আবু হেনা
‘দেশে ন্যায়বিচার নয়, নাই বিচার আছে।’ এ মন্তব্যটি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি এ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুবার পূর্ণ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এ ছাড়াও ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত স্বল্পকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিধান সংযোজন করে এ দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
সম্প্রতি সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতের বাংলা তরজমার মধ্য দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিশেষ জজ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের বক্তব্য শেষ করেন তিনি। নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ ঘোষণা করে তিনি এই আয়াতের অর্থ পড়ে শোনান— ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনের যদি ক্ষতি হয়, তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ কর না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পর্কেই অবগত।’ আদালতের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি আমার পদে থাকার সময় আমার অধীনস্থ কারও মাধ্যমে আমার পদের প্রভাব খাটাইনি। কাউকে কোনো অন্যায় আদেশ প্রদান করিনি। কারও কোনো অর্থের দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হইনি কিংবা কাউকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করিনি।’
দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিঃসন্দেহে এ দেশের আপামর জনসাধারণ, প্রশাসন, গণতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ন্যায়বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি দীর্ঘ নয় বছর দেশ শাসন করে ছয় বছর জেলে কাটিয়েছেন। আজ যিনি আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থী তিনি ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, ১০ বছর সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন, দীর্ঘদিন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথ বেছে নিয়েছেন। পরিবার, সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ দেশের জনগণের মধ্যেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছেন তিনি। আদালতে তার মর্মস্পর্শী বক্তব্য সবার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে, যখন তিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমাকে, জিয়া পরিবার ও বিএনপিকে হয়রানি করতেই এ মামলাটি করা হয়েছে। আমি আদালতে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি।’
জিয়া পরিবার এ দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি পরিবার। জিয়াউর রহমান একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পথিকৃৎ। ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে এ দেশের ৭ কোটি মানুষ যখন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল, যখন বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং ১৯৭০-৭১ নির্বাচনে নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন, তখন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তার রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া ও অন্য অবাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের গ্রেফতার ও হত্যা করে জিয়ার নেতৃত্বে বাঙালি অফিসার ও সেনা সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করেন। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে জিয়া চট্টগ্রামের বেসামরিক টেলিফোন অপারেটরকে বলেন, চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার, এসপি ও ডিআইজি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা।’
২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জিয়া তার সৈনিক ও অফিসারদের শপথ পাঠ করিয়ে যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তা তার সহকর্মীরা সমর্থন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেক বিদ্রোহী কর্মকর্তা মেজর খালেদ মোশাররফের ভাষ্য অনুযায়ী ‘২৬ মার্চ মেজর জিয়া ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতা শেখ মুজিবের পক্ষে।’ ২৭ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। সে দিনের সেই কণ্ঠস্বর—‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ আজো জাতিকে অন্ধকারে আলোর পথ দেখায়। এরপর কালুরঘাটে জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে লে. সমশের মুবীন চৌধুরী আহত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেদিনের মেজর শওকত এখন আর বেঁচে নেই, কিন্তু ক্যাপ্টেন অলি আহমদের স্মৃতিতে তা আজো ভাস্বর। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে আসা বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই ৪ এপ্রিল (১৯৭১) সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় জমায়েত হন। সেখানে কর্নেল ওসমানীকে জিয়া এবং অন্য সবাই তাদের অধিনায়ক মনোনীত করেন। পরে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তারা সবাই এ সরকারের অধীনে রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দেন। এরপর জুনের শেষদিকে প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে একটি ব্রিগেড তৈরি করা হলে মেজর জিয়াকে লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর (বিডিএফ) সদর দফতরের নির্দেশে জিয়ার নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই প্রথম ব্রিগেডের নাম রাখা হয় ‘জেড ফোর্স’।