Search

Friday, September 4, 2020

গুমবিরোধী সনদে কেন সই করেনি বাংলাদেশ

— সায়ন্থ সাখাওয়াৎ










ঠিক এক বছর দুই মাস আগে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের আলোড়ন তোলা কথাগুলো কি মনে পড়ে! একটু মনে করিয়ে দিই। তার ভাগ্নে গুম হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজির কাছে আবেদন করেও কোনো কূল কিনারা না পেয়ে তিনি আসেন প্রেস কনফারেন্স ও ফেইসবুক লাইভে। তখন তার যে কথাটি সবার মনে দাগ কেটেছিল তা হলো, ‘আজ হয়তো আমার ভাগ্নের ক্ষেত্রে হয়েছে, কাল হয়তো আপনার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এটা আরেকদিন আপনার সন্তান হতে পারে। কার কী পরিচয় সেটা মুখ্য বিষয় নয়, আমার কী পরিচিতি আছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। আইনের শাসন রাখতে হবে এবং ন্যায়বিচার এবং সুবিচারের রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের এরকম একটি পরিণতির সম্মুখীন হওয়া উচিত নয়। আমি আশা করব, আইনবহির্ভূত এবং ক্ষমতার অপব্যবহার যদি কেউ করে থাকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’ সোহেল তাজের ভাগ্নের বিষয়ে হয়তো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সোহেল তাজ ফিরে পেয়েছিলেন তার ভাগ্নেকে। তারপর আরও কত মামার কত ভাগ্নে নিখোঁজ হয়ে গেল, কত মায়ের বুক খালি হলো, কত সন্তান হলো পিতৃহারা আর কত স্ত্রী হলেন স্বামীহারা তার খোঁজ হয়তো রাখেননি এই সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

কিন্তু গুম থেমে নেই। ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবসকে সামনে রেখে ১২টি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের গুম বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ২৮ আগস্ট ২০২০। এতে যেমন বাংলাদেশে দুটি সংগঠন ‘অধিকার’ ও ‘মায়ের ডাক’ আছে। তেমনি আছে অ্যাডভোকেট ফর হিউম্যান রাইটস, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসএপেয়ারেন্সেস (এএফএডি), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআর ডব্লিউ), রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড আরগানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার-এর মতো সংগঠনও। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, বর্তমান সরকারের ১ জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ৩১ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অন্তত ৫৭২ জন মানুষকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গুম করেছে। এরমধ্যে কিছু সংখ্যককে ছেড়ে দিয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, কিছু মানুষকে তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর বড় একটা অংশ এখনো নিখোঁজ! যদিও বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য মতে এই সময়ে গুমের শিকার মানুষের সংখ্যা ৬০৩ জন। যৌথ বিবৃতিতে গুরুতর যে তথ্যটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো, গুমের বেশিরভাগ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৪ এবং ২০১৮ এর নির্বাচনকে ঘিরে। সবচেয়ে বেশি গুম করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে। আর ২০২৮ সালের নির্বাচনের সময় গুম করা হয়েছে অন্তত ৯৮ জনকে। আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। তা হলো, দেশের যে সব এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো ছিল, সেখানে গুমের সংখ্যাও বেশি। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে গুমের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক।

বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীরের মতো আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গুম হয়েছেন। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে এ সরকারের সময়ে বাংলাদেশে গুমের শিকার ছয়শ জনের বেশি হলেও বিএনপির মতে এ সংখ্যা সহস্রাধিক। গুমের শিকার ব্যক্তিদের কারও লাশ পাওয়া গেছে। আর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কিছু মানুষকে। এখনো নিখোঁজ কয়েকশ মানুষ! সবগুলো গুমের ঘটনায় অভিযোগের তীর নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দিকেই। কিন্তু সরকার সব সময়ই অস্বীকার করে আসছে এ অভিযোগ। এমনকি এই জঘন্যতম অপরাধ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কখনো কখনো নির্মম রসিকতাও করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা নাকি পাওনাদারের ভয়ে বা প্রেমের কারণে আত্মগোপন করে আছেন। গুমের কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে মানবাধিকার সংগঠন ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ ভিত্তিহীন কিনা।

অতিসাম্প্রতিক ঘটনা। ফটোসাংবাদিক ও পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল ১০ মার্চ ২০২০ বাসা থেকে বের হয়ে আর  ফেরেননি। দুই মাস পরে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। নিজ দেশে অনুপ্রবেশ করার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার দেখায় বেনাপোল থানা পুলিশ। তিনি এখনো জেলে। বাংলাদেশের আলোচিত রাজনীতিবিদ বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদকেও ভারতের শিলংয়ে অনুপ্রবেশের দায়ে আটক করেছিল সে দেশের পুলিশ। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ২০১৫ সালে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে অন্তরীণ। সে সময় দলের পক্ষ থেকে যিনি প্রেস ব্রিফিং করেন, তাকেই গ্রেপ্তার করা হয়। তাই দলের মুখপাত্র হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অজ্ঞাত স্থানে থেকে প্রতিদিন দলের কর্মসূচি ও নেতাকর্মীদের জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা সংবাদমাধ্যমের কাছে পাঠাতেন তিনি। সে সময় হঠাৎ নিখোঁজ হন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। পরিবার, দল ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তার দুই মাস পরে তাকে অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখে গ্রেপ্তার করে শিলং পুলিশ। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর মুবাশ্বার হাসান সিজারকে নিখোঁজের ৪৪ দিন পর রাতে ছেড়ে দেওয়া হয় বিমানবন্দর এলাকায়। নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের ঘটনার সূত্রপাত কিন্তু গুম দিয়েই। তাদের লাশ পাওয়া না গেলে সে গুমের সঙ্গে যে একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য ও একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর জামাই জড়িত তা জানাই যেত না।

পরিবেশবাদী আইনজীবী সমিতি ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পরে স্বামী এবি সিদ্দিককে ফেরত পেয়ে বলেছিলেন, ‘টাকার জন্য এই অপহরণ করা হয়েছে বলে আমি প্রাথমিকভাবে মনে করছি না। প্রচন্ড চাপের মধ্যে পড়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের চাপ তো ছিলই। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্দেশনা দিয়ে পুরো বিষয়টি তদারকি করছিলেন।’ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেই। কিন্তু যথারীতি তা অস্বীকার করেছিল সবগুলো বাহিনী। শেষ পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টা গুম করে রাখার পর পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায় তাকে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানকে অপহরণ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। গুমের অভিযোগের তীরটি ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই। নিখোঁজের ১ বছর ৩ মাস পরে বাবাকে ফিরে পাওয়ার পর সাবেক এই রাষ্ট্রদূতের মেয়ে বলেছিলেন, বাবার গুমের বিষয়ে তারা বিস্তারিত কিছু বলতে চান না।

গুমের মতো ভয়াবহ পরিণতির অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা ফেরত আসতে পেরেছেন তারা আর কেউ মুখ খুলছেন না। মানবাধিকারকর্মীরা নানাভাবে আশ্বস্ত করেও ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারে না। তারা হয়তো দ্বিতীয়বার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে চান না। এমনকি ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সংঘটিত বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহারকে অপহরণ বিষয়টিও রয়ে গেল অন্ধকারেই। কিন্তু সরকারি বাহিনীগুলো যদি এর সঙ্গে জড়িত না থাকত, তবে তো তারাই ফেরত আসা ব্যক্তিদের অভয় ও নিরাপত্তা দিয়ে তাদের থেকে তথ্য বের করতে পারত। দায়ীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু গত একযুগে এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি। শুরুতে তুলে নেওয়ার কথা অস্বীকার করে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে অনেককে। এই মানুষগুলোকে গ্রেপ্তার না দেখালে তারাও হয়তো থেকে যেত গুমের তালিকায়। ফলে এই প্রশ্নও উঠতে পারে যে, গুমবিরোধী সনদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসএপেয়ারেন্স’-এ কেন সই করেনি বাংলাদেশ?


  • লেখক চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
  • কার্টসি — দেশ রূপান্তর/ সেপ্টেম্বর ৪, ২০২০ 

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ-চীন-ভারত সম্পর্ক: কারা কী চায়? কেন চায়?

—  সুলতান মোহাম্মেদ জাকারিয়া 

 

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ হয়েছে যে চীন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। একইভাবে সিলেটের উন্নয়নেও দেশটি বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন প্রকল্প যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণেও চীনের সম্পৃক্ততার কথা রয়েছে। সাবমেরিন ঘাটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে চীন কেন আপাতদৃষ্টিতে ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ রংপুর ও সিলেট অঞ্চলে এত বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগে আগ্রহী হলো? আমার বিশ্লেষণ হলো এর সম্ভাব্য কারণ এই দুটি অঞ্চলের কৌশলগত অবস্থান। তেঁতুলিয়া জেলার বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাঁকরভিটা সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। চীন নেপালের সাথে কৌশলগত মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং এ অঞ্চলে চীন ও ভারতকে ঘিরে দ্বিপক্ষীয় কিংবা আমেরিকা-ভারত-চীনকে ঘিরে ত্রিপক্ষীয় ভবিষ্যত যেকোনো সংঘাতে চীন এ কৌশলগত সম্পর্কের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চাইবে। এর পাশাপাশি আপনি যদি বাংলাদেশের রংপুর বিভাগকে রাখেন এবং রংপুর অঞ্চলে যদি চীনারা তাদের কৌশলগত অবস্থান তৈরি করতে পারে তাহলে কাঁকরভিটা ও বাংলাবান্ধার ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ভারতের শিলগুড়ি করিডোর, যেটি ভারতীয়দের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট, সেটির উপর রিয়েল টাইম নজরদারি সহজ হয়। এবং যেকোনো সামরিক মৈত্রিতার ক্ষেত্রে চীন উভয়দিক থেকে (পিনসার মুভমেন্ট) প্রচেষ্টা চালালে এই চোক পয়েন্টটি ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে দখল করে নেওয়া সম্ভব এবং এর মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যেটির সাথে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সেভেন ভারতের সিস্টার যুক্ত করলে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের উপর তীব্র সামরিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব।

এই একই ভূরাজনৈতিক কৌশলের আরেকটি কানেক্টিং ডট হচ্ছে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল। সিলেট থেকে চীনের কুনমিং এর মধ্যবর্তী স্থান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মনিপুর রাজ্য এবং মিয়ানমার, যেটি আবার চীনের কৌশলগত মিত্র। এর সাথে আপনি যদি মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের ইতোমধ্যে বিদ্যমান ভারত-বিরোধী মনোভাব ও চলমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে এক করে দেখেন আপনি একটি পরিষ্কার চিত্র পাবেন যে কী হচ্ছে কিংবা কী হবে।




