াজেদ মিয়া ২০০২ সালের ১৩ মার্চ তারিখে ‘দি নিউ নেশন’ পত্রিকায় প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “Bangabondhu neither declared independence or handed over any written document to anybody” অর্থ্যাৎ “বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণাও করেননি বা কারও হাতে কোনও লিখিত দলিল হস্তান্তর করেন নি।”


বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তার ‘স্বাধীনতা-৭১’ শীর্ষক বইয়ের ৪১৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “তার ঘোষণার শুরুটা ছিল এই রকম ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি”।


মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তার ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ শীর্ষক বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন “বেতার কেন্দ্র থেকে যারা মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তার প্রথম দিনের ভাষণে নিজেকে ‘হেড অফ দি স্টেট’ অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রপ্রধান রূপেই ঘোষণা করেছিলেন।”


ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন “রেডিও সেটে ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে ‘স্বাধীন বাংলা রেডিও’র ঘোষণা শুনিতে পাই। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিন দিশেহারা, হতভম্ব ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালী জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ”।


ভারতের সাংবাদিক জ্যোতি সেনগুপ্ত তার ‘হিস্টরি অফ ফ্রিডম মুভমেন্ট অফ বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন “মেজর জিয়া ও তার বাহিনী ২৬ মার্চ ভোর রাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং ওইদিন সন্ধ্যায় বেতারের মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন”।


বিখ্যাত লেখক ও কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছিলেন “২৭শে মার্চ শনিবার রাত আটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায় মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন – ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’ বলে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভিতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়।”


এছাড়া এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার বীর উত্তমসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বইয়েও পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে কেবলমাত্র জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথের সময় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসাবে ঘোষণা দিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দান করেন।


মেজর জিয়াউর রহমান শুধু স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে ১ নম্বর ও পরবর্তীতে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে গঠিত ‘জেড ফোর্স’ এর অধিনায়ক হিসাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট হানাদার মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের পরে জিয়াউর রহমানের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বচিত অবদানের জন্য তৎকালিন বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে।


১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। তৎকালিন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর দৃশ্যতো বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। বাংলাদেশের জনগণ হয়ে পড়ে দিশেহারা। ঠিক সে সময়ে সিপাহী-জনতা বিপ্লব ঘটিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি বা ক্ষমতা দখল করেন নি। ১৯৭৮ সালে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ৭২-৭৫ এর দুঃশাসনের কালিমা থেকে দেশকে উত্তরণ করেন।


আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী লাখো শহীদের রক্তে কেনা মহান স্বাধীনতার প্রধান চেতনা গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সকল পত্রিকা বন্ধ করে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ শুনতে হয়। জোরপূর্বক বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয় ৭২-৭৫ এ।


সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। তিনিই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ‘৭২ এর সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ছিল না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে আমাদের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সন্নিবেশিত করেন। ধর্ম নিরপেক্ষতার স্থানে মহান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং সকল ধর্মের সমান অধিকার প্রবর্তন করেন। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি নারী উন্নয়নের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও মহান স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রবর্তন করেন। শিশুদের মেধা বিকাশের জন্য শিশু পার্ক, শিশু একাডেমি, নতুন কুড়ি প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি প্রবর্তন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার তিনিই। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। দেশ যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে উন্নতির শিখরে যাচ্ছে, ঠিক তখনি জিয়াউর রহমানকে দেশি বিদেশী চক্রান্তে শাহাদাত বরণ করতে হয়।


শহীদ জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে শহীদ জিয়ার আদর্শ ও দর্শনকে বুকে ধারণ করে বিএনপির নেতাকর্মীবৃন্দ দলকে সুসংগঠিত করেছে। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সফল হয়েছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেছে। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে শহীদ জিয়ার গড়া দল বিএনপি। যতবার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, ততবারই বিএনপি জনগণের ভোটে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দেশি বিদেশী চক্রান্তে এক এগারোর সৃষ্টি হয়, যেখানে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়া বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছে।


স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে মুক্তিযুদ্ধের মূল আকাঙ্খা গণতন্ত্র বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩০ তারিখের নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতে ভোটডাকাতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে পূনরায় হত্যা করেছে। দেশ আজ স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট ও নব্য বাকশালিদের দখলে। আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আজ শূন্যের কোঠায়। জাতীয় থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত। দেশ আজ দুর্নীতি, দু:শাসন, অপশাসন, গুম-খুন, অপহরণ ও মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বর্তমান করোনাকালিন সময়ে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন সেক্টরে যে অরাজকতা হয়েছে তা নজিরবিহীন। বিরোধী মতের মুখ বন্ধ করতে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, সিনিয়র নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার বিএনপির নেতাকর্মী মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় জর্জরিত। সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে দু’বছর মিথ্যা মামলায় কারাগারে রেখে, এখন গৃহবন্দি করে রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই সরকারের প্রতিহিংসার কারণে দেশের বাইরে অবস্থান করছে। সরকার এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়েছে যে, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব কেড়ে নিতে চাচ্ছে।


দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে শহীদ জিয়ার আদর্শকে বুকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বেগম খালেদা জিয়ার পূর্ণাঙ্গ মুক্তি ও তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি জনগণকে সাথে নিয়ে বিএনপিকেই সৃষ্টি করতে হবে। দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হলে বর্তমান ফ্যাসিস্ট, বাকশালি, স্বৈরাচারি ও মাফিয়া সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লক্ষ্য পূরণ হবে এবং দেশ গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবে।





লেখক–

ড. খন্দকার মারুফ হোসেন

সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটি বিএনপি 

ও অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।

Monday, April 12, 2021

সুস্থ হয়ে ওঠুন, হে গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা

মাকসুদুর রহমান 

বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন। বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা, নারী শিক্ষা এবং অভ্যন্তরীন উৎস থেকে মুল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ভিত্তিমুল দাড় করানোর প্রধান কারিগর। বিরোধিতার খাতিরে আপনি তাঁকে সমর্থন করতে না পারেন। একজন আপাদমস্তক  প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রিয় রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এক জন মাত্র মানুষের নাম বলতে বললেও যার নাম আসবে তিনি বেগম খালেদা জিয়া। 




বলতে গেলে এই মানুষটির সমগ্র জীবনই একটি অবিরাম সংগ্রামের। মহান স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন সময়ে স্বামী মেজর জিয়াউর রহমানের কোর্ট মার্শালের দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে নয় মাস পাকিস্তানি হানাদারদের গহ্বরে  দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে বন্দী ছিলেন। তারুণ্যের মাঝামাঝি সময়ে প্রিয়তম স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে হারানোর মধ্যে দিয়ে মুলত শুরু হয় তাঁর সশরীরে দেশের জন্য, দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, বিদেশী শক্তির রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন স্বত্তা নিয়ে  এগিয়ে চলার অবিরাম লড়াই। এরমধ্যে  সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ শাহী ও মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারতো ছিলো প্রকৃত অর্থে এক ভয়ঙ্কর লাইসেন্সধারী অস্ত্রবাজদের পৃষ্ঠপোষক। যাদের বিরুদ্ধে বিরামহীনভাবে বলতে গেলে একাই লড়াই করেছেন এই মানুষটি। একটিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের সাথে আপস করেননি। বিষয়টা যতো সহজ ও সরল সমীকরণের আমরা ভাবি তা কিন্তু নয়। কারণ, এই মানুষটিরই এ ধরনের রাষ্ট্রীয় অপশক্তির সাথে  সহজ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব ছিলো। বরং এরশাদসহ মইন উদ্দিন সকলেই তাঁর সাথে সমঝোতা করতে উদগ্রীব ছিল। কিন্তু   বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অবিচল থাকা আপসহীন নেত্রী বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী আসন পাওয়া   বেগম খালেদা   জিয়া কখনোই এই অগণতান্ত্রিক অপশক্তির সাথে হাত মিলাননি। যার ফলেই এখনো বাংলাদেশে যে নিভু নিভু গণতান্ত্রিক আশা বেঁচে আছে সেটা এই অসম্ভব গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষটির অবদান। আজ থেকে ২০ বছর পর কেউ যখন স্বাধীনতা পরবর্তী  বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাস রচনা করতে যাবেন তখন দেখতে পাবেন ইতিহাসের পরতে পরতে যে মানুষটির নির্মোহ অবস্থান তিনি আর কেউ নন, তিনি বেগম খালেদা জিয়া। 

বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে কোভিড নাইনটিন এ আক্রান্ত।  তাঁর অসুস্থতার খবর বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় সকল  মানুষের জন্য এক মনস্তাত্বিক আঘাত। 

বাংলাদেশের মানুষ, মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আজন্ম লালিত স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটি অবশ্যই এদেশের কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা ও প্রত্যেক মানুষের আধ্যাত্মিক প্রত্যাশায় সুস্থ হয়ে উঠবেন। 

এ প্রত্যাশা শুধু আমার নয়, যারা গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার নিয়ে ভাবেন দলমত নির্বিশেষে তাদের সকলের। 

সুস্থ হয়ে ওঠুন, হে গণতন্ত্রের মহান আলোকবর্তিকা!