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্ম ও ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সেনাবাহিনীর প্রথম ব্রিগেডটিও গঠিত হয়েছিল রণাঙ্গনে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে নিঃস্ব অবস্থায়। সানডে টাইমসের সংবাদদাতা অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অষ্টম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল মঞ্জুর) বলেছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সবকিছুই ছিল ‘অ্যাডহক’, ‘এদের খাবার নেই, তাদের কোনো প্রশাসন নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই। তুমি অবাক হবে তাদের জার্সি নেই, গায়ের কোট নেই, পায়ে দেওয়ার বুট পর্যন্ত নেই। অনেক সিপাহি এখনো লুঙ্গি পরে কাজ করছে।’ সেই ‘অ্যাডহক’ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান দায়িত্ব নেন ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের দিনে। তার এক বছর পর ২৮ নভেম্বর ১৯৭৬ তিনি বঙ্গভবনে যান। সঙ্গে যান সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল এইচ এম এরশাদ, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার আবুল মঞ্জুর, ৯ম ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী, নৌবাহিনীপ্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান এবং বিমান বাহিনীপ্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এজি মাহমুদ। সে রাতেই তিনি বাংলাদেশের শাসনভার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর তুলে দেন। ওই দিনই তিনি সেনাপ্রধান হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে জিয়া এদেশে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং জনসেবার ক্ষেত্রে এক গঠনমূলক উন্নয়নের রাজনৈতিক আদর্শ স্থাপন করেন। আজ সেই শহীদ জিয়ার পরিবার আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থী। তার এক পুত্রের পরবাসে করুণ মৃত্যু হয়েছে। আর এক পুত্র পরিবারসহ বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। এ মুহূর্তে এ দেশের সব মানুষের প্রত্যাশা বেগম খালেদা জিয়া এবং জিয়া পরিবারের সব সদস্যের প্রতি সুবিচার করা হোক।
আজ এ কথা বলার সময় এসেছে যে, প্রকৃতির নিয়মই সব আইনের উৎস। মহাপরাক্রমশালী সূর্যের ও উদয়াস্তের নিয়ম আছে। কিন্তু প্রকৃতিতে আইনের অমোঘ শাসন দেখেও মানুষের শিক্ষা হয় না। কিংবদন্তি আছে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপ যখন পানাসক্ত অবস্থায় ছিলেন তখন একজন নারী তার কাছে বিচারপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। তখন তিনি বলেন, তিনি উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে যাবেন। এ কথা শুনে ফিলিপ পরিহাস করে বলেন, ‘আমিই তো রাজা, সবার উপরে, তুমি কার কাছে আর্জি পেশ করবে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি নেশামুক্ত ফিলিপের কাছে আর্জি পেশ করব।’ সেদিন মদমত্ত ফিলিপের কাছেও নেশামুক্ত সময়ে প্রজারা সুবিচার পেতেন। কিন্তু যারা বিরামহীন ক্ষমতার নেশায় অহোরাত্র আচ্ছন্ন তাদের তো সুবিচার করার অবসর, অবকাশ কোনোটিই নেই। এর জন্য অবশ্য তাদেরই এককভাবে দায়ী করার যুক্তি নেই। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দুর্বলতা এবং সমাজের প্রধান ও প্রভাবশালী অংশগুলোর নপুংসতার কারণেই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উদ্ভব হয়। অথচ ঔপনিবেশিক শাসনামলেও এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিরীতি ছিল, যুগপ্রাচীন বিচার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বর্তমান সমাজ যে নিত্যনতুন বিধি ব্যবস্থা তৈরি করেছে তা ক্ষমতামত্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছে। এখানে যিনি শাসন করেন তিনিই আইন প্রণয়ন করেন এবং বিচারকেও প্রভাবিত করেন। বেগম খালেদা জিয়ার আর্জিতে এ চিত্রটিই ফুটে উঠেছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘কতগুলো সই স্বাক্ষরবিহীন ঘষামাজা ফাইল নম্বর উল্লেখ করে কিছু রেকর্ড প্রস্তুত করে দুদক কর্মকর্তা আমাকে হয়রানিমূলকভাবে জড়িত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।’ তিনি বলেছেন, ‘পিডব্লিউ ১ হারুন অর রশীদকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এই মামলার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা, মামলার বাদী এবং তাকেই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছে।’
তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘চাকুরিতে পদোন্নতি ও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে তিনি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মহলের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুযায়ী যে এসব করেছেন তা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।’ বর্তমান বাংলাদেশের বিচার-বিবেচনাবর্জিত ব্যবস্থায় এ ধরনের অভিযোগের নজির হাজারটি নয় লক্ষাধিক। এ অবস্থা এমনই ভয়াবহ যে, যেসব ব্যক্তি ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে এ ধরনের কাজ করেন, ক্ষমতাচ্যুতির পর একই ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। আইনের শাসন-রিক্ত, সুবিচারবিহীন স্বৈরশাসিত সমাজে স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা, শান্তি এবং আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি আসে না। এ ধরনের সমাজে তাই ক্ষমতা বদল ঘটে শুধু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গগনবিদারী ঝনঝনানির পরিণতিতে। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এ অবস্থার শেষ কোথায়?
আজও এ দেশে গুম খুনের সঠিক খবর কেউ দিতে পারে না। আজও সন্তানহারা পিতা-মাতা এবং পিতৃহারা সন্তানদেরআহাজারি আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করছে। আজও নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। আজও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। কে জানে এ দেশের ভাগ্যে কী আছে?
- লেখক - সাবেক সংসদ সদস্য।
কার্টেসি - bd-pratidin.com
No comments:
Post a Comment