বর্তমানে চীনের কাছে যে পরিমাণ নগদ ও উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে সারা বিশ্বে আর কারো সেটি নেই। ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিন কয়েকদিন আগে এক প্রতিবেদনে বলেছে যে আমেরিকা, জাপান, ও ব্রিটেন এই তিন দেশ মিলে সারা বিশ্বে যত ঋণ কিংবা অর্থ সহায়তা দিয়েছে, চীন একাই তার চেয়ে বেশি দিয়েছে। আমার বিবেচনায় চীন প্রধানত তিনটি কারণে এতটা উদার হস্তে বিশ্বে ঋণ দিয়ে বেড়াচ্ছে কিংবা বিনিয়োগ করছে: (১) নিখাঁদ অর্থনৈতিক কারণে (অর্থাৎ উদ্বৃত্ত টাকা অলস পড়ে থাকলে সেগুলোর প্রকৃত মূল্য হ্রাস পাবে, সুতরাং ঋণ প্রদানই উত্তম বিকল্প), (২) বন্ধু দেশগুলোতে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরি করা (যেমন, আফ্রিকা, এশিয়ার, লাতিন আমেরিকা, এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ), এবং (৩) সামরিক বিবেচনায় কৌশলগত বিনিয়োগ (পাকিস্তানের গোয়াদর, শ্রীলংকার হাম্বানতুতা, ইরানের চাবাহার প্রভৃতি স্পর্শকাতর ভূরাজনৈতিক অবকাঠামোয় বিনিয়োগ ও সেগুলোতে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা)।

বাংলাদেশে পদ্মা সেতুতে চীনা বিনিয়োগ উপর্যুক্ত দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত এবং সিলেট ও তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব উপরের তৃতীয় কারণে বলে আমি মনে করি। এবং যে ভূরাজনৈতিক সমীকরণে চীন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে (তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের মাধ্যমে) ও সিলেটে বিনিয়োগ করতে চায় (ইন মাই ভিউ, টু পজিশন ইটসেল্প স্ট্র্যাটেজিক্যালি উইথইন বেঙ্গল ডেল্টা টু কনফ্রন্ট ইন্ডিয়া ইন এনি ফিউচার কনফ্লিক্ট), সেই একই কারণে ভারত এসব স্থান/প্রকল্পে চীনের অন্তর্ভুক্তির বিরোধীতা করে। ভারতের জন্য অসুবিধার বিষয় হচ্ছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার/থাকার সুবিধা করে দেওয়ার আশ্বাস ছাড়া তাদের হাতে খুব বেশি স্ট্র্যাটেজিক লেভারেজ নেই যেটি দিয়ে তারা জোর খাটাতে পারে।

অন্যদিকে ম্যাডাম শেখ হাসিনার জন্য এটি শাখের করাত। তিনি জানেন যে, অবৈধ পন্থায় ও জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকতে গেলে তার ভারতীয় গোয়েন্দা এস্টাবলিস্টমেন্টের সহায়তা দরকার। পাশাপাশি তিনি আরো দুটি উপায়ে তার অবৈধ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকে পোক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন (সফলভাবেই): প্রথমত, তিনি গণতন্ত্রের “বিনিময় মূল্য” হিসেবে এলিট শ্রেণিকে রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত একটি ‘স্থিতিশীলতা’ উপহার দিয়েছেন যেখানে তারা নির্বিঘ্নে তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে পারেন এবং কিছু অবকাঠামো সমস্যা, যেমন, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ – এসবের সমাধান করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি রাষ্ট্রের জনগণকেও ‘ইটকাঠের উন্নয়নের’ একটি দৃশ্যমান মুলা ঝুলিয়েছেন এই বলে যে ‘গণতন্ত্র না থাকলেও উন্নয়ন আছে’। পাশাপাশি একটি সুবিশাল লুটপাটের রাজনৈতিক অর্থনীতি তৈরি করেছেন যেখানে ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে, যেমন - সরকারি কর্মচারিদের বেতন তিন-চারগুণ বাড়িয়ে, সামরিক বাহিনীকে উন্নয়ন প্রকল্পে লোভনীয় বেতনে যুক্ত করে, রেন্ট-সিকিংয়ের সুবিশাল নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে সমাজের উপর দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার মাধ্যমে (যেমন, কওমী আন্দোলন হেফাজতে ইসলামের কিছু লোককে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে কো-অপ্ট করে, দেশব্যাপী উন্নয়নের চুইয়ে পড়া অর্থনীতির ‍সুবিধাভোগী স্থানীয় পেটি বুর্জোয়াদের তোষণের মাধ্যমে)। মুশকিল হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী আসন্ন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে উপরের দুটি উপায়ই চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

করোনা পরবর্তী সংকটপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থায় এই মুহূর্তে চীন ছাড়া আর কোনো দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক দাতার পক্ষে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে চলমান বড় বড় কয়েক ডজন মেগাপ্রকল্পে এই বিশাল অংকের বিনিয়োগ এবং ঋণ প্রদান ছাড়া (বেইল আউট) শেখ হাসিনার পক্ষে প্রথমত উন্নয়নের ন্যারেটিভ এবং দ্বিতীয়ত লুটপাটের রাজনৈতিক অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আর সেটি সম্ভব না হলে আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের তীব্রতা সমাজে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে সেটি ভারতের গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করতে পারবে না। সুতরাং গদি রক্ষায় ভারতের রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা এস্টাবলিস্টমেন্টের সহায়তার পাশাপাশি শেখ হাসিনার ‘চীনা টাকা’ লাগবেই।

মুশকিল হচ্ছে চীন তখনই শেখ হাসিনার তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ ন্যারেটিভ এবং রেন্ট সিকিং কাঠামো টিকিয়ে রাখতে টাকা দিবে যখন বাংলাদেশ চীনের চাহিদামতো বাংলাদেশের স্পর্শকাতর স্থান/কৌশলগত-প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে রাজি হবে। অন্যদিকে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে দিলে ভারত তার দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত স্বার্থ হানির আশঙ্কায় এসব প্রকল্পে বাধা দিবে বা হতে দিতে চাইবে না। এই শাখের করাত ম্যাডাম শেখ হাসিনার ‘ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার’ প্রকল্পটিকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশের জনগণকে বাদ দিয়ে ভারত ও চীন উভয় মিত্রকে খুশী রেখে ক্ষমতা ধরে রাখার যে প্রচেষ্টা সেটি এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে অতি-রাজনীতি করার ফলও এটি।

তবে এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা তার স্বভাবজাত অতিচালাকীর আশ্রয় নিয়ে উভয় মিত্রকে খুশী রাখতে চাইবেন। কিন্তু শেখ হাসিনার কাছে যেটি ক্ষমতার শর্ট গেম, ভারত ও চীনের কাছে সেটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত স্বার্থের লং গেম। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টাটি অনেকটা সুতোর উপর দিয়ে হাঁটার মতো। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। শঙ্কা হচ্ছে এ খাদে কেবল তিনি একলাই পড়বেন না, বাংলাদেশকে নিয়েই পড়বেন।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ পরিস্থিতি তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবেলা করতে পারতেন। বাংলাদেশের জনগণকে জানিয়ে, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যেকোনো চুক্তি, সমঝোতা, কৌশলগত ছাড় ও মিত্রতার জোর হতো অন্যরকম। মানুষকে সচেতন করলে, উদ্বুদ্ধ করলে, দেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষকে নিয়ে এ ধরনের বিপদ মোকাবেলা করা যেতো। এবং এটি করা গেলে বিদেশী শক্তিগুলোও তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা কৌশলগত লাভক্ষতি বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বার্থহানি হয় এরূপ যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে বহুবার ভাবতো। কিন্তু বর্তমানে শেখ হাসিনার সাথে জনগণের কোন আস্থার সম্পর্ক নেই। তার কথায় তার নিজ দলের মানুষেরও বিশ্বাস, আস্থা আছে কিনা সন্দেহ। তিনি একাধিকবার রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে দেওয়া কথা বরখেলাপ করেছেন। এই জটিল, সংকটময় মুহূর্তে তার এই একাকীত্বই তার ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারে।


Thursday, September 3, 2020

বিএনপি'র সাফল্য যেখানে

খায়রুল কবীর খোকন


খায়রুল কবীর খোকন

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার এক মহাসংকটকালে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন একটানা সাড়ে পাঁচ বছর প্রায়। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে সেই সাড়ে পাঁচ বছর ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র, যে গণতন্ত্র ও মানবিক-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়নে এক অসাধারণ প্রচেষ্টা।


বাংলাদেশের সব ধরনের রাজনীতিককে এক কাতারে শামিল করে মিত্রতার বন্ধনের লক্ষ্যে একটা জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠাই ছিল বিএনপি প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। জিয়াউর রহমান ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার আমলে 'দুর্নীতিবাজ স্বজন-চক্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী গড়ে উঠতে পারেনি। তাই রাজনীতিতে তার সঙ্গী-সাথীরাও দুর্নীতি করার দুঃসাহস দেখাননি- সেখানেই ছিল জিয়াউর রহমানের আসল সাফল্য।


রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি বড় কাজ ছিল- স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সারাদেশে খাল কাটা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। এর ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে সাফল্য অর্জন, ফসলি জমিতে সেচ কাজে বিশেষ সহায়ক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন এবং প্রাকৃতিক জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির তৎপরতা এবং গ্রামীণ নৌকা ও ছোট মোটরলঞ্চ চলাচলের নৌপথ সুগম করতে সাফল্যের পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল। আর বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মাঝে 'আলসেমি-আক্রা' মানসিকতার অবসান ঘটিয়ে কর্ম-উদ্দীপনার পথে আগুয়ান করার তৎপরতার গতিলাভ ঘটেছিল। 'চির-আলস্যপ্রিয়' আমলা-গোষ্ঠী বেশ খানিকটা কর্ম-উদ্যোগী স্বভাবে উদ্বুদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছিল।


জিয়াউর রহমানের শিল্পায়ন কর্মকাণ্ডও ছিল প্রবলভাবে গতিশীল। তার উদ্দীপনাময় কর্মতৎপরতা দেখে নতুন একটা শিল্প বিনিয়োগকারী গ্রুপ 'কর্মহীন আলস্যে দিনযাপন' ছেড়ে বেরিয়ে এসে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কাজে উৎসাহী হয়েছিল। বিশেষভাবে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্প গড়ে ওঠা ও বিকাশের সুযোগটাই পেয়েছিল জিয়ার আমলে। দেশের ভেতরে জিয়াউর রহমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছিলেন এবং পাশাপাশি কর্মজীবী-শ্রমজীবী বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও জোরদার করেছিলেন।


তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সুস্থ শিক্ষানীতির পরিচালনায় আনার চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের নিজের উৎসাহে একটি শিক্ষা কমিশন বসেছিল, দেশসেরা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উন্মুক্ত অধিবেশনে বসে তারা অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি রিপোর্ট তৈরি করে উপস্থাপন করেছিলেন। সেই রিপোর্টটি এ দেশের শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি সেরা কাজ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। রিপোর্টটি পেশের পরে সুবিধাবাদি ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্র সেটা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।


