Search

Friday, December 29, 2017

হায় হায় ব্যাংকের দায় কার?



কামাল আহমেদ 






ফারমার্স ব্যাংকের মরণদশার দায় কার? এ ব্যাংকটিসহ কথিত চতুর্থ প্রজন্মের নয়টি ব্যাংকের অনুমোদনের সময় (আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদে) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক আতিউর রহমান। রাষ্ট্রীয় মুদ্রাভাণ্ডারের প্রায় শতকোটি ডলার খোয়ানোর কৃতিত্বের অধিকারী এই সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার ২০ ডিসেম্বর বলেছেন, ব্যাংকটিকে বাঁচাতে হলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে (ফারমার্স ব্যাংক বিষয়ে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে, প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭)। কী চমত্কার দায়িত্ববোধ! শুধু রাজনৈতিক নির্দেশনায় প্রচলিত নিয়মনীতিগুলোর বেশির ভাগ উপেক্ষা করে জনসাধারণের কষ্টের আমানত লুটে নেয়ার লাইসেন্স দেয়ার জন্য তার মধ্যে ন্যূনতম কোনো অনুশোচনা নেই। কোনো ধরনের দুঃখপ্রকাশ ছাড়াই তিনি সেই মৃত্যুপথযাত্রী ব্যাংককে বাঁচানোর জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। যার মানে হলো, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের করের টাকা ব্যয় করা, যে টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোটায়।




ফারমার্স ব্যাংকের এ অধঃপতনের জন্য অনেকেই দায়ী করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। আদর্শ গণতন্ত্রে নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীকে এ কেলেঙ্কারির দায় নিতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বর্তমান দুর্দশায় তার ওপর এককভাবে এর দায় দেয়া হলে তা যথার্থ হবে না। এখানে আমাদের স্মরণে রাখা দরকার যে, ব্যাংকিং খাতে এসব অনিয়মের জন্য তিনি সংসদেই তার অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেছিলেন। বেসরকারি খাতে নতুন নতুন ব্যাংক অনুমোদনের প্রশ্নেও তার সরল স্বীকারোক্তি রয়েছে। ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়ার কথা তিনি একাধিকবার বলেছেন। বেসরকারি খাতে প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি বলে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় নতুন ব্যাংকের চাহিদা এখনো আছে এমন ঠুনকো যুক্তিও তার মুখ থেকে আমরা শুনেছি। আরেকটি বহুল আলোচিত ব্যাংক লুটের ঘটনা— বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কাগজে-কলমে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, রাজনৈতিক কারণেই কিছু করা যাচ্ছে না।

ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের শিরোমণি ছিলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর, যদিও ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এর প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাস কিংবা তার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের নামগন্ধও এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্য ফারমার্স বা কৃষককুল রীতিমতো একটি সৌভাগ্যের বিষয়। হয়তো সে কারণেই গ্রামীণ এবং কৃষি খাতকেন্দ্রিক ব্যাংক না হলেও তার ব্যাংকের নাম ফারমার্স ব্যাংক। সাবেক প্রেসিডেন্ট  জিয়ার আমলে যশোরের শার্শা এলাকায় কৃষকদের সেচের সংকট মোকাবেলায় খাল কাটা কর্মসূচিতে তার ভূমিকাই তাকে প্রথম আলোচনায় তুলে আনে।

দ্বিতীয়বার তিনি আলোচনায় আসেন খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সময় জনতার মঞ্চে অংশ নিয়ে। তার নেতৃত্বেই সরকারি কর্মকর্তারা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়, যা দেশের আমলাতন্ত্রের রাজনীতিকরণে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।

তৃতীয় দফায় তিনি আলোচিত হন জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার রায় সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকায়। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তার আসন শূন্য ঘোষিত হলেও একটি রিভিউ আবেদন দায়ের করে তিনি তার সংসদীয় মেয়াদ পূরণ করেন। সে সময়ে তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশের সবচেয়ে প্রাণঘাতী শিল্প দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধসের বিষয়ে তিনি বিরোধী দল বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ধাক্কাধাক্কিতে স্থানীয় যুবলীগ নেতার ভবনটির ভিত দুর্বল হয়ে পড়ার কথা বলে সমালোচিত হন।

