আবু হোসেন
গত ১৮ ডিসেম্বর দৈনিক ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় পদ্মা সেতুর ডিজাইন গলদ নিয়ে এক অতি গুরুতর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য থেকে বোঝা যায় যে সরকার তার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার রাজনীতির হুড়াহুড়ির কারণে রাজনীতিকে অর্থনীতির চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে গোটা সেতুর মূল ডিজাইনের ওপর যথামেয়াদি সমীক্ষা শেষ না করার আগেই সেতু নির্মাণ শুরু করায় গোটা সেতুর ভবিষ্যত বিপন্ন হয়ে পড়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা লিপ্সার কারণেই হয়তোবা আবার স্বপ্নের এই সেতু দুঃস্বপ্নের সেতু হতে চলেছে। প্রথম থেকেই এই সেতু রাজনীতির কবলে পড়েছে, বিশেষ করে স্থান নির্বাচন নিয়ে। দূর্নীতির বদনামসহ এই সেতু বিসমিল্লায় গলদ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। আমরা রহস্যময় আচরণ লক্ষ্য করেছি বিশ্বব্যাংকের, আমাদের সরকারের। এখনও তার ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয়নি বলেই দেখা যাচ্ছে। ডিজাইনে গলদ ধরা পড়েছিল প্রথমে সেতুর ১৪টি পায়ার বা স্তম্ভ নিয়ে। এখন সেটির সাথে আর যোগ হয়েছে আরও আটটি স্তম্ভ। মোট ত্রুটিযুক্ত স্তম্ভের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ২২টিতে। সেতুর মোট স্তম্ভের সংখ্যা ৪০টি। দেখা যাচ্ছে, সেতুর অর্ধেকেরও বেশি স্তম্ভ নিয়ে সংশয়। সে কারণেই সম্ভবত সেতুর মূল ডিজাইন প্রণেতা নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান বলছেন সব স্তম্ভের ডিজাইনের গলদই নতুন করে খতিয়ে দেখা জরুরি। কাজ বেড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে খরচও বাড়বে। এ কাজ মূল পরিকল্পনার অতিরিক্ত।
সেতুর প্রকল্প কার্যালয় পড়েছে জিলাপির প্যাঁচে। যে সব জায়গায় ২২টি স্তম্ভ বসবে সেখানে বালুবিহীন কর্দম মাটি পাওয়া যাচ্ছে না। আর সেটা না হলে স্তম্ভ নড়বড়ে হতে বাধ্য। সে ঝুঁকি নেওয়া যায় না। তাই পদ্মা বহুউদ্দেশ্যসাধক সেতু কর্তৃপক্ষ এ অবস্থায় এখন সিএসসি অর্থাৎ প্রকল্প নির্মাণ তত্ত্বাবধায়ক কন্সালট্যান্ট সেতুর মোট ৪০টি সেতুর সবকটি স্তম্ভ সম্পর্কেই ডিজাইন চেক করে কনফার্ম করতে বলেছেন। এই কাজটি গত নভেম্বরের মধ্যেই শেষ করতে বলা হয়েছিল। তবে সেটা এখন অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন এই প্রকল্পের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
সংবাদ সূত্রের বরাতে ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস-এর প্রতিবেদক আরও জানাচ্ছেন নির্মীয়মান সেতুর মোট ৪০টি স্তম্ভের মাঝের ১৪টি স্তম্ভের ডিজাইন গলদের সমস্যা দেখা দেওয়ার বিশেষজ্ঞ প্যানেল সমস্যার যে সমাধান প্রস্তাব করেন সেই অনুযায়ী ডিজাইন চেক করার জন্য প্রকল্প অফিস প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা কনসাল্ট্যান্ট নিয়োগ করে। এই ব্যবস্থাপনা কনসাল্ট্যান্ট হলেন ব্রিটিশ ফার্ম রেন্ডাল। তাদের কাজে শেষ করার ডেডলাইন দেওয়া হয় অক্টোবর । তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, এই কাজটি অতিরিক্ত বিধায় ও রেন্ডাল-এর সে কাজ করার বাধ্যবাধকতা না থাকায় তারা এজন্য আরও সময় চান। তাঁরা জানান, তাঁরা কেবল ১৪টি স্তম্ভের নয় বরং মোট ৪০টি স্তম্ভের ডিজাইনই পুনঃ পরীক্ষা করবেন।
এখানে বলা দরকার সিএসসির-ই এ সমস্যার সমাধান দেবার কথা। কিন্তু তারপরেও কর্তৃপক্ষ রেন্ডালকে অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে কাজের জন্য নিয়োগ দেন। এই পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ আবার মূলধারায় ফিরে রেলান্ডকে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে সিএসসি তথা কোরিয়ান কোম্পানির পুনঃ শরণাপন্ন হন ডিজাইনের প্রহেলিকা সমাধানের জন্য । এজন্য তাঁদেরকে নভেম্বরের আগেই প্রতিবেদন জমা দেবার জন্য বলা হয়। তবে জানা যায় এ বিষয়ে অদ্যবধি কোনো অগ্রগতি হযনি আর সিএসসিও কর্তৃপক্ষকে জানায়নি ডিজাইন চূড়ান্ত করতে কতো সময় নেবে।