জিয়াউর রহমানই রাজনৈতিক দলগুলোর রেজিস্ট্রেশন প্রদানের ব্যবস্থা করেন, সেখান থেকেই অনুমোদন লাভ করে 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ'। একইভাবে অন্যসব রাজনৈতিক দলও অনুমোদন লাভ করে। জিয়াউর রহমান নিজে প্রথমে জাতীয়তীবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্রদল (জাগো-ছাত্রদল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটান। এর পর পরই জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগো-দল) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ভাসানী ন্যাপ, ইউপিপি ও জাসদ এবং অন্য কয়েকটি দলের নেতাকর্মী-সংগঠকদের একটি বড় অংশ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়ায়, বেশ কিছু নেতা প্রথম দিকে এসেও 'বিভ্রান্তিকর রাজনীতি'র নানা বিবেচনায় আবার ছিটকে পড়েন।


শেষ অবধি ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিনটিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে তার চেয়ারম্যান পদে আসীন হন জিয়াউর রহমান। অবশ্য এর আগেই তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন এবং একটি গণভোট করে ব্যাপক জনভোটে জয়লাভ করেছিলেন এবং বিএনপির উনিশ দফা উন্নয়ন-কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেটি ছিল নিঃসন্দেহে বড় মাপের বিপ্লবাত্মক কর্মসূচি। তার মধ্যে দেশ গঠন ও উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার প্রক্রিয়া শক্তিশালী ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানোর একটি সুবিশাল পথযাত্রার সূচনা পর্ব ছিল। ছিল স্বদেশের তরুণ ও যুবসমাজকে 'চির আলস্য ছেড়ে দিয়ে একটি পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনমূলক জাতীয় কর্মকাণ্ডে' সরাসরি সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী করার যারপরনাই প্রচেষ্টা।


জিয়াউর রহমানের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনকালে (উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠানকাল ধরে) তিনি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে চীনা সহায়তা-অর্জনের প্রচেষ্টায় অগ্রসর হন। রাষ্ট্রপতি জিয়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য তার কূটনৈতিক সুবিধা লাভের প্রয়াসে অনেকখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সম্পদশালী রাষ্ট্রের সরকারগুলোকে কার্যকর লবিং করার মাধ্যমে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ লাভ করেন।


জিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ-বিদেশে শক্তিশালী-ভূমিকা এবং বিএনপির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা একে অন্যের সম্পূরকরূপে বিবেচিত হবে। বস্তুত, 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি' দিয়ে বিএনপি ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপমহাদেশীয় নয়া উপনিবেশবাদী ও আধিপত্যবাদী রাজনীতি-কূটনীতি সামাল দেওয়ার কাজে যে ভূমিকা রাখতে সক্ষম, তা এ দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। সেখানেই জিয়াউর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির সাফল্য, সেখানেই সার্থকতা।


  • লেখক - খায়রুল কবীর খোকন
  • যুগ্ম মহাসচিব; সাবেক সংসদ সদস্যও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক, বিএনপি
  • কার্টসি - সমকাল/ সেপ্টেম্বর ২, ২০২০ 

Wednesday, August 26, 2020

ভূ -রাজনীতির টানাপোড়েন: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

ডক্টর এম মুজিবুর রহমান



এক: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়া বিশ্লেষণমূলক লেখা প্রকাশ করছে । সম্প্রতি চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের পর থেকে এটা এখন আর মিডিয়ার আলোচনায় সীমাবদ্ব নেই। কূটনীতি ও রাজনীতি এ নিয়ে সরগরম। ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার করোনার মধ্যেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এক ঝটিকা সফরে ঢাকা আসেন । ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রিংলার ঝটিকা সফরের খবর এমন সময়ে এলো যখন বাংলাদেশ খুব দ্রুত তিস্তা নদী প্রকল্পে চীন থেকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার পেতে যাচ্ছে বলে ঘোষণা হয়েছে ।  এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা ইস্যুর আশু সমাধান হবে বলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিলেও এখন পর্যন্ত এতে কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সেই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি । ভারতীয় মিডিয়া বলছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিদেশ দূত হিসাবে শ্রিংলা একটি বিশেষ বার্তা হস্তান্তর করেছেন।  বলা হচ্ছে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, সম্প্রতি প্রকাশিত একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার বহুল আলোচিত সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ নাকি আলোচনায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো হাই প্রোফাইল বৈঠক প্রশ্নে মিডিয়াকে তেমন কিছু জানানো হয়নি।

বাস্তবিক অর্থে দু'দিক থেকেই পরিষ্কার করে কিছু বলা হচ্ছে না। বাংলাদেশের মিডিয়া মনে হচ্ছে খুবই হিসেবে নিকেশ কষে সতর্কতার সাথে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যতটুকু দেয়া হচ্ছে ততটুকু ছাপছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখানে নেই বললেই চলে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়াতে এ সফর নিয়ে নানারকম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে । বাংলাদেশের অনেক মিডিয়া সেই রিপোর্ট তথ্য সূত্র দিয়ে প্রকাশ করছে। 

কূটনীতিতে সাবধানতার সাথে শব্দচয়ন করার চেষ্টা করা হয়। তাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকেরা রুঢ় বাস্তবতাকে  জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন । যেসব দেশে তুলনামূলকভাবে সহনশীল রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র, আইনের শাসন সর্বোপরি জনগণের ভোটাধিকার বিদ্যমান সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতার একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের বিশেষজ্ঞরা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য দেশের সাথে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক বা চুক্তিসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, যাতে করে নিজ দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকে। আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে মেঠো বক্তৃতার একটা রেওয়াজ থাকলেও  কূটনীতিতে দেয়া-নেয়ার বিষয় জড়িত। তাই বিভিন্ন পক্ষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে নিজের স্বার্থটুকু আদায় করে নিতে হয়। এখানে অন্য দেশের প্রতি দায়বোধ বা আবেগের  বিষয় প্রাধান্য পাবার কথা নয় । তবে এটা নির্ভর করে আভ্যন্তরীন রাজনীতি ও দেশের জনগণের স্বার্থের ব্যাপারে দায়বোধ ও জবাদিহিতার উপর । 

ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ বিরোধী কুৎসিত প্রচারণার ব্যাপারে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশন প্রতিবাদ জানিয়েছে । চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্বে ভারত তাদের ভূমি হারিয়ে এবং পরিবর্তিত আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে হয়তো পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপালের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চাইছে । বিশ্লষেকেরা মনে করেন, বিগত দিনগুলোতে প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অবজ্ঞা, অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা না দেয়া, সীমান্ত হত্যা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ লোককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান, মুসলমান হিন্দু বিভাজনকে উস্কে দেয়া ইত্যাদি নানা ইস্যূতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতের ইমেজ একেবারে তলানিতে। এর পরে গত দু'তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে দেশের জনগণ, সুশীল সমাজ ও বিরোধীদলসমূহের চাপা ক্ষোভ রয়েছে বলে মনে করা হয় ।  এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের বিতর্কিত ভূমিকার  বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত । ঐ সময় তিনি দেখা করলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ এম এরশাদের সাথে। সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেই এরশাদ ঘোষণা দেন, ‘ওনারা বলেছেন, নির্বাচন করুন। আমি নির্বাচন না করলে নাকি জামায়াত-শিবিরের মতো মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসবে ।’ বলা হয় - তিনি তাকে অনুরোধ করেছিলেন পরের বছর ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য। বিষয়টি মিডিয়ার কাছে এরশাদ ফাঁস করে দিলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। (সূত্র: প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর ২০১৩) ।  তাই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যা বলা হচ্ছে বিষয়টি হয়তো এতো সাদামাটা নয়। অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের এই বাস্তবতা বিশ্বাস করার সাহস দেয় না। আগেই যে চুন খেয়ে আমাদের মুখ পুড়ে আছে। কথায় আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।


দুই:

চীন ও ভারত উভয়ে যার যার স্বার্থে বাংলাদেশকে ঘিরে আগ্রহ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই শক্তি বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে যারা খোঁজ খবর রাখেন তাদের মধ্যেও ক্রমবর্ধমান আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানী ও কাঁচামাল সরবরাহে জল প্রবাহের গুরুত্ব অপরিসীম। শিপিং লাইন দিয়ে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার সমপরিমাণের পণ্যদ্রব্যাদি এবং তৈল-গ্যাসের বাণিজ্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই এ শিপিং লাইন কোনো কারণে বন্ধ বা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে উন্নয়নের চাবিকাঠি আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্য সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও রয়েছে সমুদ্র থেকে অফুরন্ত সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন সমুদ্রের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, জ্বালানি-ভান্ডার ও নৌ-পথে মালামাল সরবরাহে নিষ্কন্টক নিরাপত্তা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক দেশের বিদেশ নীতি পরিচালিত হয়। 

বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভূখণ্ড বঙ্গোপসাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত। পশ্চিম তীরে রয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার ভূখণ্ড । আর বঙ্গোপসাগরের উত্তর তীরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ড অবস্থিত। তীরবর্তী দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে নৌ পথে যেতে পারে। স্বভাবতই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী  দেশগুলো বঙ্গোপসাগরে তাদের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখতে চাইবে । এক্ষেত্রে কোনো দেশ একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখবে নাকি সম্মানজনক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে তা নির্ভর করে দেশগুলোর আভ্যন্তরীন রাজনীতির ধরণ, দেশের স্বার্থ রক্ষায় পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক শক্তির ওপর।

ভারত যেমন বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে চায়, তেমনই চীনও নিজের বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে চাইতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কমন সীমান্ত না থাকায় চীনকে মিয়ানমারের সীমান্ত হয়ে বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করতে হয় । এক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ অর্থনীতির দেশ শুধুমাত্র একটি দেশের উপর নির্ভর করে থাকতে চায় না। তাই বাণিজ্যিক স্বার্থের পাশাপাশি ভূ-কৌশলগত  কারণে বাংলাদেশে চীনের আগ্রহ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।   

চীন একটি বৃহৎ দেশ। এর পূর্ব থেকে পশ্চিমের দৈর্ঘ্য কল্পনা করাই কঠিন। দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ থেকে চীনের মালামাল যদি সমুদ্র পথে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় নিতে হয়, তাহলে সেই মালামাল প্রথমে নিতে হবে চীনের পূর্ব অংশের বন্দরে। এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। তাই চীন যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সময় ও খরচ বাঁচাতে পারে, তাহলে তার অর্থ সাশ্রয় হয়। অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টি চীন চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। 

ব্রস ভৌগন (Bruce Vaughn) নামে একজন এশীয় বিষয়ে বিশেষজ্ঞ 'বাংলাদেশ: পলিটিক্যাল এন্ড স্ট্রাটেজিক ডেভেলপমেন্টস এন্ড ইউএস ইন্টারেস্টস' (Bangladesh : Political and Strategic Developments and US Interests) শিরোনামে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট আমেরিকান কংগ্রেস সদস্যদের জন্য একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেন । এটি কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিস (Congressional Research Service) (সিআরএস-CRS) রিপোর্ট সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। ওয়েবসাইটে যে কেউ তা দেখতে পারেন। 

রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চারজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী বা মূল খেলোয়াড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন (১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, (২) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, (৩) ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং (৪) সামরিকবাহিনী। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বক্তব্যটি এই রিপোর্টে লেখা হয়েছে তা হচ্ছে- ‘Bangladesh is situated at the northern extreme of the Bay of Bengal and could potentially be a state of increasing interest in the evolving strategic dynamics between India and China. This importance could be accentuated by the development of Bangladesh’s energy reserves and by regional energy and trade routes to China and India’ (‘বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। তাই এখন ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত কারণে যে ধরনের গতিশীল সম্পর্কের সূচনা হয়েছে তাতে করে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে (মার্কিন) স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের জ্বালানি মজুদ বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক জ্বালানি-ভান্ডার এবং চীন-ভারতের মধ্যেকার বাণিজ্যপথের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়বে’) ।  

চীন, ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ কারণে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বাংলাদেশের ওপর নানা রকম চাপ বাড়বে । বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তার আগামীর কৌশলগত স্বার্থে সহযোগিতা পেতে বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। পর্যবেক্ষকদের মতে এই শঙ্কাও একদম উড়িয়ে দেয়ার মত নয় যে, তারা এমন চুক্তি করতে চায় যাতে বাংলাদেশে প্রয়োজনে তার সামরিক উপস্থিতির পথ সুগম হয়। সে লক্ষ্য অর্জনেই দেশটিকে অতিমাত্রায় সক্রিয় মনে হচ্ছে। নিজের স্বার্থ এবং শুধু স্বার্থই তাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য। এই পরিস্থিতি অনেকটাই যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ‘কোল্ড ওয়ার’ বা স্নায়ু যুদ্ধের ছায়া হিসেবে দেখা দিয়েছে।


তিন:

বাংলাদেশকে নিয়ে এখন অনেকেরই জোর আগ্রহ। সে আগ্রহ ক্রমবর্ধমান। বলা যায়, প্রতিবেশী বা নিকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান বা শ্রীলংকার চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ। নেতৃত্ব বা অন্য কিছু নয়, বাংলাদেশের এই গুরুত্ব ভূ-রাজনীতি ও বিশাল জনসংখ্যার বাজার এর অন্যতম কারণ। ভারত যে কোনো অবস্থায় বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চায়। উত্তরপূর্ব ভারতের ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত থাকতে এটাই তার একমাত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। এসব রাজ্যসমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে  নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অখণ্ড ভারতে একীভূত রাখাও ভারতের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে রাখতেও তার বাংলাদেশকে প্রয়োজন। ভারতের ব্যাপারে চীন-বাংলাদেশকে অন্তত নিষ্ক্রিয় রাখার আশা হয়ত পোষণ করে। 

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি কারো কাছেই আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠূ নির্বাচন অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তারা বাংলাদেশকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহার করছে ও করতে চায়, যা কিছু নেয়া সম্ভব নিচ্ছে ও নিতে চায়। অতীতে এতো কিছু দেখা না গেলেও সাম্প্রতিক ইতিহাস তার ব্যতিক্রম। ২০১৮ সালের মে মাসে ভারত সফর শেষে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে’ । এর আগে ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকা ‘বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’ শীর্ষক প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘আপনি কোন প্রতিদান চেয়েছেন কিনা? চাইলে কোনও আশ্বাস পেয়েছেন কিনা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কোনও প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে? আর কারও কাছে পাওয়ার অভ্যাস আমার কম। দেওয়ার অভ্যাস বেশি।’

কিছুদিন পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইস্ট এশিয়া ফোরাম 'চায়না এন্ড ইন্ডিয়া'স জিওপলিটিক্যাল টাগ অব ওয়ার ফর বাংলাদেশ' । অর্থাৎ 'বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ব' নামে একটি নিবন্দ্ব প্রকাশ করে। আর নিউইয়র্ক ভিত্তিক 'ওয়ার্ল্ড পলিসি রিভিউ' ঠিক এ বিষয়েই 'উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের' একজন গবেষকের অভিমত প্রকাশ করে । লেখাটির শিরোণাম ছিল, হোয়াই ইন্ডিয়া এন্ড চায়না আর কম্পিটিং ফর বেটার টাইস উইথ বাংলাদেশ।" অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে কেন ভারত আর চীনের মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা? 

এসব লেখাতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন এবং ভারতের সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতা, বাংলাদেশর রাজনীতি ও নির্বাচন এবং দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ রয়েছে। এ নিয়ে বিবিসি বাংলার 'কার অবস্থান কোথায়?', 'অবকাঠামো খাতে প্রতিযোগিতা', 'আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রশ্নে অবস্থান', 'বাংলাদেশ যেভাবে খেলছে', 'প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শেষ কথা নয়', উপ শিরোনাম থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে চীন ও ভারতের মনোভাবকে অনেকটা উপলব্দি করা যায় ।  

বাংলাদেশকে নিয়ে চীন এবং ভারতের প্রতিযোগিতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসে'র মাইকেল কুগেলম্যান তার পর্যবেক্ষণে বলেন, দুটি দেশ একই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে। যুক্তরাষ্ট্রের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের ঘনিষ্ঠতা বহু বছর ধরেই বাড়ছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়নি। মাইকেল কুগেলম্যান অবশ্য ভারত যে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রেখেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যিক, সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্বি করছে তা উল্লেখ করেননি। 

তিনি মনে করেন যে, দিল্লি হয়তো এক সময় এই বাস্তবতা মেনে নেবে যে, ঢাকা অবশ্যই চীনের পুঁজি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করবে। তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে চাইবে। তবে এক্ষেত্রে ভারত হয়তো চাইবে চীন যেন কেবল অর্থনৈতিক খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তারা যেন বঙ্গোপসাগরে কোন ধরণের নৌ স্থাপনা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর না হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও দিল্লীকে এখনো প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। অনেকের ধারণা ভারতের ইশারাতেই সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরের কাজ চীন পায়নি। বরং সঠিকভাবে সম্বাভ্যতা যাচাই ছাড়া এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে জাপানকে পায়রা বন্দরের কাজ দেয়া হয়েছে।  

আভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রশ্নে অবস্থান নিয়ে 'ইস্ট এশিয়া ফোরামে' প্রকাশিত নিবন্দ্বে ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক মনে করেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসলে সেটা ভারতকে বিচলিত করবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ বিষয়ে দিল্লির কৌশল একেবারেই স্বলমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা তাড়িত। তাদের কৌশলটা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা, সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে দেয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশে চীন খেলছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য সামনে রেখে। তারা এক দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। অন্যদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে তারা একটা ভারসাম্য রাখছে।

অনেক বিশ্লেষকেরা মনে করেন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বিমাতাসুলভও বটে । এটা হয়তো তার নিজের বৃহত্তর স্বার্থেই করতে হয়। আর এজন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্বি ও মর্যাদাবান উত্থানে ভারত বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে । কারণ বাংলাদেশের মর্যাদাবান উত্থান ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং এর বাইরের রাজ্যসমূহে স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে আরো বেগবান করবে বলে ভারত শংকিত থাকতেও পারে ।


উপসংহার:

ভূ-রাজনীতির প্রতিযোগিতা ও সহযোগীতাকে কাজে লাগিয়ে কূটনীতিতে দর কষাকষির সুযোগ থাকে। যেনতেন উপায়ে ক্ষমতায় ঠিকে থাকার স্বার্থে নাকি জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে এই শক্তি কাজে  লাগানো হবে সেটা একটা দলের সাথে জনগণের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। জনবিচ্ছিন্ন সরকার ও রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটের উপর আস্থা রাখতে পারে না বলেই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। বিশ্বায়নের এই যুগে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, গোটা দুনিয়ার সাথে অর্থনীতির সংযোগের প্রয়োজন রয়েছে। তবে তা আত্মমর্যাদাকে ভুলন্ঠিত করে নয়। পৃথিবীতে যারা আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতিতে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করছে তাদের অতীত ইতিহাস যে খুব মসৃণ  ছিল, তা কিন্তু নয় । পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্বে বাংলাদেশের জনগণ সাহসিকতার স্বাক্ষর রাখতে না পারলে আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতো তারা। 


ব্রিটেন-ফ্রান্স, জার্মানি-ফ্রান্স, ব্রিটেন-আমেরিকা সভ্যতার সৃষ্টি থেকে এরকম শত শত উদাহরণ রয়েছে যারা  একে অন্যের সাথে যুদ্ব করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনিভাবে প্রতিটি জাতি ঐক্যবদ্ব হয়ে ত্যাগ স্বীকার করে তাদের আত্মিনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরেই একে অন্যের সাথে মর্যাদার  ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে মাত্র । অনেকে মনে করেন সশস্র যুদ্বের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিকে যারা 'খয়রাতি' বলে অবজ্ঞা করে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে জবাব দিতে হবে। অন্যথায় সামনে আরো অনেক কিছু দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পপুলিস্ট ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ডামাডোলের বিপরীতে উদার গণতন্ত্র, সহনশীল ও মধ্যপন্থী রাজনীতির প্রতি এ অঞ্চলের জনগণ ও সুশীল সমাজকে ঐক্যবদ্ব হয়ে কাজ করা উচিত । গ্লোবাল বিশ্বে এখন একা চলার অবকাশ নেই। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের সাথে মর্যাদাপূর্ণ ভারসাম্যের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতেই পারে । একবিংশ শতকের আধুনিক দুনিয়ায় বন্ধুত্বকে জোরদার করতে হবে ন্যায্য হিস্যা দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে। অন্য কোন রাস্তা খোলা নেই এখানে। শুধু দেয়ার অভ্যাস থাকলে ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যায় না।  আর ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে প্রয়োজন আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সহিষ্ণুতা।  অন্যথায় শুধু দিয়েই যেতে হয়। কারণ সমর শক্তির চেয়ে ঐক্যবদ্ব জাতির শক্তি অনেক বেশি।   

      

আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে থাকাই তাহলে দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেখতে পাই যে, প্রধানত দুটি বা তিনটি রাজনৈতিক দল পালাক্রমে দেশ শাসন করে আসছে ।  এক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া ও মর্যাদার আসনে উন্নীত করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্রমান্বয়ে জবাবদিহিতার কাঠামোতে নিয়ে আসতে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক ধরনের 'লিভ এন্ড লেট লিভ'র  সমঝোতা থাকা চাই ।  যাতে সুযোগ সন্ধানীরা রাজনীতিকদের ক্ষমতাপ্রীতি ও দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ নিয়ে যাচ্ছেতাই খেলা করতে না পারে। আর এতে করেই রাষ্ট্র পেতে পারে একটি আত্মমর্যাদাবান ও অগ্রসর জাতি আর জনগণ পাবে একটি কল্যাণকর মানবিক রাষ্ট্র । 


তবে আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির লড়াইয়ে মগ্ন থাকে, তখন গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার, দুর্নীতি, আইনের শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পরে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তির উচিত বাকসর্বস্ব রাজনীতির বিপরীতে মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির চর্চা এবং গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে নিজ দেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্ভুদ্ব করা । এখানে অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই । অতীত ইতিহাস ঘাটলে এর অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। আর অতি সাম্প্ৰতিক বালির অভ্যুত্থান, বেলারুশের জনআন্দোলন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।