  • লেখক গবেষক।  


Sunday, April 11, 2021

বেগম জিয়ার করোনা রিপোর্ট ও রোগীর গোপনীয়তার অধিকার

— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ








করোনা যে কারো হতে পারে। সেটা অনেকে পাবলিক করেন। আবার কেউ জানাতে পছন্দ করেন না।

করোনা বা যে কোন রোগ হলে তার গোপনীয়তা রক্ষার এই অধিকার রোগীর আছে। রোগীর অনুমতি ছাড়া তার রোগের বিষয়ে অন্য কেউ তা প্রকাশ করতে পারে না।  এমন কী চিকিৎসকও না।

একমাত্র রোগীই সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি তার রোগের বিষয়ে অন্যকে জানাবেন কী না। জানানোর জন্য কাউকে অনুমতি দেবেন কি না, সেটাও তার একান্ত ইচ্ছা। 

রোগী অনুমতি দেওয়ার মতো অবস্থায় না থাকলে তখন তার পরিবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি রোগের বিষয়ে অন্য কাউকে বা সংবাদমাধ্যমে জানাবেন কি না। এ প্রসঙ্গে সাবেক মেয়র আনিসুল হক লন্ডনে আইসিইউতে থাকাকালীন পরিস্থিতির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। কোন সংবাদমাধ্যম সেখানকার চিকিৎসকদের কাছ থেকে একটি শব্দও জানতে পারেনি।

অথচ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার করোনা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে নিশ্চিত করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম প্রধান! বেগম খালেদা জিয়ার রিপোর্টে যে ফোন নম্বরটা দেওয়া হয়েছে, সেটি বিএনপি চেয়ারপারসনের মেডিকেল টিমের টেকনোলজিস্ট মো. সবুজের। তিনি পর্যন্ত খালেদা জিয়ার করোনা শনাক্ত হওয়া বা না হওয়া বিষয়ে কিছু জানেন না বলে লিখেছে প্রথম আলো।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তিনিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই খালেদা জিয়ার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট দেখেছেন। পরিবারের কেউও এখনো জানাননি খালেদা জিয়ার করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর।

অথচ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে বেগম খালেদা জিয়ার টেস্টের কথাই শুধু জানানো হয়নি, রিপোর্টের কপিও দিয়ে দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। তা ভাইরাল করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এটি শুধু অসৌজন্যই নয়, এর মাধ্যমে সরকার বেগম খালেদা জিয়ার অধিকারও ক্ষুন্ন করেছে।


লেখক চিকিৎসক ও কলামিস্ট। লেখকের ইমেইল একাউন্ট sayantha15@gmail.com ।

Friday, April 2, 2021

শিরোনামহীন মাধবী — ৭

—  মো: আসাদুজ্জামান

প্রগাঢ় ভালোবাসা তোমার জন্য । আমার অনন্ত অতল অনুভূতির প্রতি তোমার নিত্যদিনের অবহেলা এবং উপেক্ষা আমাকে বিষন্ন , বিপন্ন করে তুলছে ইদানীং । যাপিত জীবন আমার বেদনার রঙে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে । মহামারী করোনা এবং ক্ষমতাসীনদের রক্তের নেশা বেঁচে থাকার সুখানুভূতিকে নিস্প্রভ করে তুলছে । অনেকের মতো আমারও অষ্ট্রপ্রহর কাটে উদ্বিগ্ন আর উৎকন্ঠায় । তবুও কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মত তোমার কাছে নৈবেদ্য নিবেদনের জন্য বলতে  ইচ্ছে করছে, 

“আমি সেই অবহেলা, আমি সেই নতমুখ, নিরবে ফিরে যাওয়া অভিমান-ভেজা চোখ, আমাকে গ্রহণ করো। উৎসব থেকে ফিরে যাওয়া আমি সেই প্রত্যাখ্যান, আমি সেই অনিচ্ছা নির্বাসন বুকে নেওয়া ঘোলাটে চাঁদ। আমাকে আর কি বেদনা দেখাবে?”

