Search

Friday, December 29, 2017

মুক্তিযুদ্ধ - ‘সংখ্যা বাড়ছে পাটীগণিতে, সম্মান কমছে জ্যামিতিতে'


বিএনপি কমিউনিকেশন  




কিছুদিন আগে দৈনিক প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় প্রধান সংবাদ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে জামালপুরের মেলান্দহের মুক্তিযোদ্ধা আাবুল হোসেন ইউএনও-র কাছে লিখিত আবেদন জানান এই বলে যে তাঁর নামের আগে যেনো ‘বীর’ মুক্তিযোদ্ধা  আর যেন না লেখা হয় আর তাঁর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের প্রয়োজন নেই। তাঁর মোদ্দা কথা তিনি ভেজালদের অন্তর্ভূক্ত থাকতে চান না। আর আরেকজনের অনুরোধ, যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের পর ভুমিষ্ঠ হয়েছেন , সে জন্য তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে সরানো হোক।

খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা  আবুল হোসেন  মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের জাল-জালিয়াতির প্রতিবাদ জানাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অমৃত-গরল মিলেমিশে একাকার হওয়ার আশঙ্কা তাঁর। যে দেশ কিনেছিলেন তাঁরা জীবনের বাজি রেখে কিংবা রক্তের বিনিময়ে পণ্যের মূল্যে এখন সেটা টাকায় বিকিয়ে যাচ্ছে। এটা কোন চেতনা? এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ  টাকা দিয়ে অনেকেই কিনেছেন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট।

একথাও নিখাদ সত্য সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনীতির পণ্য করে তুলেছেন। এই তিক্ত সত্যও  অস্বীকার করার উপায় নেই অনেকেই এরকম ‘পণ্য’ হতে পেরে ধন্য। সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখায় বাংলা ভিশনের বার্তা সম্পাদক  গোলাম মোস্তফা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সব সরকারই ‘গণিত উৎসব’ করেছেন। এসব উৎসব উৎপাদিত ও এর কারণে উৎসাহিত হয়েছে সুযোগ সন্ধানীরা। তারা নানা কৌশল বের করেছে। কেইবা ম্লেচ্ছ ইতর থাকতে চাইবে? স্বাভাবিক কারণেই তারা ব্রাহ্মণ হবার উপায় বাগিয়েছে রাজনীতিকদের হাত ধরেই।  কেন?  রাজনীতিকরা শহীদদের বরাবরই দূর থেকে তাদরেকে খুরে নমস্কার করেছেন। তবে তাদের সংখ্যার ওপর জরিপ চালাতে সচেতনভাবেই বাধাও দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে বলে?  কিন্তু এই সব কর্তৃপক্ষই আবার জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেই অতিমাত্রায় উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। আর বারংবার সেসব উৎসবের মধ্য দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার বহর বেড়েছে। কিন্ত কি জন্য এই স্ফীতি সে কথা ঘেঁটে বলেননি। এর আদত কারণটি হলো মৃতদের রাজনৈতিক পণ্য হবার সাধ্য নেই। পণ্য হবার সাধ্যও নেই। তাই রাজনীতিকরাই ‘পণ্য’ সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছেন আর কেউ নয়।

একটি প্রবণতা দৃষ্টিকটুভাবে খুবই লক্ষ্যণীয়। যখনই চলতি সরকারের গলদ উল্লেখ না করে পারা যায় না তখনই বিএনপি সরকারের দোষ টেনে আনার  ব্যালান্সিং-এর প্রবণতা। বিএনপি সরকারও এ দোষ করে থাকতেই পারে। কিন্তু কাপুরুষ মানসিকতাই কেবল পান্তাভাতে ঘি ঢেলে মূল কথাটাকে ডাইলিউট করে। পেছনে যদি যেতেই হয় তাহলে আরেকটু এগোলেই তো বিষয়টার ঝাঁপি ‘হাট’ করে খুলে যায়। আমরা সবাই চোখে যা দেখছি সেটা দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি পেছনে কি তাকাই না। আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের কি করে একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। গেছেন ওসমানী, খালেদ মোশাররফ-হায়দার, কোনমতে বেঁচে আছেন ভাইস মার্শাল একে খোন্দকার, সেক্টর কম্যন্ডার আবু ওসমান চৌধুরি ও আরও অনেকে। যখনই যাকে দরকার হচ্ছে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ফেলে দেওয়া হচ্ছে হাতের টিস্যু পেপারের মতো নিতান্ত অবহেলায়। অবলীলায়।  কেন? রোজ রোজই তরুণ রক্ত দরকার হচ্ছে জরাগ্রস্ত মনোলিথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।

