Search

Sunday, December 17, 2017

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চালচিত্র

এবনে গোলাম সামাদ

পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনের প্রধান কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সামনে আত্মসমর্পণের নির্দশনপত্রে স্বাক্ষর করছেন, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১


পাকিস্তান রাষ্ট্রটির উদ্ভব হতে পেরেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদকে নির্ভর করে। যার উদ্ভব হতে পেরেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। এই উপমহাদেশে যদি ব্রিটিশ শাসন না আসত তবে সম্ভবত এর উদ্ভব হতে পারত না। কেননা, দীর্ঘ ৭০০ বছর মুসলিম নৃপতিদের শাসনামলে কোনো দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছিল না। শেখ মুজিব দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। তিনি মনে করতেন, বাংলাভাষী মুসলমানের জাতীয়ভাবে আছে দু’টি দিক। ভাষাগত দিক থেকে তারা যেমন বাঙালি, তেমনি আবার ধর্মীয় কারণে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে একটা মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনা। বিষয়টি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। তার এই আত্মজীবনী একটি খুবই মূল্যবান রাজনৈতিক দলিল, যা পাঠে তার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিশেষ পরিচয় লাভ করা সম্ভব হয়। তার এই আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের একদল বুদ্ধিজীবী কেবল প্রচার করছিলেন যে, তিনি (মুজিব) ছিলেন নিখাঁদ বাঙালি জাতীয়তাবাদী। সেটা আর এখন সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে না অনেকের কাছে। তাকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে ভিন্নভাবে।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কখনোই দাবি করেনি যে, এটি কেবলই একটি পূর্ব পাকিস্তানের দল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এটি কেবল পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করায়নি, দাঁড় করিয়েছিল পাকিস্তানের পশ্চিম ভাগের প্রদেশ থেকেও। অন্য দিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপিপি পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোনো প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল না। অর্থাৎ পিপিপি নিজেকে ভাবত কেবল পাকিস্তানের পশ্চিম ভাগেরই একটা দল হিসেবে। যদিও আদর্শ হিসেবে দাবি করত যে, দলটি হলো সামাজিক সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল। তার লক্ষ্য হলো জনগণের জন্য রোটি, কাপড় আর মোকাম। 

