ধীরাজ কুমার নাথ
সাম্প্রতিককালে ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে প্রচুর বিপর্যয়ের দুঃসংবাদ, দুর্নীতির উদাহরণ, অব্যবস্থাপনা ও অসুস্থ পরিচালনা এবং নতুন আইন প্রণয়ন নিয়ে বিভিন্ন খবরাখবর জনগণের মনে নানা সংশয় ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়া বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ব্যাপারে আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এছাড়া এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান মুজিবর রহমানকে ৬ ডিসেম্বর ব্যাংলাদেশ ব্যাংক পদচ্যুত করেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ আদেশে মুজিবর রহমানকে দুই বছর অন্য কোনো ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। আরো উদাহরণ হচ্ছে, অগ্রণী ব্যাংকের সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে পদচ্যুত করা হয়েছে বেসিক ব্যাংকের এমডি কাজী ফকরুল ইসলামকে। আরো খবর হচ্ছে, তদন্তে ধরা পড়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান, যিনি কোম্পানি আইন ভঙ্গ করে প্রায় ৪৪ কোটি টাকার সুবিধা গ্রহণ করেছেন ব্যাংকের দুজন স্পন্সর পরিচালকের কাছ থেকে।
মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন সাহেব এবার বিদায় নিয়েছেন বা বাধ্য হয়েছেন চলে যেতে। আরো অনেক কাহিনী আছে, যা বলে শেষ করা যাবে না অথবা জনগণের দৃষ্টির আড়ালে সংঘটিত হচ্ছে। সহজ কথায় বলা যায়, ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ জন্ডিজে আক্রান্ত, চরমভাবে অসুস্থ, জরুরিভাবে এর চিকিত্সা আবশ্যক।
মাসুক হেলাল/প্রথম আলো |
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সরিয়ে ফেলার কাহিনী এবং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন দুর্বলতা দেশবাসীকে হতাশ করেছে এবং সরকারকে করেছে বিব্রত। তেমনি সোনালী ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট জনগণ সহজভাবে মেনে নেয়নি, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেনি সত্যি, কিন্তু অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বিচরণকারীরা কোনো দিন ভুলবে না। এসবের জন্য কারা দায়ী, হয়তোবা বিবিধ কারণে প্রকাশ্যে আসবে না; কিন্তু জনগণের জিজ্ঞাসা বা উৎকণ্ঠা কি কোনো দিন নিরসন হবে?
এমনসব খবর দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছে এবং দেশের সাধারণ জনগণ সর্বত্র এমন সংবাদ নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনা করছে। সারা দেশে এমনকি গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে প্রকাশ্যে আলোচনা করছে বিভিন্ন স্তরের লোকজন। নতুন প্রজন্ম তাদের ফেসবুকে এসব খবর নানাভাবে পরিবেশন করে সারা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কল্পকাহিনী রচনা করছে, যা সুস্থ অর্থনীতির জন্য অনভিপ্রেত। জনগণের বিশ্বাসে ও আস্থায় ফাটল ধরলে তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না।
সততা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে জাতীয় পর্যায়ে ভয়াবহ দুর্বলতার চিত্র দেখে দেশের সুশীল সমাজ আতঙ্কিত হচ্ছে, অসুস্থ ব্যাংকিং খাত বা অর্থনৈতিক অঙ্গন নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়েছে দেশবাসী। অনেকের প্রশ্ন, শুদ্ধাচারের সংকটে মুহ্যমান এ অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল বাংলাদেশকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে পরিণত করতে পারবে কীভাবে?
অথবা এমন পরিস্থিতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন কীভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে?
দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৭টি ব্যাংক আছে, যার মধ্যে ৯টি বিদেশী। এছাড়া আছে ৩৫টি নন-ব্যাকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন— ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন ইত্যাদি। শোনা যায়, আরো প্রায় তিনটি তফসিলি ব্যাংক এবং কয়েকটি লিজিং কোম্পানি নতুনভাবে আসছে সরকারের অনুমোদন নিয়ে। অনেকের ভাবনা, এত অধিকসংখ্যক ব্যাংক বিরাজমান দুর্বল আর্থিক পরিমণ্ডলে আরো বেশি বিপর্যয়ের সূচনা করতে পারে।
বেশির ভাগ মানুষ, যারা অর্থনীতি নিয়ে ভাবে বা অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করে, তাদের অভিমত হলো— অনেক হয়েছে, আর নয়। কারণ দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলো এখনো ভালোভাবে দাঁড়াতে পারেনি। গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের দুয়ারে ব্যাংকিং সেবাকে এখনো নিয়ে যেতে পারেনি। কারণ মফস্বল এলাকায় ব্যাংকের ব্রাঞ্চ স্থাপন ও সেবা প্রদান অলাভজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ লক্ষ্য হচ্ছে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দেশের সব জনগণকে পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসা। বর্তমানে দেশে এলাকাভেদে ঊর্ধ্বে মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ লোক ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আছে। সারা দেশে ক্যাশলেস বা নগদ টাকাবিহীন লেনদেনের পরিমণ্ডল রচনা করতে হবে এবং অনুরূপ সমাজ ও ভাবনার উত্তরণ ঘটাতে হবে। প্রতিটি লেনদেনের সুস্পষ্টতা থাকবে এবং তা দৃশ্যমান হতে হবে।
ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থ পাচার বা হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ নিয়ে জনগণের মনে একটা বিরাট সন্দেহ বিরাজ করছে, যা উপশম হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া কিছু ব্যাংক আছে, যারা বাংলাদেশেই জঙ্গিবাদকে অর্থায়ন করে বলে অনেকের বিশ্বাস। তার কারণ হলো, হলি আর্টিজানে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, সেখানে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল এবং তা কোনো এক ব্যাংকের মাধ্যমে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে এবং তার প্রমাণও মিলেছে বলে শোনা যায়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের জনগণ মনে করে, অসুস্থ ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা বিরাজমান থাকা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এর উত্তরণ ঘটাতে হবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।
অনেকে মনে করেন, এমন অব্যবস্থাপনার জন্য প্রধানত দায়ী ব্যাংকের পরিচালকমণ্ডলী। অথচ বলির পাঁঠা হচ্ছেন সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যে খুব কমসংখ্যকের ব্যাংক পরিচালনা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আছে। মুনাফা অর্জন তাদের মুখ্য বিষয়, ব্যাংকের সুনাম ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে তারা অসতর্ক। লোক নিয়োগে তারা যেমন প্রভাব বিস্তার করে, তেমনিভাবে ঋণ প্রদানেও কোলেটারেল সিকিউরিটি ছাড়াই ঋণ ও অগ্রিম দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে, যা অনেক ক্ষেত্রে এমডি এবং অন্যান্য কর্মকর্তা প্রতিবাদ করার সাহস পান না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নীরবে সম্মতি দিয়ে দেন এবং এখানেই শুরু হয় ব্যাংকের তারল্য সংকট, ঋণ আদায়ে
অপারগতা, ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ক্রমাগত। সমস্যা ও সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প পন্থা হিসেবে দুর্বৃত্তায়নের আশ্রয় নেন এসব কর্মকর্তা। তাই পরিচালকদের যোগ্যতা, মেয়াদকাল এবং একই পরিবারের সদস্যদের পরিচালক পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত করা ও দীর্ঘদিন চলতে দেয়ার বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রয়োজন দারিদ্র্য বিমোচন, সবার জন্য এবং সব বয়সের লোকের জন্য স্বাস্থ্য, নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে দৃশ্যমান অর্জন। মোট ১৭টি লক্ষ্য ও ১৬৯টি টার্গেট অর্জনের সব পর্যায়ে প্রয়োজন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা। শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা বিধান থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে নিয়োজিত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাই আর্থিক শৃঙ্খলা এবং প্রত্যেক লেনদেনের জবাবদিহিতা। এ দায়িত্ব পালন করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে অত্যন্ত কঠোরভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে সব ব্যাংক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনে অধিকতর নিষ্ঠাবান হতে হবে। তাই প্রয়োজন হবে নিবিড় তদারক ব্যবস্থার আরো অধিক উন্নতি সাধন এবং ঋণ প্রদান ও ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ, আর্থিক বিধিবিধানের অধিকতর সংস্কার।
লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও সোনালী ব্যাংকেই ঋণখেলাপির আনুপাতিক হার বেশি বা অনাদায়কৃত ঋণ পরিশোধের সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ করার প্রবণতা অধিক। এর অর্থ, এখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে। যে কারণে ঋণগ্রহণকারী রাজনৈতিক প্রভাববলয় বিস্তার করে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতাকে আমলে নিচ্ছেন না, জেল-জরিমানার ভয় করছেন না।
ব্যাংকিং খাতে একটি ভয়াবহ ব্যর্থতা হচ্ছে, ব্যাংক ডাকাতি বা ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে আমানতকারীদের অর্থ লুটপাট করা। বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন ব্যাংকে বহুবার কিন্তু কঠোর শাস্তি প্রদানের উদাহরণ বিরল। অনেকের ধারণা, এর সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকা অসম্ভব কিছু নয়। প্রত্যেক ব্যাংকে বিষয়টির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে।
পরিশেষে বলতে হয়, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা বিধান প্রগতিশীল দেশের প্রধান শর্ত। এ খাতে শুদ্ধাচার প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে দেশের অগ্রগতি অবশ্যই বিপদসংকুল হতে বাধ্য। এছাড়া জনগণের পবিত্র আমানত ও অগাধ বিশ্বাসের ক্ষেত্র হচ্ছে ব্যাংক এবং অন্যান্য অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে রাষ্ট্র পরিচালনায় সংকট দৃশ্যমান হতে বাধ্য এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
- লেখক: সাবেক সচিব
- কার্টেসি - বণিকবার্তা
No comments:
Post a Comment