-------------------------------------------------------------------
ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম ও ফারহান আরিফ
-------------------------------------------------------------------
টানা নয় মাস যুদ্ধের পর সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ছিল ভয়াবহ রকমের ভঙ্গুর ও বিধ্বস্ত। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী ও দূরদর্শী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে মুজিব সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ক্ষমতা গ্রহণ করে শেখ মুজিব বলেছিলেন, তিনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু আদতে কোন ধরনের সমাজতন্ত্র তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তার কোনো নির্দেশনা ছিল না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাকরণে মুজিব সরকারে ঐ সময়ে কোনো অভিজ্ঞ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিও ছিলেন না। যার ফলে বিভিন্ন কল-কারখানা জাতীয়করণ করা হলেও সেটাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার কোনো আবশ্যক বৈশিষ্ট্য ছিল অনুপস্থিত। যার ফলে অচিরেই মুজিব সরকারের এ পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এক হিসাবমতে অন্তত দশ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে; চোরাকারবারি, মজুতদারি, কালোবাজারি ও লুটপাটের দরুন দেশজ অর্থনীতির এক ভঙ্গুর দশা দৃশ্যমান হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান উপসামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অবস্থাতেও জিয়া এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজের কাছে রেখেছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় কাটিয়ে দেশকে পুনরুজ্জীবিত করার এক বিশাল গুরুভার বহন করেন। শহীদ জিয়া মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি ব্যক্তি ও সরকারি উভয় খাতকেই গতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সারা দেশের আনাচে- কানাচে লিফলেট আকারে বিমান থেকে ফেলে জিয়ার উন্নয়ন দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। শহীদ জিয়া বলতেন, বাংলাদেশ অর্থ হচ্ছে গ্রাম। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আমাদের গ্রাম ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন করতে হবে। তিনি মনে করতেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে শহর থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারলে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। তাই তিনি সব সময় গ্রামমুখী অর্থনীতির কথা বলতেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার অনুসন্ধানে তিনি মাইলের পর মাইল গ্রাম্য মেঠোপথ হেঁটে বেড়িয়েছেন। ১৯৭৬ সালের ৬ ডিসেম্বর শহীদ জিয়া পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে তার অর্থনৈতিক উন্নয়ননীতির রূপরেখা তুলে ধরেন। তাঁর উন্নয়ন নীতিজুড়ে ছিল বিভিন্ন প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, গ্রামসমূহকে মৌলিক চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা ও দেশের বিপুল জনশক্তির সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহারসহ বহুমুখী পরিকল্পনা। পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ও ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার এ অগ্রযাত্রা অব্যহত রাখে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়ে দেয়া ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এর বাস্তবায়নার্থে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শহীদ জিয়া ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
তৈরি পোশাকশিল্প রফতানিমুখীকরণ
প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলেই বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের হাঁটি হাঁটি পা করে যাত্রা শুরু, যা আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা নুরুল কাদের খান দক্ষিণ কোরিয় শিল্পগ্রুপ দেইউ-এর সঙ্গে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে যৌথ উদ্যোগে একটি শভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা দেশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন। উভয় পক্ষে গৃহীত এক চুক্তির মাধ্যমে ১৩০ জন তরুণ-তরুণী দক্ষিণ কোরিয়ার পুসান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরাই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভিত ও এর মূল মানবসম্পদের ভিত গড়ে দেন। দক্ষিণ কোরিয়া শিল্পগ্রুপ দেইউ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান কিম উ-চুং এর সঙ্গে দেশ গার্মেন্টসের মালিকের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়ার উদ্যোগ জিয়াউর রহমান নিজে গ্রহণ করেছিলেন। শহীদ জিয়া বাংলাদেশে রেডিমেড গার্মেন্টসের সূচনা এবং বিলম্বে দায় পরিশোধের ব্যাক টু ব্যাক এলসি প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের জন্য সর্বপ্রথম স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্কিম চালু করেন। এই স্কিম চালু করার ফলে রফতানিকারকরা সরাসরি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির অনুমোদন পায়। বর্তমানে এই শিল্পই দেশের অর্থনৈতিক হৃদযন্ত্রে সর্বাধিক রক্ত সঞ্চালন করে থাকে। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি কল-কারখানায় তিন শিফ্টে কাজ শুরু হয় জিয়ার সময়েই। তিনি শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো এবং বছরে ছুটি ও বোনাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে তৈরি পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশের মোট রফতানির ০.০০১% অংশীদার ছিল, তা ২০০২ সালে এসে ৭৭% দখল করেছিল। তৈরি পোশাক শিল্প বিদেশে রফতানি করার জন্য যত প্রকারের সুযোগ-সুবিধা দেয়া দরকার, তা নিশ্চিত করা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময়। সেই সময় বাংলাদেশে নারীদের প্রধান কর্মক্ষেত্র তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান বাড়ে ২৯%। তিনি তাঁর শাসনামলে শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আরও নতুন নতুন পণ্য রফতানির উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করেন ।
VAT- সংযোজন
মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট VAT (Value Added Tax) বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত একটি নতুন কর। দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রফতানি সব ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর আরোপযোগ্য। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে করারোপ তদন্ত কমিশন কর্তৃক সরকারিভাবে বিক্রয় করের বিকল্প হিসেবে মূসক চালু করা হয়। ১৯৮২ সালে বিক্রয় কর অধ্যাদেশ জারি করে ১ জুলাই থেকে পূর্ববর্তী ‘বিক্রয় আইন ১৯৫১’ বাতিল করে নতুন আইন প্রতিস্থাপন করা হয়। দেশের মানুষের সামাজিক সুরক্ষায় কর ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার আনা হয় নব্বই-এর দশকের শুরুতেই, যোগ হয় ভ্যাট। অস্ট্রেলিয়া সরকারের অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান ডেইলি স্টারে তার একটি কলামে লেখেন, Saifur Rahman also understood that in order to invest in human capital, government revenue needed to rise. His solution was to rationalize the tax code, lowering the rate and broadening the base. The Value Added Tax, introduced in 1991, was a major milestone on this front. উল্লেখ্য, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে ১৯৯১ সালের ১ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সংসদে ‘মূল্য সংযোজন কর বিল ১৯৯১’ উত্থাপন করেন, যা ৯ জুলাই পাস হয়। বিলটি পরদিন রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করলে তা ‘মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১’ হিসেবে কার্যকর হয়।
যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা
যুবসমাজকে সুসংগঠিত এবং উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তর ও জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় অবদান রাখার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনঃনামকরণ করা হয়। যুবশক্তিকে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজে লাগানোর জন্য ‘যুব কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্স’-এর ব্যবস্থা করেন। জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন যুব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউশন (কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র)। আজ এখান থেকেই ট্রেনিং শেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকরা চাকরি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলেছে। ১৯৭৮ সালের এক জরিপে জানা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশই যুবক। হতাশা, সন্ত্রাস, বেকারত্ব ও মাদকাসক্ত থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শেরেবাংলানগরে দুদিনব্যাপী জাতীয় যুব সম্মেলন আয়োজন করে যুব সমাজকে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
বিদেশে জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম চালু
স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের উন্নয়নে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশে^র নানা দেশে জনশক্তি রফতানির ব্যবস্থা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, যুবকদের চাহিদা পূরণে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি খুবই জরুরি। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই পরীক্ষামূলকভাবে কুয়েত ও সৌদি আরবে স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক প্রেরণের মাধ্যমে বিদেশে জনশক্তি রফতানির ধারণাটি বাস্তব রূপ লাভ করেছিল, যা আজ দেশের অর্থনীতির মূল চাকায় পরিণত হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ শুরু হয়। আজ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকদের যে শ্রমবাজার তৈরি হয়েছে তার মূল কৃতিত্ব শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন
