আলী রিয়াজ
খেলাপি ঋণের আবর্তে পড়ে অস্থিরতার তীব্র স্রোতে ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাংক খাত। বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি একাধিক ব্যাংক। সর্বশেষ ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার হদিস নেই। আদায় হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই এই ঋণের। একদিকে আদায় করতে না পারায় নতুন ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে মুনাফায় ধস নেমেছে অধিকাংশ ব্যাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করায় সেখানেও খেলাপের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছে নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো। সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক পরিচালক। যাদের কয়েকজন বেশি বিতর্কিত। এদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং খাত জিম্মি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর (২০১৭) ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ১১ হাজার ২৩৭ কোটি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (মার্চ-জুন) ৭৩৯ কোটি ও তৃতীয় প্রান্তিকে (জুন-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে যোগ হয়েছে আরও প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। বছর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ অবলোপন করা ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত অক্টোবরে দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে ঋণ বিতরণ ছিল ৭ লাখ ৩১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। গড়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণই খেলাপি। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর প্রায় ৮ শতাংশ ঋণই খেলাপি। একই ভাবে কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর প্রায় ২৪ শতাংশ ঋণই খেলাপি। অনিয়ম-জালিয়াতিতে পিছিয়ে নেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতের প্রায় সব ব্যাংকের পরিচালকরা একে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঋণ দেওয়া-নেওয়া করেন। নতুন-পুরান মিলিয়ে দেশে সরকারি-বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংক। এসব ব্যাংক পরিচালকদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। ১৯টি ব্যাংকের পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেশি। একই ভাবে ৯টি ব্যাংকের পরিচালক গ্যারান্টার বা জিম্মাদার হয়ে ঋণ দিয়েছেন আরও ২৩১ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপির চিত্রে দেখা গেছে, এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৩ হাজার ৭২২ কোটি, এবি ব্যাংক ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ২৫৯ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ১৫৫ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩ হাজার ৬৬ কোটি, যমুনা ব্যাংক ৩ হাজার ১৬ কোটি, প্রাইম ব্যাংক ২ হাজার ৯৭৬ কোটি, ব্র্যাক ব্যাংক ২ হাজার ৯৩০ কোটি, পূবালী ব্যাংক ২ হাজার ৭৯৭ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২ হাজার ৩৫৭ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক ২ হাজার ৩০৩ কোটি, এনসিসি ব্যাংক ২ হাজার ১৩৯ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংক ১ হাজার ৯৯০ কোটি, ওয়ান ব্যাংক ১ হাজার ৮২৭ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংক ১ হাজার ৭৮৭ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১ হাজার ৭৪৫ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১ হাজার ৬৬৭ কোটি ও আইএফআইসি ব্যাংকের ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। নতুন কার্যক্রমে আসা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে ঋণ দিয়েছে ৫১৪ কোটি, মধুমতি ব্যাংক ৩৫২ কোটি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ৩৪৯ কোটি, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৩২৫ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ৩০১ কোটি ও ফারমার্স ব্যাংক ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়ম করে ঋণ দেওয়ার দায়ে এনআরবিসি, ফারমার্স ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর খেলাপিদের ঋণের একটি বড় অংশই বর্তমান ও সাবেক ব্যাংক পরিচালক, তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণপ্রস্তাব, অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণের পাহাড় পরিমাণ সংকট পর্যুদস্ত করেছে ব্যাংকিং খাত। বিগত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক নিয়োগ ও ঋণ বিতরণে অনিয়ম-জালিয়াতি বেড়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যরা যেভাবে ঋণ বিতরণ করেছেন তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এখন যে পরিবর্তন করা হচ্ছে তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ। না হলে ব্যাংক খাত পুরো অর্থনীতিকে সংকটে ফেলবে। নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন বাস্তবায়ন হলে তাতেও সংকট বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নল ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো পর্যবেক্ষণ নেই ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এজন্য খেলাপি ঋণ না কমে কেবল বেড়েই চলেছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া যেসব নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও খেলাপে যোগ হচ্ছে। ঋণ অবলোপনের প্রক্রিয়াটি অনিয়মের অন্যতম কারণ। বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছে। তাও সঠিকভাবে করা হয়নি; যা খুবই উদ্বেগের।
No comments:
Post a Comment