শেখ মুজিব তার ৭ মার্চের বক্তৃতায় দাবি করেছিলেন, আওয়ামী লীগ হলো পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি। তিনি কখনোই বলেননি আওয়ামী লীগ হলো পূর্ব পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টি। তিনি তার এই বিখ্যাত বক্তৃতায় যদিও বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। কিন্তু সংগ্রাম বলতে তিনি ঠিক যুদ্ধ বোঝাতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, সংগ্রামকে হতে হবে মূলত অহিংস। তিনি এ ব্যাপারে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধীর অহিংস রাজনৈতিক কর্মপন্থাকে। জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করেছিলেন, তিনি পাকিস্তানের পশ্চিম ভাগের সংখ্যাগুরু দলের নেতা। পাকিস্তানে হতে হবে দুইজন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শেখ মুজিব এ রকম কোনো অদ্ভুত দাবি উত্থাপন করেছিলেন না। পাঞ্জাবের বিখ্যাত নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতআনা বলেছিলেন, ভুট্টোর বক্তব্য খুবই আশ্চর্যজনক। কেননা, পাকিস্তান একটা রাষ্ট্র, দু’টি রাষ্ট্র নয়। একটি রাষ্ট্রে দু’টি সংখ্যাগুরু দল কখনো হতেই পারে না। ভুট্টো ছাড়া পাকিস্তানের আর সব নেতাই চেয়েছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান হবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তাই বলা চলে না, শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। তিনি চাচ্ছিলেন, সাবেক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। কেবল পৃথক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে নয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন আর টিকে নেই। কিন্তু ১৯৭১ সালে তা ছিল একটা খুবই শক্তিমান ফেডারেশন। সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় না এসেই পারে না। কেননা ১৯৭১-এর ৯ আগস্ট হতে পেরেছিল ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ২৫ বছরের শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি; যেটি আসলেই ছিল সামরিক চুক্তি। এই চুক্তি না হলে ভারত কখনো পাকিস্তানের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার কথা ভাবতে পারত বলে মনে করা যায় না। কেননা, পাকিস্তানের সাথে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা নিরাপত্তা চুক্তি। ভারত জানত, ভারত কর্তৃক যদি পাকিস্তান আক্রান্ত হয়, তবে এই চুক্তির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসবে তার (পাকিস্তানের) প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে থাকলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধে অগ্রসর হতে চাইবে না। কিন্তু ১৯৭১-এর যুদ্ধ কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে পাঠায় তার সপ্তম নৌবহর। যার প্রভাব বিরাটভাবে পড়েছিল ভারতের ওপর। অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেবেছিল না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে এভাবে রণতরী পাঠাবে। সে পরিত্যাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নৌযুদ্ধের কথা। সোভিয়েত ইউনিয়নের যথেষ্টসংখ্যক সাবমেরিন ছিল। কিন্তু রণতরী ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাঠিয়েছিল বিমানবাহী এবং মেরিন সৈন্যবাহী জাহাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বলেছিল, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে মার্কিন মেরিন সেনারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সেখানে অবতরণ করবে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে। পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে না। ভারত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভারত প্রস্তাব করে পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়, তবে যুদ্ধ বন্ধ হবে। পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। এ নিয়ে শুরু হয় দরকষাকষি। চীন পাকিস্তানকে পরামর্শ দেয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সৈন্যদের সরিয়ে নিতে। আর সে জায়গায় ২৪ হাজার বাংলাভাষী সৈন্য, যারা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করছে, তাদের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। এসব সৈন্য সবাই ছিল ভারতবিরোধী। চিন্তাচেতনার দিক থেকে রক্ষণশীল ও ইসলামি মনোভাবাপন্ন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের এ এ কে নিয়াজীর পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠে খুব কঠিন। তিনি চান দ্রুত যুদ্ধের অবসান। নিয়াজী চান ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। এ রকমই বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল, সে সম্বন্ধে এখনো পরিষ্কার কিছু ধারণা করা চলে না।

ভারত বলে, পাকিস্তান যদি পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরাজয় স্বীকার করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানে সে যুদ্ধ বন্ধ করবে। পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেনা সরাতে হবে। তা না হলে যে ৯০ লাখ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়েছে, তাদের পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের প্রধান সেনাপতি এ এ কে নিয়াজী ভারতের পূর্ব কমান্ডের প্রধান সেনাপতি জগজিৎ সিং অরোরার কাছে শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু ব্যাপারটাকে যতটা শর্তহীন বলা হয়, আসলে তা ছিল না। সমস্ত পাকবাহিনীর বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হয় নিরাপদ আশ্রয়ে এবং তাদের বাংলাদেশে আটকে না রেখে স্থানান্তরিত করা হয় ভারতে। এরপর ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই হয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে পাক সেনাবাহিনীর সব বন্দীকেই দেয়া হয় মুক্তি এবং যেতে দেয়া হয় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের কোনো যুদ্ধবন্দীর বিচার করা হয় না যুদ্ধাপরাধের জন্য।

ভারতের স্বতন্ত্র দলের নেতা পিলু মোদি (Piloo Mody) একটি বই লিখেছেন Zulfi My Friend নামে। জুলফি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। তিনি তার বইতে বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধী সিমলা সম্মেলনের সময় একবার যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন। জনাব ভুট্টো সেই সময় বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গেলে সব পক্ষের যুদ্ধাপরাধেরই বিচার করতে হবে। আর সেটা করতে হবে জেনেভা কনভেনশন অনুসারে। ইন্দিরা গান্ধী দেখেন, সেটা করতে গেলে নানা অসুবিধার মধ্যে ভারতকে পড়তে হবে। তাই তিনি ব্যাপারটি স্থগিত করেন। সিমলা চুক্তি হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিকে ডাকা হয়নি। সিমলা সম্মেলনের শেষে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয় তাতে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাত (Conflict) হিসেবে। উল্লেখ করা হয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে ঠিক কী চেয়েছিলেন আমরা এখনো তা জানি না। ইন্দিরা গান্ধী একটি বই লিখেছেন My Truth নামে। বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন, স্কোয়াড্রন লিডার (অব:) মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম। তিনি বইটির নাম দিয়েছেন ‘আমার সত্যকথন’। এই বইতে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়ন করেছেন এভাবে - ‘তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, উষ্ণ হৃদয়ের লোক, যিনি একজন আইনপ্রণেতার চেয়ে পিতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের বেশি অধিকারী ছিলেন। উপরন্তু তিনি সংগ্রামের বেশির ভাগ সময় দূরে অবস্থান করেছিলেন। আমি বলতে চাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় তার চিন্তাধারা, জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ছিল, যারা এসব বিষয়ে অংশ নিয়েছিলেন।