সে যাই হোক, আমার ব্যক্তিগত বেদনার ফ্যাকাসে রঙ বাদ দেই এখন । কেমন আছো মাধবী, আমার প্রগাঢ় ভালোবাসার নীল পরী? এই মহামারী, এই মৃত্যু উপত্যকা , এই গুলি বোমা টিয়ারশেলের বাংলাদেশে অনেকের মত তুমি নিশ্চয়ই ভালো নেই! ভয়াবহ দু:সময়ের মধ্যে গোটা বিশ্ব। এরই মধ্যে লক্ষ্য করেছো নিশ্চয়ই যে , ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ  যে গৌরবের মুকুট পরতে চেয়েছিলো সেটা হয়তো ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে । এই মহান দিবসের আগে পরের ঘটনায় অনেকের রক্তের দাগ আওয়ামীলীগ সরকারের হাতে লেগে গেছে। গোটা ঢাকা শহরের মানুষের চলাফেরাকে শৃঙ্খলিত করে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালন নাগরিকদের কাছে অসন্মান জনক হয়েছে বলে আমার মত অনেক নিন্দুকেরা মনে করে। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে আফসোস করতে শুনেছি যে এ কেমন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী! স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, তাজউদ্দিন  আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, জেনারেল ওসমানীসহ অগনিত সূর্যসন্তানদের নাম আঁধারে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং উল্লেখিত সূর্যসন্তানদের নাম সহ অসংখ্য মহান মানুষের নাম অবশ্য শহীদ জিয়ার আদর্শের ভ্যানগার্ডেরা আঁধার ভেদ করে রুপোলি চাঁদের আলোয় মেলে ধরেছে! এ কথাগুলো রাজনৈতিক, তোমাকে বলা যায় তাই বললাম! কিছু মনে করো না যেন!




মাধবী, গত কয়েকদিন আমার মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তোমার মনের মধ্যেও সেই প্রশ্নগুলো সংক্রমিত হোক, তুমিও আমার মত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হও সেটা আমি চাই । প্রশ্নগুলো তৈরী হয়েছে  সূবর্ণজয়ন্তীতে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলছেন যে, তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কথা বলার জন্য তাঁর দেশ ভারতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাহলে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, ১৯৭১ সালে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কি পাকিস্তানপন্থী ছিলো? কিংবা কংগ্রেস কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো? এই কারনেই কি কংগ্রেসের কোন প্রতিনিধি আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীতে আসেন নি? না কি তাঁদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি? ১৯৭১ সালে ভারতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার আমাদের স্বাধীনতার  পক্ষে কথা বলার জন্য তৎকালীন তাঁদের দেশের একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মীকে কেন গ্রেফতার করেছিলেন? আইনের ছাত্র এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে এই প্রশ্ন আমাকে নিদ্রার প্রান্ত অবধি ধাবিত করছে। শ্রীমান নরেন্দ্র মোদির এহেন বক্তব্য কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস রচনার চলমান প্রক্রিয়ার অংশ যেখানে শহীদ প্রেসিডন্ট জিয়াউর রহমান কিংবা ভারতের তৎকালীন সরকারের অবদানকে মুছে ফেলতে হবে? তুমি যৌক্তিক কোন উত্তর খুঁজে পেলে তোমার উপেক্ষা সয়ে নেবো, কথা দিলাম!

মাধবী, বসন্তের চৈত্র মাস এখন। কালবৈশাখীর ঘনঘটা । তুমি উপেক্ষার দহনে আমাকে বিদগ্ধ বানাতে চেয়েছো, পরিণতশীল মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছো। তবুও মন মানে না, মন আমার বারেবারে বাজনা বাজিয়ে কবি গুরুর সেই অমর কবিতা আওড়ে চলেছে,     

“ প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস

তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। ”

নীলাদ্রিসম প্রেয়সী আমার, ভোটাধিকারহীন এই দেশে কেউ আমরা নিরাপদ নই! বড্ড দু:সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা। মহামারী আবার ফিরে এসেছে এই শহরে। নিয়নবাতির আলোয় আর বেড়াতে মন চায় না। যে মানুষদের ভালোবেসে, যে মানুষদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য একদিন রাজনীতি করার পথ বেছে নিয়েছিলাম, আজ সেই মানুষদের সান্নিধ্যই জীবনের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তাহীনতার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার রাজনৈতিক সহকর্মী, সুহ্রদ, সজ্জন ব্যক্তি আমাদের খন্দকার আহাদ আহম্মেদ মানুষের ভালোবাসার টানে তাঁর নির্বাচনী এলাকা গাইবান্ধায় গিয়েছিলেন, সেই প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যই তাঁর জীবনের কাল হয়েছিলো, তাঁদের স্পর্শেই করোনার কাছে তাকে হার মানতে হলো। আজ সকাল থেকে আহাদ ভাইকে খুব মনে পড়ছে । আমার জীবদ্দশায় তোমাকে ভূলতে চাই মাধবী। মরনের পর তোমাকে ভুলতে হলে তোমার উপর আমার জমাটবদ্ধ অভিমানের অভিব্যক্তি প্রকাশিত হবে না। তোমাকে ভুলে যাওয়ার নিরন্তর সংগ্রামে নিজেকে সমর্পন করেও ভুলতে পারছি না। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতেই হচ্ছে, 

 “তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সে জানে তোমারে ভোলা কি কঠিন।”

 

ভালো থেকো সব সময়, আমার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে আমার নিরন্তর প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে থেকো!



— লেখক আইনজীবী ।