পরিশেষে বলা যায়, অন্য দেশের সাথে দেয়া-নেয়ার মর্যাদা ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্ভর করে সরকারের প্রজ্ঞা ও জনগণের প্রতি দায় ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার উপর। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে চলে না । দেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ সর্বোপরি জনগণেরও নিজের প্রাপ্য আদায়ে সচেতন ও সোচ্চার হওয়া জরুরি । ঘটনার সাক্ষী হয়ে শুধু পর্যালোচনা নয়, যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না।


রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক মহল বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মনে করেন যে, বাংলাদেশ সরকার দেশের কৌশলগত অবস্থান ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রতি আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি সমূহের আগ্রহ ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জাতীয় ঐক্য গঠনে সুবিবেচনার পরিচয় দেবে। এটাই সর্বতোভাবে কাঙ্খিত । 


  • লেখক: ডক্টর এম মুজিবুর রহমান। সংবাদ বিশ্লেষক, সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট। লন্ডন, ২৫ অগাস্ট ২০২০ 


চতুর্থ বছরে রোহিঙ্গা সংকট

সম্পাদকীয়



তিন বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করেছে রোহিঙ্গা সংকট। পরিতাপের বিষয় হল, এ দীর্ঘ সময়েও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনোরকম অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জানা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতিমূলক সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে মিয়ানমার।

অবশ্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেই ছয় লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশের একক প্রচেষ্টায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, এ ভাবনা ভুল।

তারা মূলত দুটি বড় আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুঃখজনক হল, এ দুটি দেশ কার্যত কোনো চাপ না দিয়ে কেবল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে মিয়ানমারকে, যা মোটেই যথেষ্ট নয়। কূটনীতিকদের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ফলপ্রসূ করতে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ জরুরি। তা না হলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে।

প্রত্যাবাসন একটি জটিল প্রক্রিয়া, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রত্যাবাসনের সুযোগ নেয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মিয়ানমার সরকারের বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ইতোপূর্বে জানা গিয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সুশাসন ও আইনি পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপের আওতায় উত্তর রাখাইন রাজ্যে যাতে কোনো ধরনের বৈষম্য না হয়, সেজন্য স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশকে নির্দেশনা প্রদানের কথা জানিয়েছিল দেশটি।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে গৃহীত বাস্তব কোনো পদক্ষেপ আমরা লক্ষ করিনি। এটি সহজেই বোধগম্য যে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে বিপদ মাথায় নিয়ে রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরতে চাইবে না।

ফিরে গেলেও পুনরায় নিগৃহীত হলে এবং তাদের ওপর হামলা হলে তারা আবারও এ দেশে পালিয়ে আসবে। কাজেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পাশাপাশি সেদেশে তাদের নিরাপদ বসবাসের পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। এজন্য রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে মিয়ানমার যাতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়টির ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়াও বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানো হয়। বর্বরোচিত নির্যাতনের ফলে ওই সময় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অতীতে আসা রোহিঙ্গাদের বড় অংশ এখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি। গত কয়েক দশকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দীর্ঘসূত্রতা ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মিয়ানমার সরকার যাচাই-বাছাইসহ অন্যান্য অজুহাত তুলে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যাতে গড়িমসি করতে না পারে, এ ব্যাপারে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত ও চীন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটাই প্রত্যাশা।

  • কার্টসি - যুগান্তর/ আগস্ট ২৬, ২০২০ 

Wednesday, August 19, 2020

দেশনেত্রির জন্মদিন ১৫ ই আগস্ট

— সৈয়দ ইজাজ কবির


দেশনেত্রী  আনুষ্ঠানিক নাম ছিল খালেদা খানম এবং আজ তিনি বেগম খালেদা জিয়া। বেগম জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 

প্রায় দুই দশক ধরে তার বিরোধীরা, বিশেষত রাজনৈতিক শত্রুরা তার জন্ম তারিখ নিয়ে অযৌক্তিক এবং প্রায়শই নির্দয়ভাবে সমালোচনা করেছেন। তবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের দ্বারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পরে ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়ার আসল প্রোফাইলটি প্রকাশিত হয়, সেখানে তার জন্ম তারিখ ১৫ আগস্ট বলা আছে এবং তখন কিন্তু সমালোচকরা জন্মের তারিখ নিয়ে প্রশ্ন করেননি। সম্ভবত তারা তখন  নির্বাচনের পরাজয়ের ধাক্কায় কাটিয়ে উঠতে পারেনি যা তাদেরকে তখন  তার প্রোফাইলটি যাচাইয়ের জন্য উৎসাহিত হতে ভুলে গিয়েছিলেন। 

প্রাক্তন এমপি এবং পরে বেগম জিয়ার প্রেস সেক্রেটারি আহমেদ নাজির বলেছিলেন যে জন্ম তারিখটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ  আসে না। তিনি বলেছিলেন: "... যখন বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন, আমি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস) এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের কাছে প্রোফাইলটি প্রকাশ করেছি। যারা জন্মের তারিখকে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রশ্ন করেন, তারা তাকে রাজনৈতিক ভাবে অবজ্ঞা করার জন্যেই অপপ্রচার করে যাচ্ছেন”। 


সৈয়দ ইজাজ কবির

১৯৬০ সালে বেগম জিয়া দিনাজপুর সরকারী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেন এবং দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৩ সালে ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর প্রথম জীবন পড়াশোনা করেন সেন্ট জোসেফ কনভেন্টে , সেখানে তিনি পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন এবং চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।


তিনি বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ, এবং সম্ভবত গ্লোবাল স্কেলে, যিনি ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৩ টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং কোনটিতেই প্রতিপক্ষ উনাকে হারাতে পারেননি। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন নারীর তালিকায় ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০০৪ সালে বেগম খালেদা জিয়া ১৪ তম, ২০০৫ সালে ২৯ তম এবং ২০০৬ সালে ৩৩ তম স্থানে ছিলেন। ২৪ শে মে ২০১১-তে উনাকে  যুক্তরাষ্ট্রর নিউ জার্সির সিনেট দ্বারা ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি হিসাবে ভূষিত করা হয়েছিল। উনাকে তাঁর  অনুগামীরা ভালবাসার সাথে দেশনেত্রী বলে  অভিহিত করেছেন। তিনি ফুল খুব পছন্দ করেন।  জন্মদিনে আমার নেত্রি বেগম খালেদা জিয়াকে ফুলেল শুভেচ্ছা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। 


  • লেখক  আইনজীবি ও রাজনৈতিক কর্মী

Saturday, August 15, 2020

ফ্যাসিজম হচ্ছে সাপের মতো যে নিজের লেজ খাওয়া শুরু করেছে

— জিয়া হাসান 

জিয়া হাসান 
ইন্ডিপেনডেন্ট রিসার্চার 

ফ্যাসিজম হচ্ছে একটা সাপের মত যে এখন নিজের লেজ খাওয়া শুরু করেছে। সে সাপ নিজের লেজ খেতে খেতে যখন তার মুখের কাছে চলে আসবে তখন সে নিজেকে নিঃশেষ করবে। আজকে যারা জামাত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জ্বলন্ত কড়াই থেকে ফুটন্ত উনুন, ইত্যাদি তত্ত্বের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার পরে তুলনাহীন লুটেরা, মিথ্যাচারী, লজ্জাহীন, ভোটডাকাত সরকারকে নৈতিক বৈধতা দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে এই রাষ্ট্রের পরিষ্কার একটা কমপ্লিট পতন দেখতে বেঁচে থাকবেন। কারণ ফ্যাসিজম হ্যাজ এ প্রাইস টু বি পেইড এবং সরি টু সে এই মূল্য এই দেশের জনগণকেই দিতে হবে এবং এলিট হিসেবে আপনি নিজেও পার পাবেন না।

অনেকে শুনে অবাক হবেন! আমি মনেকরি বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় আসলে ডিজাসট্রাস হতো। আপনি মনে করতে পারেন আমি নিজেকে বা আপনাদেরকে ভুল বুঝচ্ছি, ‘আঙ্গুর ফল টক’ বলে। না। আমি এটা অনেক বন্ধুকে সামনা সামনি আলাপে বলেছি কিন্ত সোশ্যাল মিডিয়াতে অবভিয়াস কারণেই এতো দিন বলি নাই।

আমি মনেকরি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার একটা সিঙ্কিং শিপ। সিঙ্কিং শিপের ক্যাপ্টেন চেঞ্জ করতে হয় না।

এবং এই সরকার যখন ডুববে তখন যে ক্ষমতায় থাকবে, তাকে সেটার দায় নিতে হবে। একটা সুন্দর কম্পিটিটিভ, পরিশ্রমী, পিছিয়ে পড়া কিন্ত উন্নয়নশীল দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ধ্বংস করে, শুধুমাত্র এলিটদেরকে ক্ষমতার লেজিটিমেসি ধরে রাখার জন্যে রেন্ট দিয়ে ধ্বংস করার পুরা দায় আওয়ামী লীগের এবং এই ধ্বংসের পুরা সময়টা আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা উচিত।

এ-সরকারের যে সব কর্মচারী আমলা তাদের বেতন বৃদ্ধি এবং সুযোগ সুবিধা দেখে মনে করছেন, এই ফ্যাসিস্টদের সাপোর্ট দিয়ে গেলে আপনার সনই সনই উন্নতি হতে থাকবে, ইউ উইল লিভ টু সি দিস ডে যে সরকার আপনাদের বেতন দিতে পারছেনা।

এবং সেই ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিসে যখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেয়া যাবেনা, ব্যাঙ্কে জমিয়ে রাখা সঞ্চয়, পেনশনের টাকার ভ্যালু, সঞ্চয়পত্রের ভ্যালু যখন হুট করে ২০%-৩০% নেমে যাবে, এক লাখ টাকার সঞ্চয়ের দাম যখন ৭০ হাজার টাকা হয়ে যাবে, হুট করে তাতে যে ক্রাইসিস হবে সেই ক্রাইসিসটার পুরা দায় আওয়ামী লীগরে নিতে হবে। এবং ঐ দিন আওয়ামী লিগেরই ক্ষমতায় থাকা উচিৎ, অন্য কারো নয়।

আমি কখনোই দেশের কোন অবনতিতে খুশী হই না। কিন্ত আমি সত্যি মনেকরি বাংলাদেশের ওই ক্রাইসিসটা যত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে তার পূর্বে ধ্বংস তত কম হবে। কারণ, ক্রাইসিসটা না হলে এই জাতি উপলব্ধি করতে পারবেনা, যথেষ্ট উৎপাদন না করে বিলালে রাজার ধন ও শেষ হয়ে যায়।