আর এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে জনগণের অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযোদ্ধাদের। এই মুক্তিযোদ্ধাদের কাজেও লাগিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া গোড়ায় দেশ গঠনে। পাকিস্তান ফেরত হাজী, এখন সরকারের বিশেষ দূত ও বিশিষ্ট বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রধান ও স্বৈরাচার বলে গণউপাধি প্রাপ্ত এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সোনার খনির সন্ধান পেয়েছেন। তাঁর মতো স্বাধীনতা বিরোধীর পক্ষে শোভা পেয়েছে  এই খেতাব দেওয়া যে ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’। তিনি আবিস্কার করেন যে ৯ বছরের ছেলের পক্ষেও মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব। এর ‘যুক্তিগ্রাহ্য’, মনগড়া ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার আমলে প্রথম নিখাদ মেকি মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। আর কয়েক লাখ টাকা করে মাথাপিছু ঘুষ নেওয়া হয়েছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। মুক্তিযোদ্ধারা এর প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ এমনকি হাইকোর্টেও হালে পানি পায়নি। এজন্যই সম্ভবত বলা হয়ে থাকে তিনি বাংলাদেশের জন্য সবচেযে উপযুক্ত রাষ্ট্রপতি। এর পরে বিরোধী বিএনপি এমপিদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার কথা আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ‘গোলাম হুজুরের’ দোয়া নিয়ে  ক্ষমতায় আসে বাকশাল নয় আওয়ামী লীগ। মেয়াদ শেষে ক্ষমতায় আসে বিএনপি জোট। বিএনপি জোট গড়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। 

এ ক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী  ইলা মিত্রের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বাংলাদেশের এসেছিলেন ৭০-এর দশকেই। সেদিন ‘নাচোলের রাণী’ বলেছিলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা, ভারতকে স্বাধীন করেছি। এজন্য আমাদেরকে ভারত সরকার বছরে একবার ডাকেন। তখন আমাদেরকে ৫০ রুপি করে সম্মানী দেওয়া হয়। ভারতবাসী সুখে আছে আমরা তাতেই খুশি। আর কিছুই চাই না আমরা। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধে গিয়েছিলেন কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তির আশা না নিয়েই  বরং দেশ ও দশের জন্য আত্নদানের’ শপথ নিয়ে।

বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের অতন্দ্র প্রহরী। সেটা কাজে দেখা যায় না। দেখা মেলে কেবল সাইনবোর্ডে। তাদের কোনো ভালো কাজে লাগানো হয়নি উল্টো  হাত পাতা সম্মান আর সম্মানি নিতে তাদেরকে উস্কানি দেওয়া হয়েছে। এই উসকানির পথ বেয়ে একে একে আসছে নতুন নতুন বায়না। নাতি-নাতনিদেরকেও গ্রহীতার মিসকিনসুলভ কাতারে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করছে। কে? ক্ষমতার রাজনীতি। 

আমরা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেখতে পাচ্ছি, বড়জোর তিন লাখ। আর এদেশের মানুষ শহীদ হয়েছে অফিসিয়াল হিসেবে ৩০ লাখ। আর কোটিরও বেশি লোক ভারতে শরণার্থী হলেও দেশে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছে বাকি ৬ কোটি মানুষ প্রাণের শঙ্কা নিয়ে মাতৃভূমির মাটিতেই। তবে তারা কি মুক্তিযুদ্ধের জন্য কিছুই করনেনি? যার মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে থাকেননি তাদের পক্ষেই এমন কল্পনার খোঁয়ারি সম্ভব। দেশের মানুষের সহযোগিতা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ কী এতোই সহজ হতে পারতো।  রাজাকার-আল-বদর-পাকিস্তানি দোসরদেরও একটা হিসেবে আছে। তারা নগণ্য। তাহলে যে আতরাফের পক্ষে সংগ্রাম ছিল নেতাদের তারা কেন দেশকে এভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করছেন। কেন এই আতরাফদেরকেও কেন সম্মান সম্মানী দিচ্ছেন না। জবাব সহজ ও নির্মম।  ভাগ না করলে শাসনও করা যায় না। সেটাই যদি করা হয় তাহলে উপনিবেশ ও স্বাধীনতার মধ্যে তফাৎ কোথায়? 

অবৈধভাবে ক্ষমতায় পাকিস্তান ফেৃরতা মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী চতুর এরশাদ বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কানে এরশাদের অমৃত বচন  কী বিষ হয়েছে তারই প্রতিফলন আমারা দেখলাম মেলান্দহের খাঁটি মুক্তিযোদ্ধার  মর্মে বিঁধে যাওয়া কথায়। এরশাদই নকল নাবালক ও সাবালক মুক্তিযোদ্ধা ঢুকিয়েছেন সিন্ডিকেট করে মোটা ঘুষ নিয়ে। ক্যানভাস করতে দেখেছি :  সার্টিফিকেট একটা নিয়ে নিন। ভবিষ্যতে ভালো চাইলে একদিন কাজে দেবে। আসলেও তাই দেখছেন মোস্তফা।

ঢাকঢোল পিটিয়ে এভাবেই গাণিতিক হারে বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধা। সম্মানীও। আর সম্মানের পতন ঘটছে জ্যামিতিক হারে তলানি অভিমুখে। কেননা অমৃতে গরল ঢালা হচ্ছে। কাজটা করছে বেহায়া রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নিয়েও তার নামে মুক্তিযোদ্ধার সনদ। নকল মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আর আসল যুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন - এই খবর ও ছবি প্রকাশিত হবার পরেও নকলের দাপট দেখে দেশের আমজনতা হাড়ে হাড়ে টের পেযেছে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান’দের ছবি রাজনীতির রংতুলিতে কেমন করে আঁকা হচ্ছে।

No comments:

Post a Comment