সিনিয়র প্রকল্প কর্মকর্তা এবার মূল সমস্যার কথাটি খুলে বলেছেন, এসব সমস্যার সমাধান রয়েছে এই সেতুর চীনা ঠিকাদার জটগুলির বাড়তি ব্যয় বহন ও তাদের সামর্থের জটগুলি খুলতেই এই অতিরিক্ত সময়টা আসলেই দরকার। সমস্যা আসলে বাড়তি টাকার। তিনি আরও জানান , সমস্যার একাধিক সমাধান রয়েছে তবে তা সমাধানে অবশ্যই অন্যান্য জড়িত বিষয়েরও সুরাহা হতে হবে।
সেতু কর্তৃপক্ষের আরেক সুত্রের মতে সমস্যার কোনো আশু সমাধান হচ্ছে না কেননা সিএসসি বা রেন্ডাল উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান চাচ্ছেন নতুন করে মৃত্তিকা টেস্ট বা আরও অন্যান্য সম্পর্কিত টেস্ট করতে। কেননা যেসব সেতু স্তম্ভ নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে তাহলো সকল স্তম্ভের জায়গাগুলির মাটির পরীক্ষা করতে হবে। সেখানে কাদা বা এঁটেল মাটি পেতে হবে। বলাবাহুল্য সর্বশেষ মৃত্তিকার পরীক্ষায় নতুন আটটি স্তম্ভের সমস্যা ধরা পড়ে।
এদিকে, পদ্মা সেতু প্রকল্প এই সেতুর দুই স্তম্ভের ওপর একটি স্প্যান স্থাপন করে মিডিয়ায় তা দেখানো হচ্ছে পদ্মা সেতু শত্র“র মুখে ছাই দিয়ে দৃশ্যমান। নির্বাচনী জয়ের ভিত এভাবেই গাঁথা হচ্ছে। এই সেতুর নির্মাণ কাজ বিগত নভেম্বর অবধি ১২ শতাংশ এবং নদী শাসন প্রকল্পের কাজ ১৫ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। প্রকল্পের মোট কাজে ৫২ শতাংশ এ যাবত বাস্তবায়িত হয়েছে। এ হিসেবে অবশ্য সেতুর প্রবেশ সড়ক ও ভৌত সুযোগ সুবিধে গড়ায় অগ্রগতির আলোকে।
অকল্যান্ডভিত্তিক এএফকম মনসেল ২০১০ সালে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়ণ করে আর তারই ভিত্তিতে চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সেতু নির্মানণের চাক্ষুষ কাজ শুরু করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পে নিয়োজিত সূত্রগুলি আসল গোমর ফাঁস করে জানিয়েছেন, আজকে পদ্মা সেতু নির্মাণে এই যে জটিলতা তার মূল কারণ হলো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া। সেতুর সকল স্তম্ভের বিষয় সবদিকে থেকে পাকাপাকি হবার আগেই সেতুর নির্মাণে তড়িঘড়ি করার কারণেই আজকের এই জটিলতর অবস্থা। বিশ্বজনীন নিয়ম অনুযায়ী, আগে নদীর বিষয়ে বিশদ ও প্রয়োজনীয় জরিপ করা হয়নি। খবরে বলা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ দেশের বৃহত্তম সেতুর নির্মাণ সমাপ্তির জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন ২০১৮তে জাতীয় নির্বাচনের আগে। বিষয়টি স্পষ্টত রাজনীতি প্রভাবিত সিদ্ধান্ত। এটি ভোটারদের জন্য এই সেতুকে তাক লাগানো শো-পিস করতে।
তবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেতুর বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। কেননা এই মেগাপ্রকল্পটির বাস্তবায়নের সময়সীমা ইতিমধ্যে আটমাস পিছিয়ে আছে। ইতিমধ্যে প্রকল্প কার্যালয় আরও বাড়তি ১৪ শত কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছেন কেবল প্রকল্প স্থলে আরও জমি হুকুম দখলের জন্য। মোট প্রকল্প ব্যয় বর্তমানের ২৮৮০০ কেটি টাকা থেকে আরও বেড়ে যাবে।
২০০৭ সালে একনেক এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় ধরে আনুমানিক ১০২ কোটি টাকা। পরে ডিজাইন বদলানোর স্বার্থে সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়াতে ঐ ব্যয় দাঁড়া প্রায় ২০৬ শত কোটি টাকায়। এই বর্ধিত ব্যয় অনুমোদন করা হয় ২০১১ সালে।
- ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে।
No comments:
Post a Comment