স্বাধীনতার পরে এতো গুলো বছরে আমাদের আসম কিবরিয়া সাহেব, সাইফুর রহমান সাহেবের মত খুবই মিতব্যয়ী কিছু অর্থমন্ত্রীদের কারণে, আমাদের সকলের সম্মিলিত স্যাক্রিফাইসের কারণে  যে সভ্রেন ঋণের সক্ষমতা হয়েছে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো বাংলাদেশির বাবা মা পরিবার থেকে দূরে থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে রিজার্ভ হয়েছে — সেই গুলাকে ফু দিয়ে দুই বছরে নাই করে দিয়ে এবং সভ্রেন ঋণের সক্ষমতায় প্রতি বছর ৭/৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে সেই ঋণের টাকায় ঘি খেয়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১৪ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে, সবাইকে লাখ লাখ টাকার গাড়ি কিনার লোন, বাসা কিনার লোন দিয়ে, এক কোটি টাকার খরচ ১০০ কোটি টাকায় সরকারের ফিনান্সের যে বারোটা বাজানো হয়েছে, ক্রাইসিস নিজের দোরগোড়ায় না আসলে — সেটা এই সিস্টেমের সুবিধাভোগীরা উপলব্ধি  করতে পারবেনা।

তাদের নিজের চোখে যখন দেখবে, এই সরকার তার বেতন পেনশনের টাকা দিতে পারছেনা তখন সে বুঝবে — নিজের হাতে তৈরি করা ফ্যাসিবাদ কিভাবে তার গলায় ফাঁস হয়েছে।

এই ক্রাইসিস আওয়ামী লীগের তৈরি এবং আওয়ামী লীগের হাতেই সেই পতন হওয়া উচিত। সিঙ্কিং শিপের ক্যাপ্টেন চেঞ্জ করতে নাই।

তাই এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা পরিবর্তন কোন মতেই কাম্য ছিল না।

এখন এটা ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির প্রতি কোন ভালোবাসা থেকে বলছিনা।

তাদের সাথে অল্প কিছু মেশার ফলে এবং তাদের ইশতেহার দেখে আমার মনে হয়েছে এই ক্রাইসিস সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা তাদের নাই এবং তাদের মধ্যেও এই সিস্টেমের বেনেফিসিয়ারিদের পেট মোটা করে যাওয়ার একটা মেন্টালিটি আছে।

এবং এই সিস্টেমের বেনেফিসিয়ারিরাও তাদের উপরে চাপ দিত — শেখ হাসিনা আমাদের খুশি রাখছে এতো দিন, তুমি পারতেছোনা তাই তুমি ব্যর্থ। আমার ধারণা ক্ষমতায় আসলে, তারা ক্রাইসিসটা মিস-ম্যানেজমেন্ট করে আরো তরান্বিত করতো। ক্ষমতা না পেয়ে তারা বেচে গেছে।

সেকেন্ড আরেকটা জিনিস হলো, ‘বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো’। এলাকায় এলাকায় আওয়ামী মাস্তান। পুলিশের নীচের স্তরে পুরো ছাত্রলীগ যারা একেকটা থানায় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়ে মানুষকে নির্যাতন করছে এবং অত্যাচার অনাচার করে দেশের আনাচে কানাচে মানুষের সম্পদ লুট করে নিচ্ছে এবং ক্ষমতার সকল লেয়ারে আওয়ামী লীগের খাই খাই লোক জন, মিডিয়াতে তাদের লোক জন এবং ফ্যাসিজমের নৈতিক বৈধতা দিতে কালচারাল এস্টাব্লিশমেন্ট এর সব কিছুকে ন্যাচারলি আপ-রুট করা যাবেনা। এই টাকে আপ-রুট করতে বড় কোন ক্রাইসিস লাগবে।

যারপরে সকলে উপলব্ধি করতে পারবেন, সিস্টেমের একটা হোলসেল সংস্কার লাগবে। সেই শকটা না খাইলে এই সিস্টেমের কোন সংস্কার করা যাবেনা।

ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির নিজ থেকে লিডারশিপ দিয়ে ভিশন দেখিয়ে সেই সংস্কার করে সিস্টেমকে লাইনে আনার কোন ক্যাপাসিটি নাই। মরালিও নাই, ফাংশানালিও নাই, ইন্টেলেকচুয়ালিও নাই।

তো ক্ষমতায় না গিয়ে তারা রীতিমত বেচে গেছে। নইলে, এক দিনও শান্তিতে থাকতে দিবোনার নীতিতে, তাদের জীবন আওয়ামী লীগ, সলিমুল্লাহ খান, শাহরিয়ার কবির,  সুলতানা কামাল এবং তাদের অস্ত্রধারী পোষা পাণ্ডারা ফানা ফানা করে দিত।

সো ক্ষমতায় যেতে না পারাটা তাদের জন্যে বিশাল মঙ্গল হয়েছে।

কিন্ত যারা এই ফ্যাসিস্ট রেজিমের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের রেন্ট নিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখছেন,  ইউ উইল লিভ টু সি দিস ডে।

সেই সাপ তার লেজ খেতে খেতে মুখে এসে পৌঁছাবে।

রোহিঙ্গাদেরকে দেখেন। লিবিয়া দেখেন। আপনি সেই স্টেজে যাবেন না তার কোন প্রফেসর নাই।

রাদার - আপনি যেটা সৃষ্টি করবেন, সেটার দায় আপনাকে নিতে হবে। নেচারস ল। প্রকৃতির শাস্তি।

এটা আজকে বোঝা যাচ্ছেনা।

শেয়ার মার্কেটের আগেও আমি বহু বন্ধুকে যখন ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম তারা বলছিল — তুমি তো অনেক কিছু বলছ কিন্ত আমি তো টাকা কামাচ্ছি।

সরি বন্ধু দুনিয়াতে টাকা কামানো অনেক কঠিন কাজ।

সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে ধীরে ধীরে মেরে ফেললে একদিন সেই হাসের ডিম পাড়া বন্ধ হবে।

তখন আপনি মনে করে দেখবেন, কিভাবে লোভ করতে গিয়ে নিজের আম ছালা দুইটাই হারিয়েছেন।

আর ঐক্যফ্রন্ট আর বিএনপির লোক জন, শোকরানা নামাজ পড়েন আল্লাহ আপনাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

  • লেখক ইন্ডিপেনডেন্ট রিসার্চার 


এতিমের প্রকারভেদ এবং ভিভিআইপি এতিম

—  মিনার রশীদ

কিছুদিন  আগে একটি  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ভিসির একটি কাহিনী  ভাইরাল হয়ে পড়েছিল । সেই ভিসি  সাহেব এসএসসি পাশ এক এতিম মেয়েকে  মাস্টার রুলে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন।  দয়া এবং জ্ঞানের সাগর সেই ভিসি মহাশয়  নিজের  ব্যাচেলর বাংলোতে (অফিসিয়াল  স্ত্রী অন্য জায়গায়)   সেই অনাথ মেয়েটির  আশ্রয়েরও ব্যবস্থা করেন। কিছুদিন পর এতিম মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং যথারীতি সাহসিকতার সাথে (এবরশনের চাপ থাকা সত্ত্বেও) একটি সন্তান প্রসব করেন।  এমতাবস্থায় নীতিনিষ্ঠ বিশেষ চেতনাধারী সেই ভিসি সাহেব মেয়েটিকে  কলঙ্কিনী আখ্যা  দিয়ে  সন্তানসহ বের করে দেন। তখন এতিম মেয়েটি স্থানীয় সাংবাদিকদের শরণাপন্ন হন। ঘটনার  চৌম্বক অংশ ছিল মেয়েটিকে বলা  ভিসি সাহেবের মন ছুয়ে যাওয়া   নিবেদনটি , ‘তুমি এতিম, আমিও এতিম ....’।  এই ভাবে দুই এতিম কাছাকাছি  আসায় তৃতীয় এতিমটির  জন্ম হয়। এই কিছিমে ভিআইপি এতিমগণ   পিতৃ পরিচয়হীন সাধারণ এতিমের জন্ম দেন। 

একটি উদাহরণে তিন কিছিমের তিনটি  এতিম রয়েছে বলে ঘটনাটি উল্লেখের লোভ সংবরণ করতে  পারলাম না । দেশে এই কিছিমের  প্রচুর ভিআইপি এতিম থাকলেও ভিভিআইপি এতিম রয়েছে মনে হয় মাত্র  দুজন। এতিমের প্রতি সমাজের এই সহজাত সহানুভূতি শুধু  অর্থ  কিংবা প্রেম ভিক্ষার কাজেই  লাগছে  না — রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ বা টিকে থাকার জন্যেও খুবই  কাজে  দিচ্ছে । 

প্রিয় পাঠক, কারো আবেগকে আহত করার জন্যে নয় — মনের একটা বেদনা থেকেই লেখাটি লিখছি। আমরা সবাই নিজ নিজ এতিমের কান্না নিয়েই ব্যস্ত। সকল এতিমের কান্না কখন আমাদের সকলকে স্পর্শ করবে, জানি না ।  শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার কান্নার রঙ থেকে লক্ষ্মীপুরের ডাক্তার ফয়েজের  মেয়ের কান্না বা বেদনার  রঙ কি আসলেই আলাদা? কিংবা ইলিয়াস আলীর কন্যার কান্নার রঙ থেকে  কমিশনার একরামুলের  কন্যার সেই কান্না, আব্বু তুমি কান্না করতেছো  যে? 

সাধারণ এতিমের কান্না আমাদের কানে ঢুকানো হয় না। ভিভিআইপি এতিমের কান্না বা আহাজারি বার বার আমাদের কানে ঢুকানো হয়। তবে ‘ভিভিআইপি এতিম’ শব্দটি  কেন ব্যবহার করলাম, সেই জবাবের আগে গতকাল বাসস পরিবেশিত সংবাদটির উপর একটু চোখ বুলিয়ে নেন । 

’৭৫ এর ১৫ আগস্ট তাঁর পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই আমরা এতিমদের বেদনা খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারি। কারণ আমরা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এতিম হয়েছি। তোমরা একেবারে একা না। আমরা আছি তোমাদের পাশে। আমি এবং আমার ছোট বোন (শেখ রেহানা) সব সময় তোমাদের কথা চিন্তা করি, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি যখন বলেন, ‘আমি আমার মা বাবা ভাই সব হারিয়েছি’, তখন মনে হয় পাথরের হৃদয়ও বিদীর্ণ হয়ে যায় । 

এতিমদের কথা যিনি এত  ভাবেন, তাদের বেদনা এতটুকু  উপলব্ধি করেন  সেই  তাঁর  সরকারী এবং বেসরকারী বাহিনীর হাতে কতগুলি হত্যা ও গুম হয়েছে তা দেখে  অঙ্ক মিলে না । গত দশ বছরে কয়েক হাজার বিচার বহির্ভূতহত্যা, গুম, হেফাজত কিলিং, সাঈদী ইস্যুতে জামায়াত কিলিং সব কিছু মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা বা গায়েব করা হয়েছে । এর মাধ্যমে কমপক্ষে পনের থেকে বিশ হাজার বনি আদমের সন্তানকে এতিমের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো,   এই ভিক্টিমদের  কারো সাথেই নিজের এতিম হওয়ার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। মজার ব্যাপার হলো, এতকিছুর পরেও উনার ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’  হতে অসুবিধা হয় নাই। 