২০১৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পত্রিকা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের কাঁথা থেকে প্রাচুর্যে উত্তরণের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মহীউদ্দীন খান আলমগীর নির্বাচন কমিশনে তার সম্পদ বিবরণীতে ৩ কোটিরও বেশি নগদ টাকা থাকার কথা জানিয়েছেন। তিনি ফারমার্স ব্যাংকের অনুমতি পান ২০১৩ সালে এবং ব্যাংকটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে ২০১৪ সালে। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ঋণ দেয়ায় অনিয়মের বোঝা অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং ব্যাংকটি আমানতকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার সামর্থ্য হারায়। এখন ব্যাংকটি তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতেও অক্ষম হয়ে পড়েছে। বছরখানেক ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর্যুপরি তদন্ত, জরিমানা ও পর্যবেক্ষক নিয়োগেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে
উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।

সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হতে থাকলে মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বভাবসুলভ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তা অস্বীকার করে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন, পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ নিয়ে এবং বাজার থেকে বন্ডের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিজেদের রক্ষায় জোর তদবির চালান। কিন্তু তার সীমাহীন অর্থলিপ্সার কারণে এবার আর কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা মেলেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক অটল থাকতে পেরেছে। ফলে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। আর ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম শামীমকে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র সাতদিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদ থেকে অপসারণ করে।

ফারমার্স ব্যাংক ঘিরে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে আরো দুটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। প্রথমত. তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাবান একটি অংশ, সরকারি হিসাবসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে যখন তার ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত করছিল, তখন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম তদন্তের উদ্যোগ নেন। স্পষ্টতই সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত সত্ত্বেও তিনি এ উদ্যোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তটস্থ রাখতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশে অবশ্য স্বার্থের সংঘাত বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত. ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর তিনি ব্যাংকে তার অংশীদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টায় আরো শেয়ার কিনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন। এখানেও তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তিনি জানেন যে, সরকার ব্যাংকটিকে রক্ষা করবে। এতে ভবিষ্যতে তার সম্পদ ও নিয়ন্ত্রণ আবারো বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে। তার এ চেষ্টার আরেকটি তাত্পর্য হচ্ছে, তিনি মোটামুটি আশ্বস্তবোধ করছেন যে এ ব্যাংক কেলেঙ্কারির কারণে তাকে জেলে যেতে হবে না।

বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যাংকিং আইনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা জনসেবক বা পাবলিক সারভেন্ট। পাবলিক সারভেন্ট হিসেবে অনৈতিক কাজের জন্য যেসব শাস্তির বিধান আছে, সেগুলো তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়ার কথা। সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কারো কারো এরই মধ্যে আশ্রয় হয়েছে জেলে, নয়তো তারা পলাতক। তাহলে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন? তার দলও এ বিষয়ে নিশ্চুপ। সংসদের ওই অতীব গুরুত্বর্পূণ ও ক্ষমতাধর কমিটি থেকেও তাকে অপসারণ করা হয়নি।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরেই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলে আসছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয়ও রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালকরা বাণিজ্যিক যৌক্তিকতার চেয়ে দলীয় ও গোষ্ঠীস্বার্থে ঋণ বিতরণ করেই অভ্যস্ত। ফলে সেগুলোও সংকটের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে একাধিকবার পূরণ করা হয়েছে মূলধনের ঘাটতি। বেসরকারি খাতের
ব্যাংকও এখন আর অনিয়মের পাল্লায় পিছিয়ে নেই। ফারমার্স ব্যাংক একা নয়, এ ধারায় আছে রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠা পাওয়া অন্য ব্যাংকও। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয়ে অনুমোদন পাওয়া উদ্যোক্তাদের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকও পরিচালনা পর্ষদ রদবদল ঘটাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু কেলেঙ্কারির মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। এসব হায় হায় ব্যাংকের দায় কার?

  • [কামাল আহমেদ-এর ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত নিবন্ধ]



No comments:

Post a Comment