আমি মনে করি না যে তিনি তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলেন, কিন্তু তারা তার প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। তাই তারা যা কিছু করেছিলেন, তার (মুজিব) নামে ও তার জন্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি এই লোকদের গুরুত্ব দেননি, বরং তাদের গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যারা তার বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। এতে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী ছিল।’

ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে তার দু’জন উপদেষ্টার ওপর খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। এদের মধ্যে একজন হলেন দুর্গাপ্রসাদ দার (ধর); আর একজন হলেন পি এন হাক্সার। এরা উভয়েই ছিলেন জন্মসূত্রে কাশ্মিরের লোক। আর এরা উভয়েই ছিলেন ছাত্রজীবন থেকেই মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট। এদের দু’জনের প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হতে পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের ২৫ বছরের শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও ছিলেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল কলকাতায় যেয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। তিনিও ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই আপন লোক। ইন্দিরা গান্ধী হয়তো ভেবেছিলেন শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে আর কখনোই ফিরবেন না। তার প্রাণদণ্ড হবে। ফলে তিনি তাজউদ্দীন আহমদ ও তার দলের লোকদের সহায়তা করে চলতে পারবেন। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। জুলফিকার আলী ভুট্টো জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে। সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাকে বাংলাদেশে আসার জন্য, যাতে বাংলাদেশে তাজউদ্দীন আহমদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে।

শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি। তিনি পাকিস্তান থেকে ৮ জানুয়ারি পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে করে যান লন্ডনে। সেখানে যেয়ে দেখা করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথের সাথে। লন্ডন থেকে তিনি ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি বিমানে করে আসেন নয়াদিল্লি। দেখা করেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। তারপর ওই একই ব্রিটিশ বিমানে করে যাত্রা করেন ঢাকায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে করে ঢাকা যাওয়া ঠিক হবে না। কেননা, গ্রেট ব্রিটেন তখনো বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি। কিন্তু শেখ মুজিব তাদের আপত্তিকে পাশ কাটিয়ে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে করেই এসে পৌঁছান ঢাকায়। কেন তিনি এ রকম করার প্রয়োজনীয়তা দেখেছিলেন, সেটা এখনো জানা যায়নি। গ্রেট ব্রিটেন বাংলাদেশকে একটা পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করেছিল ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে। শেখ মুজিব সরাসরি পাকিস্তান থেকে নয়াদিল্লি না আসায় ভারতে সৃষ্টি হতে পেরেছিল দারুণ প্রতিক্রিয়া। এ সময় আমি ছিলাম কলকাতায়। কলকাতায় ট্রামে-বাসে লোকদের বলতে শুনেছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানকে ইন্দিরা গান্ধীর অতটা বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। এ রকম কথাও অনেককে বলতে শুনেছিলাম যে, ইন্দিরা গান্ধীর পিতা জওয়াহেরলাল নেহরু সৃষ্টি করেছিলেন একটি পাকিস্তান, তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী সেই একটি পাকিস্তানকে খণ্ডিত করে সৃষ্টি করলেন দু’টি পাকিস্তান। যার ফলে ভারতে পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা আরো অনিশ্চিত হয়েই পড়ল।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট 
সৌজন্যে - দৈনিক নয়াদিগন্ত। 

No comments:

Post a Comment