হায়রে সেলুকাস! কী আজব এই দেশ! এ এক আজব খেলা। সাপ হয়ে দংশন করে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে। এই সব ঘটনার  মধ্যে দুয়েকটি  ভাইরাল হলে  ক্ষণেক  ভাগ্যবান সেই  এতিম বা স্বজন হারারা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র  তাৎক্ষণিক উষ্ণ হাগ বা  সান্ত্বনা উপভোগ করেন।  এরকম হাগ বা সান্ত্বনার গ্যারান্টি থাকলেও বিচারের গ্যারান্টি নেই । এসব কেরামতি দেখে   এটিকে আর কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলে মনে  হয় না — মনে  হয় ব্যান্ডিট কুইন বা ডাকু রাণীর  প্রভাবিত এলাকা।  

বিষয়টি বুঝানোর জন্যে আমি একটি প্লেইনের উদাহরণ টানি । মনে করুন, একজন পাইলট প্লেইন ক্র্যাশে  স্ত্রীপুত্রসহ  নিহত  হয়েছেন। দয়ার্দ্র  পাসেন্জারবর্গ সেই পাইলটের জীবিত কন্যাকেই আবার প্লেইন চালানোর দায়িত্ব অর্পণ করে নিজেরা সেই প্লেইনের যাত্রী হয়েছেন । এই গল্পটি শুনলে সেই প্লেইনের প্যাসেন্জারদেরকে দয়াবান বললেও চরম বেকুব হিসাবে আখ্যায়িত করবেন। বলবেন, এই কাজটি করার আগে ওদের উচিত ছিল সেই কন্যার সাইকোলজিকেল টেsT করা, তার মানসিক বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া। কারণ এমন একটি পারিবারিক ট্রাজেডির পর সেই কন্যার পক্ষে  প্লেইন চালানো তো দূরের কথা, তার পক্ষে মানসিকভাবে স্বাভাবিক  থাকাটাই  অস্বাভাবিক ব্যাপার । মানুষ হিসাবে দয়া দেখানো যেতে পারে, সহানুভূতি দেখানো যেতে পারে কিন্তু কোনওভাবেই দেশরুপী প্লেইনটির চালকের আসনে বসিয়ে নিজ ও জাতির জীবনকে বিপন্ন করা সমুচিন হচ্ছে  না ।  

আমাদের উচ্চ আদালত  যখন  নির্ভয়ে সত্য কথা বলতে পারতো তখন এই কন্যাকে রং হেডেড ঘোষণা দিয়েছিল ।  কারণ সেই ধরণের সিম্পটম দেখিয়ে চলছেন । তা না হলে একজন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে একটি রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ যেমন নির্বাচন কমিশন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন,  বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম,  শিক্ষা ব্যবস্থা এবং অর্থনীতিকে এমনভাবে ধ্বংস করা সম্ভব হতো  না । দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী হিসাবে একজন  প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেশের সকল মানুষের 

(ভিন্ন মতাবলম্বীসহ) জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান করা। সেখানে হাজার হাজার ভিন্ন মতাবলম্বী কিংবা বিরোধীদলের নেতাকর্মীকে খুন গুম করে তাদের মধ্যে দুয়েকজন ভাইরাল এতিম-বিধবা-সন্তানহারাকে ডেকে হাগ করা বা সান্ত্বনার নাটক প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয় ।

জীবনটা হয়ে গেছে অনেকটা বাংলা সিনেমা কিংবা হুমায়ূন আহমেদের হাসির নাটকের  মত । এক পাগলী দাও হাতে নিয়ে গ্রামবাসীকে তাড়া করছে। জীবন বাঁচাতে সবাই ছুটছে। কেউ পেছনে ফেরে তাকাচ্ছে না।   পাগলীর হাত থেকে এই দা কেড়ে নেওয়া বা তাকে নিবৃত্ত করার জন্যে কেউ এগিয়ে আসছে না । 

যে গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব ছিল এই সব বিষয় তুলে ধরা — তাদের কেউ কেউ এই কাজের জন্যে তৈল দিয়ে আকাশে তুলছে । মোজা বাবু, গোলাম সারওয়ারের মত কেউ  কেউ পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাহ্বা দিচ্ছে । জিকে শামীম , শাহেদ , সাবরীনা , পাপলু , ওসি প্রদীপ নিজ নিজ মতলব হাসিল করছে । 

সত্যি মহা বিপদে ও আপদে পড়েছে এই জাতি ।


  • লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


বেগম জিয়া — একদলীয় শাসনের পথে একমাত্র বাধা

— ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তথাকথিত দুই কোটি টাকার মিথ্যা দুর্নীতি মামলার সাজানো রায়ে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক  হিংসার কারণে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২৫ মাসের বেশি সময় পর দুইটি শর্তে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। সেগুলো হলো, এই সময়ে তাঁর ঢাকায় নিজের বাসায় থাকতে হবে এবং তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। কিন্তু, বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপি ও সমমনা জোট তার মুক্তির দাবিতে রাজপথে নানা কর্মসূচি পালনসহ আদালতে বিচারকি প্রক্রিয়ায় জামিনের চেষ্টা করেছে। জামিন যোগ্য মামলায় বারবার তার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে আদালতে। এমনকি সুচিকিৎসার জন্য মানবিক কারণেও তাকে মুক্তি দেওয়া হয় নাই।

 

বেগম খালেদা জিয়াকে, জিয়া পরিবার ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে ধ্বংস এবং রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে ২০০৭ সালের এক এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে-বিদেশে জিয়া পরিবার ও বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে টার্গেট করে এগোতে থাকেন। দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন কল্পকাহিনী তৈরির মাধ্যমে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতন এবং চরিত্র হনন করেন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তার ধারাবাহিকতায় বর্তমান ভোটারবিহীন মিডনাইট অবৈধ সরকার ও তার দোসরা জিয়া পরিবার ও বিএনপিকে জনগনের কাছে হেয়প্রতিপন্ন ও ধ্বংস করার জন্য বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষনা করেন। বর্তমান মিডনাইট অবৈধ সরকার বেগম জিয়া ও তারেক রহমান’র বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির নামে এক পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা করছে। এসবের সাথে সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্র, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মি এবং বর্তমান দালাল মিডিয়ার কিছু অসৎ লোকজন জড়িত। ২০০৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর অনেক চেষ্টা তদবির করেও বর্তমান অবৈধ সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও প্রমান করতে পারেনি। তারপরও অবৈধ সরকার, আওয়ামী লীগ ও দালাল মিডিয়ার অসৎ লোকজনের বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার থামেনি।

 

অক্টোবর ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফর করে এসে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। বিদেশ সফরের বিষয়বস্তু নিয়ে এরকম সংবাদ সম্মেলন একটি চিরাচরিত বিষয়। কিন্তু তখনকার সংবাদ সম্মেলনে লক্ষণীয় বিষয ছিল বিদেশ সফরের বিষয়বস্তুর বাহিরে সাংবাদিকদের প্রশ্ন উত্তর পর্বে ভোটারবিহীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উম্মা প্রকাশ করে দেশের গণমাধ্যমের প্রতি গুরুতর অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার পরিবার সৌদি আরবসহ বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন এবং সেখানে মার্কেটসহ আরো অনেক কিছুতে বিনিয়োগ করেছেন। এসব সংবাদ বিদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশের পরও দেশের তিনটি পত্রিকা ছাড়া আর কোনো পত্রিকা সেই সংবাদ প্রকাশ করেনি। এই অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে শুধু অভিযুক্তই করেননি, রীতিমতো ভর্ৎসনা করেছেন। কিন্তু এই অভিযোগটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অসত্য কল্পকাহিনী। এই মিথ্যা কল্পকাহিনী ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সংসদে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বক্তব্যের মাধ্যমে। সেসময় জাতীয় সংসদে তিনি বলেন, জিয়া পরিবারের ১২টি দেশে ১২শ’কোটি টাকা পাচার সংক্রান্ত গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক (জিআইএন) রিপোর্ট সরকারের হাতে এসেছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে যারা দেশের জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে পাচারকৃত অর্থ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা হবে। এত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দেশের গণমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বলার আগে কেনো প্রকাশিত হলো না। এজন্যেও তিনি গণমাধ্যমকে ভর্ৎসনা করেন। এই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অসত্য কল্পকাহিনী প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভূমিকা যে দু’তিনটি গণমাধ্যম পালন করেছে তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সম্পাদিত দ্য ডেইলি অবজারভার। তারপর থেকে ডেইলি অবজারভার ও সরকারের আজ্ঞাবহ কিছু দালাল মিডিয়া জিয়া পরিবারের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচারের কল্পকাহিনীর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। জিয়া পরিবারের দুর্নীতির এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কল্পকাহিনীর সংবাদের উৎস বলা হয়েছে, আরবভিত্তিক একটি টিভি চ্যানেল জিআইএনকে (গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক) উদ্ধৃত করে এবং কানাডার টিভি চ্যানেল দ্য ন্যাশনাল এই খবর দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইসুতে বাংলাদেশের চেতনাধারী দালাল মিডিয়ার যে সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে শান্তিতে নবেল পাইয়ে দিচ্ছিলেন, সে সাংবাদিক জিয়া পরিবারের দুর্নীতির তথ্যসূত্র হিসেবে ‘আরব নিউজ’ পত্রিকার কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘আরব নিউজসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আরব নিউজের সম্পাদক আল জাজিরার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েও জিয়া পরিবারের টাকা পাচারের কথা বলেছেন। গত সেপ্টেম্বরে দৈনিক জনকণ্ঠ লিখেছিল জিয়া পরিবারের দুর্নীতির প্রমাণ সরকারের হাতে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদেও যা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের পর বিএনপির পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি কাল্পনিক ও অসত্য বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা না চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর উত্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আল জাজিরা এবং গার্ডিয়ান জিয়া পরিবারের দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই সময় সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা জিয়া পরিবারের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের উপর বিশ্লেষণধর্মী ও অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন। তিনি জিয়া পরিবারের দুর্নীতির খবরটির কোনো সত্যতা বা অস্তিত্ব খুজে পাননি। ইন্টারনেটে অনেক  খুঁজে জিয়া পরিবারের দুর্নীতির খবরতো দুরের কথা গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক এবং দ্য ন্যাশনাল নামে কানাডার কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আরব নিউজ, আল জাজিরা এবং গার্ডিয়ান বিভিন্ন পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকেও অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দাবিকৃত জিয়া পরিবারের দুর্নীতি বিষয়ক কোনো সংবাদের লিংক বা অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় নাই।

 

পক্ষান্তরে, দেশিবিদেশি গনমাধ্যমে প্রতিনিয়ত দেশের দুর্নীতি, অর্থ লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচারের খবর প্রকাশিত হয়। গত দশ বছরে শুধু বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে থেকে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লুটপাট, চুরি বা আত্নসাৎ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও কুখ্যাত অর্থ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় সোনালী ব্যাংক। ২০১০ এবং ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের ঢাকাস্থ এক শাখা অবৈধভাবে ৪৫৪ মিলিয়ন ডলার ঋন প্রদান করে। জনশ্রুতি আছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাসেরের তদবিরে ৩৪৪ মিলিয়ন ডলার ঋণ হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামকে দেওয়া হয়। এই ঋণ অবৈধভাবে কোম্পানি ক্রেডিটের কল্পিত, মিথ্যা, জাল ও প্রতারণামুলক চিঠির বিপরীতে ইসু করা হয়। শেয়ারবাজার থেকে ২০১০ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৫,০০০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছে। ইনভেস্টিগেশনে মুল অভিযুক্তর তালিকায় সালমাল এফ রহমান, ফালু, লুৎফর রহমানের প্রতিষ্ঠানসহ আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত কারও নামে বা কোন প্রতিষ্ঠানের নামে সরকার মামলা করে নাই। ডেসটিনির মাধ্যমে ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ৪,১১৯ কোটি টাকা আত্নসাৎ করা হয়েছে। এই অর্থ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত রফিকুল আমীন। ২০১২-২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংক থেকে ৪, ৫০০ হাজার কোটি টাকা আত্নসাৎ বা লুটপাট করা হয়েছে। এই ঘটনার সাথে জড়িত ও মুল অভিযুক্ত ব্যক্তি শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনদলের আশীর্বাদপুষ্ট। বিসমিল্লাহর মাধ্যমে ২০১১-২০১২ সালে দেশের সাধারণ মানুষর ১, ১০০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। খাঁজা সোলায়মান এবং নওরীন হাসিব এই অর্থ কেলেঙ্কারির মুল অভিযুক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী কর্মকর্তা, পর্দার আড়ালের রাঘববোয়াল ও একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই অর্থ লুটপাট এবং চুরির সাথে জড়িত। এসবের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশের দুর্নীতি এবং বিদেশে অর্থ পাচারের সাথে জড়িত সরকারি ও বিরোধী দলের রাঘববোয়ালসহ প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পানামা পেপারস এবং প্যারাডাইস পেপারসে আছে। সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সকল দুর্নীতি, অর্থ লুটপাট ও অর্থ পাচারের তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু, বর্তমান সরকার দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারির মূল নায়ক এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় না নিয়ে উল্টো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এইসব লুটেরাদের ছাড় দিচ্ছে। বিপরীতে, অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তাদের দালাল মিডিয়া জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কাল্পনিক ও অসত্য কাহিনী প্রচার করাচ্ছে। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে জিয়া পরিবার ও বিএনপিকে ধ্বংস এবং রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দুর রাখার জন্য সুপরিকল্পিত বেগম জিয়া ও তারেক রহমান বিরুদ্ধে এক পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের চরিত্র হননের চেষ্টা করছে। এত কিছুর পরও ব্যর্থ হয়ে, ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি ৮ বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে তথাকথিত মিথ্যা দুর্নীতি মামলার সাজানো রায়ে ৫ বছরের জেল এবং দুই কোটি টাকা জরিমানা করে কারাগারা বন্দি করে। গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও ১০ অক্টোবর ২০১৮ তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার মাধ্যমে পুনরায় প্রমাণিত করলো যে, এদেশে কোনো নাগরিকেরই আর সুবিচার পাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়াও, গত ১৩ বছরে বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ, আর তাতে আসামী করা হয়েছে ১৮-২০ লক্ষ নেতাকর্মীকে। বিগত বছরগুলোতে বিএনপির ১২-১৪ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং ৩০০ - ৩৫০ নেতাকর্মী গুম হয়ে এখনো ফিরে আসে নাই। এসব জিয়া পরিবার ও বিএনপির বিরুদ্ধে সম্প্রতি সময়ে দেশে চলমান বিদ্বেষপূর্ণ, ঘৃণ্য, প্রতিহিংসামূলক ও অসুস্থ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। তাই, বিএনপি ছাড়াও দেশের সাধারণ জনগন, অরাজনৈতিক সুশীলসমাজ, জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্র বেগম জিয়ার বিচারের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং বেগম জিয়া ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে তা তারা বিশ্বাস করে। খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দুরে রাখার জন্য বর্তমান অবৈধ সরকার পরিকল্পিত ভাবে এসব করছে। সরকার মনে করেছিল দলের চেয়ারপার্সনকে কারাগারে নিলে তার মুক্তির জন্য বিএনপির নেতাকর্মিরা জ্বালাও, পোড়াও এবং ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করবে এবং দলের ঐক্য বিনষ্ট হবে। বিএনপি চেয়ারপার্সনের নির্দেশ মত বিএনপি দলীয় নেতাকর্মিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বৈরী আচারণ সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ ভাবে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে। বর্তমান অবৈধ সরকার ও সরকারি দল শত চেষ্টা করেও বিএনপিতে ভাঙ্গন ধরাতে পারেনি। এটা বিএনপির এক বিষ্ময়কর সাফল্য। বিএনপি এখন সারা দেশ অনেক বেশি সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ। তাই অবৈধ সরকারের চক্রান্ত সফল হয় নাই। পক্ষান্তরে, কারাবন্দি পর বেগম জিয়া আগের চেয়ে এখন আরও বেশি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী। ৮ই ফেব্রুয়ারি মিথ্যা মামলার সাজানো রায়ের পর বেগম জিয়া দেশনেত্রী থেকে দেশমাতাতে পরিণত হয়েছেন। তিনি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও রনাঙ্গনের যোদ্ধা এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মীনি এবং দেশের জনগণ দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন তিনি জিয়ার আদর্শ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গনতন্ত্রের প্রতীক। শত বাধা-বিপত্তি, জেল-জুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্যে থেকেও তিনি যেটা অন্যায় মনে করেন তার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবেন। তিনি কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি এবং করবেনও না — এটা মানুষের বিশ্বাস। দেশের মানুষ মনেপ্রাণে এটাও বিশ্বাস ও কামনা করে যে, বিএনপির চেয়ারপারসন দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আদর্শকে সমুন্নিত রাখবে এবং মানষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জয়ী হবে।

 

  • লেখক সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র 

ঢাকাবাসির কেন বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা দরকার…

—  রেজাউল করিম রনি


একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার। ঢাকার পরিবেশ করোনার সময়ে বরং  ভাল ছিল। এখন আবার আগের মতো হতে চলেছে। এই ঢাকার পরিবেশ এক সময় এমন ছিল, রাস্তায় বের হলে, চোখ জ্বলা শুরু হতো। প্রায় সবই ছিল, তেলে বা ডিজেলে চালিত যানবাহন। বিশেষ করে ছোট ছোট অটোতে ঢাকা ছেয়ে গিয়েছিল। ধোঁয়াতে শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির রোগীদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল- ঢাকা। ঢাকা হয়ে উঠেছিল- কালো ধোঁয়ার একটা দ্বিপ।  


২০০৪ সালে ঢাকা শহরে ব্যাপকহারে
পরিবেশ বান্ধব যানবাহন চালু হয়

আমি অনেক আওয়ামী মানসিকতার সাংবাদিকদের কাছ থেকেই পারসোনাল  আলাপে বলতে শুনেছি, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিষয়টির ভয়াবহতা জানানো হলে তিনি, পরিবেশ বিষেশজ্ঞদের সাথে কথা বলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেন। তারেক রহমান’র উদ্যোগে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়কে দিয়ে ঢাকাতে ডিজেল চালিত যানের পরির্বতে সিএনজি চালিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা নেন এবং  তা বাস্তবায়ন করতে নানান রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়। পরে বাসগুলোও কিছু কিছু সিএনজি চালিত হওয়া শুরু করে। খরচ কম হওয়াতে প্রাইভেট গাড়িগুলো গণহারে সিএনজি চালিত হতে শুরু করে। ২০০৪ সালের দিকে সিএনিজি চালিত যানবান চালুর জোয়ার শুরু হয়। 

ঢাকাতে যে পরিমান গাড়ি ও লোক বেড়েছে, এই উদ্যোগ না নিলে ঢাকা আরও আগেই হতো মৃত্যুপুরি। এখন, যেমন উন্নয়নের গজবে তলিয়ে যায়, তখন ধুকে ধুকে মরার মতো রোগির সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকতো। যদিও এখনও এই ঢাকা দুনিয়ার অন্যমত নিকৃষ্ট জায়গা। কিন্তু সেই উদ্যোগটা না নেয়া হলে, ঢাকা শশ্মানভূমি হয়ে থাকতো।  

তখন যারা সারাদিন রাস্তায় থাকতো হাচি-কাশির সাথে কালো ময়লা বের হতো। এখনও তেমন থাকলে - ঢাকার অবস্থা কি হতো কল্পনা করতেও ভয় লাগে। 

কিন্তু আজ এইসব কথা বলার কোন উপায় নাই। এই দেশকে যারা গোরস্থান বানাতে চায়। যারা ভয়ের সংষ্কৃতি দিয়ে সব অর্জন নিজেদের করে নিতে চায়। যারা মিথ্যাকেই একমাত্র সত্য হিসেবে চর্চার পথ পরিস্কার রেখেছে তাদের সব কুকর্মও আজ মহান ইতিহাস হিসেবে চর্চা করা হয়। অথচ পলিথিন নিষিদ্ধসহ এই বিরাট উপাকারটি যে দলটি করলো, যেই নেত্রীর হাতে এই বিষয়টি কার্যকর হলো তার প্রতি কোন মনোযোগ নাই। আর তারেক রহমানের নাম নিলে তো ওদের গায়ে মনে হয় ফোস্কা উঠে। বরং এই দরকারী উদ্যোগে তারেক রহমান যুক্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে লীগ ও তাদের পোষ্য মিডিয়া রসগল্প রচনা করেছে। তার পরেও তিনি কোন কথা বলেন নাই। নিজের নাম জাহির করার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করেন নাই। মিথ্যা রটনারও প্রতিবাদ করেন নাই।  উনার কাজ উনি করে গেছেন। 

অন্যদিকে যে, বামরা পরিবেশ রক্ষার নামে সক্রিয় থাকে আর লীগের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু রক্ষা করার যোগ্যতা রাখে না, তারাই  বিএনপির নাম মুখে আনাকে একটা চেতনা ও প্রগতীবিরোধী ব্যপার মনে করে।

তাদের কারণেই দেশে এমন অবস্থা হয়েছে যে, লীগের নাম নিলে সেটা হয়, ইতিহাস চর্চা। আর বিএনপি নাম নিলে সেটা হয়, দেশবিরোধী বা অ-ইতিহাসসুলভ ব্যাপার। এই যে দৃষ্টিভঙ্গিটা, এটা মিডিয়াও ফলো করে এবং ইতিহাসের দখল যার, ক্ষমতাও তার। তাই এই ফ্যাসিবাদ এতোটা আহ্লাদ নিয়ে আরামে টিকে থাকতে পারে। এটার জন্য দায়ি আমাদের  ইতিহাসের আওয়মী করণ। যা আমাদের দেশের মূলধারার মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা জারি করেছে।    

কোন লোক স্বীকার না করলেও এই অবদান সদকায়ে জারিয়া হিসেবে থেকে যাবে। এর উপকারিতা জনগন পাচ্ছে। মানুষ না বললেও এই অবদান থেকে যাবে বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে। 

জুলুমের কালে, খালেদা জিয়ার সুস্বাস্থ্যা ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।