কৃষিপ্রধান অর্থনীতি এবং গ্রামপ্রধান দেশে যে কোনো বিপ্লবের সূচনা করতে হয় গ্রাম থেকে। ১৯৪১ সালে মাও সে তুং চীনে এভাবেই বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও গ্রাম থেকেই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। মাঠের পর মাঠ এবং ক্ষেতখামার মাড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি মাসের ২০ (বিশ) দিনই রাজধানীর বাইরে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা করেন শহীদ জিয়া। পল্লীর সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শহীদ জিয়ার আগ্রহে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একজন কৃষক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ করে বছরে তিনটি ফসলের জন্য ঋণ নিতে পারতেন। এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল ঋণ নেয়ার জন্য জমি ব্যাংকে বন্ধক রাখার প্রয়োজন হতো না এবং বর্গাচাষীসহ জমির মালিকও এ ঋণ নিতে পারতেন। ১৯৮০ সালের ১৪ জুলাই রাজবাড়ী, ফরিদপুরে গ্রামীণ কর্মী ও কৃষক সম্মেলনে শহীদ জিয়া বলেছিলেন, ‘গ্রামীণ জনগণের হাতেই বর্তমান শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের সাফল্যের চাবিকাঠি।...বছরে তিনটি ফসলের নিশ্চয়তা বিধান করে শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনই আমাদের লক্ষ্য নয়, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করার জন্য রফতানি করার মতো উদ্বৃত্ত খাদ্যও আমাদের উৎপাদন করতে হবে।’ শহীদ জিয়া গ্রামীণ মহিলাদের মাধ্যমে পরিবারের ও দেশের উন্নয়নে ছোট ছোট কুটির শিল্প, হাঁস-মুরগি, মাছ চাষসহ আঙ্গিনা ভরে তুলতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন বৃক্ষ বা সবজি দিয়ে। প্রেসিডেন্ট জিয়াই বাড়ির চারদিকে ফলফলাদি ও সবজি চাষ এবং রাস্তার দুপাশে ফলের গাছ লাগানোর জন্য গ্রামবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি দেশে ফ্রি মার্কেট ইকোনমি (মুক্তবাজার অর্থনীতি) চালু করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশ অতি দ্রুত চরম দারিদ্র্য অবস্থা থেকে উঠে এসেছিল। এ প্রসঙ্গে ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সৎলোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ এছাড়া মালয়েশীয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে আরো বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহামারি সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৮)। এরই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও ডাল-ভাত কর্মসূচি, ছাগল-পালন কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ ব্লাকবেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য সহজশর্তে ঋণদান কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, বর্তমানে ব্লাকবেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশের ব্লাকবেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন
উন্নয়ন আর উৎপাদনে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ১০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ চালু করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনি কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে ১৯৭৬ সালে খাল কাটা কর্মসূচিসহ নানামুখী স্বনির্ভর কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সংবাদদাতা মি. উইলিয়াম ব্র্যাংহ্যাম তাঁর ‘সোনার গাঁ’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের দীর্ঘকালের খাদ্য রাজনীতি প্রেসিডেন্ট জিয়াই বন্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর আমলেই দেশের মাটিতে খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য দেখা দেয়।’ কৃষক-বন্ধু জিয়াউর রহমান আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। যেখানে ১৯৭৪-৭৫ সালে সারাদেশে ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ১১ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ১৯৮০-৮১ সালে সমগ্র দেশে ধান উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন। ১৯৯১-৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও কৃষি খাত উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা এবং সুদসহ ৫ হাজার টাকা কৃষিঋণ মওকুফ করা হয়। এতে প্রায় ২৫ লাখ কৃষক সরাসরি উপকৃত হয়। গ্রাম-গঞ্জে ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোলট্রি ফার্ম গঠন করেন। বর্তমানে সারা দেশে কয়েক লাখ পোলট্রি খামার রয়েছে। এই শিল্পে কর্মরত আছেন ৬০ লাখ লোক যার অধিকাংশই শিক্ষিত বেকার তরুণ যুবক। ছাগল-পালন কর্মসূচি গ্রহণ করে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়। ২০০১ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসে বিএনপি সরকার আবারও কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য প্রথম বছরেই ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। ২০০৪ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ৫০ লাখ প্রান্তিক কৃষককে বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করা হয়। এছাড়া কৃষি খাতে ১০ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়াও ছিল এই শাসনামলের আরেকটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা
দার্শনিক রুশো বলেছেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমন্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি’। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক কৃষিকর্মে নিয়োজিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ডও হলো কৃষি যেখানে দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৮ ভাগ কৃষিতে জড়িত। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কৃষিকে বাংলাদেশের প্রাণ বলে অভিহিত করেন। কাজেই বাস্তবতার আলোকেই তাঁর সময় ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, টেকসই প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, কৃষি প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য ম্যানডেট নিয়ে যাত্রা শুরু করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি। সরকারি পর্যায়ে কৃষি কর্মকান্ডের সূত্রপাত মূলত এখান থেকেই।
খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্যশস্য গুদামজাতকরণ কর্মসূচি
দেশের দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখেই দরিদ্রের কন্ঠস্বর শহীদ জিয়া নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। শস্য সংগ্রহের সময় শস্যের দাম তুলনামূলক কম থাকায় এবং একই শস্য পরবর্তীতে বেশি দামে ক্রয় করায় কৃষক বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচি চালু করেন। বাংলাদেশে ১৩০টিরও বেশি শস্যগুদাম আছে যেখানে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য মজুদ রেখে স্বল্পসুদে ঋণ নিতে পারে এবং মৌসুম শেষে বেশি দামে শস্য বিক্রি করে তা পরিশোধ করতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত উৎপাদিত ফসল গুদামজাত করে আপৎকালীন মজুদ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহীদ জিয়া সারাদেশে খাদ্য গুদাম তৈরি করেন।
সার কারখানা নির্মাণ
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কৃষি বিপ্লবের ফলে দেশে সারের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। ক্রমবর্ধমান সারের এ চাহিদা মেটাতে তিনি সার কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৯৮১ সালে তিনি আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি আরও সার কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তা দেখে যেতে পারেননি।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ((BREB)) প্রতিষ্ঠা
আধুনিক বিশ্বের উন্নয়ন ও সভ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হলো বিদ্যুৎ। দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় আনতে শহীদ জিয়া ১৯৭৭ সালের ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে BREB (Bangladesh Rural Electrification Board) প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করাই ছিল এই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বা ইজউই প্রতিষ্ঠা এবং এর উন্নয়ন ছিল তৃতীয় বিশ্বের জন্য অন্যতম এক মাইলফলক।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প চালু
দারিদ্র্য বিমোচনের নানা উপায় ও কৌশল নিয়ে জিয়াউর রহমানের চিন্তা থেকেই টাঙ্গাইল জেলায় পরীক্ষামূলক ভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প চালু হয়েছিল। গ্রাম্য এলাকায় ভূমিহীন দরিদ্রদের ঋণের ব্যবস্থা করতেই এর প্রতিষ্ঠা। কালের পরিক্রমায় সেটিই এখন গ্রামীণ ব্যাংক হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং নোবেল পুরস্কারও জয় করেছে। বর্তমানে বেশকিছু দেশ এ মডেল অনুসরণ করে কাজ করছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসী শ্রমিকদের বিশাল অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিগত বিএনপি সরকার ২০ ডিসেম্বর ২০০১ তারিখে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় গঠন করে এবং বিদেশে বাংলাদেশের দুতাবাসসমূহ যাতে প্রবাসীদের কল্যাণে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে তার নিশ্চয়তা বিধানের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। বিদেশী কর্মসংস্থানের গুণগতমান বৃদ্ধি, কর্মী নিয়োগে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের প্রতারণা ও তৎপরতা রোধ করে সচ্ছতা বৃদ্ধি ও দেশের সকল অঞ্চলের জনগণকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে সুষম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চতকরণ ও প্রবাসীদের সামগ্রিক কল্যাণের লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ।
বেসরকারি খাতের বিকাশ
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো বেসরকারি খাতের উন্নয়ন। ধ্বংসপ্রায় কারখানাগুলোকে বেসরকারিকরণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। শিল্প-কারখানাগুলো ফিরে পায় প্রাণ, কর্মসংস্থান হয় লক্ষাধিক মানুষের। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টেকসই করা সম্ভব নয়। তাইতো তিনি শুধু সরকারি খাতের বন্ধ কলকারখানাই চালু করেননি বরং বেসরকারি খাতের বিকাশেও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ চালু করেন। তিনি ১৯৭৯ সালে জাতীয়কৃত শিল্প-কারখানাকে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করেন। ১৯৮০ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ আইন পাস করেন। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ১৯৯৩ সালে প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড গঠন করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকরের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানাকে বেসরকারি খাতে নেয়ার জন্য প্রথম বাজেটে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়াও ছিল একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এছাড়া বেসরকারি খাতে বিদ্যমান দীর্ঘ ৩১ বছরের চিনি আমদানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ছিল বিএনপি সরকারের উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।
বৈদেশিক রিজার্ভ বৃদ্ধি
জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে এক বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিলেন। একটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, ১৯৭৪-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৩৮.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ১৯৭৯-তে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৭৪.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল জিডিপি’র ০.৭% যা ১৯৯৩-৯৪ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮.২% (দৈনিক দিনকাল, ৩০ মে ২০০২)। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের ০৬ (ছয়) মাসের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। তাই এ সময়ে টাকার দাম কমে যায়নি, জিনিসপত্রের দামও হঠাৎ বেড়ে যায়নি, যা আজকাল অহরহ পেপার-পত্রিকায় চোখে পড়ে। রিপোর্টে আরো দেখা যায়, ২০০১ সালে খালেদা সরকারের সময় তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উল্লেখ্য যে, বিএনপি সরকারের শেষের দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৬১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ঐ সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন
১৯৭৯ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তিস্তা ব্যারেজ গড়বে এ দেশের প্রকৌশলীগণ। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে নির্মাণ পর্যন্ত সব কাজই করেছেন আমাদের দেশীয় প্রকৌশলীগণ। স্কুল, কলেজ, সরকারি ভবন, সড়ক-মহাসড়ক, সেতু-কালভার্ট, বিদ্যুৎ, গ্যাসলাইন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি অবকাঠামোগত খাতে বিএনপি সরকারের সময়ে ব্যাপক উন্নয়নসাধিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর যমুনা বহুমুখী সেতুর ভৌত নির্মাণ শুরু করা এবং প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর প্রায় ৭০% কাজ সম্পন্ন করা। মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত নির্বিঘœ করা, চট্টগ্রামে একটি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ। দেশের সবক’টি প্রধান হাইওয়ের উন্নয়ন, বড় বড় নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ, মুন্সীগঞ্জে ধলেশ্বরী সেতু নির্মাণ, কর্নফুলী নদীর ওপর তৃতীয় সেতু নির্মাণকাজে অগ্রগতি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপানের অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রাপ্তি ও সম্ভাব্যতা যাচাই কাজের সমাপ্তি, সিলেট এয়ারপোর্টে নতুন দুুটি বিল্ডিং নির্মাণÑ এসবই হচ্ছে বিগত বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের ০৫ (পাঁচ) বছরে যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের রেকর্ড। এছাড়া ঢাকায় স্থায়ী হাজি ক্যাম্প নির্মাণ করা হয় বিএনপি শাসনামলেই। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য ৩০০ একরেরও বেশি জমি তবলীগ জামায়াতকে প্রদান করা হয়।
ব্লু-ইকোনমি ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে দেশ সমুদ্রকে যত বেশি ব্যবহার করতে পেরেছে, সে দেশ অর্থনীতিতে তত বেশি সমৃদ্ধশালী হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন, খনিজ সম্পদ আহরণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সমুদ্রের ভূমিকা অপরিসীম। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ ১৯৮১ সালের ১৯ থেকে ২১ জানুয়ারি দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী এবং একদল বিজ্ঞানীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’-এ চড়ে বঙ্গোপসাগরে একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা সফরের আয়োজন করে। শহীদ জিয়ার এই সমুদ্র অভিযান বা শিক্ষা সফরের মূল উদ্দেশ্যও ছিল দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া; বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহিত করা এবং সমুদ্রবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত গবেষণা কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। প্রেসিডেন্ট জিয়ার হাজারো কাজের মধ্যে এই কর্মসূচি ছিল একটি ক্ষুদ্র, অথচ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কসুলভ কর্মসূচি। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট জিয়ার আগ্রহ ও নির্দেশেই সরকার সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, শিপিং মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, পেট্রোবাংলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার সরকারও তাঁর প্রথম শাসনামলে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। তিনি বঙ্গোপসাগরের জলদস্যুতা ও চোরাচালান হ্রাসে কোস্টগার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন।
দারিদ্র্য নিরসন
শহীদ জিয়ার জীবদ্দশার একটি বড় সময় কেটেছে এদেশের মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল দারিদ্র্য দূরিকরণ, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খালেদা জিয়ার সরকার মধ্য-মেয়াদি পরিকল্পনা হিসাবে একটি ‘দারিদ্র্য নিরসন’ কৌশলপত্র প্রণয়ন করেন। দারিদ্র্য নিরসনের জন্য বাজেট বরাদ্দের হার প্রতি বছরই বৃদ্ধি করা হয় এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এর হিস্যা দাঁড়ায় মোট ৫৬ শতাংশ। পল্লী অঞ্চলের অতি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি সম্প্রসারিত করেছিল। দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গাপ্রবণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৫০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল সেই সময়ে। চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়নে ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প (চর জীবিকায়ন কর্মসূচি) গ্রহণ করা হয়। এ সময়ে দেশের দারিদ্র্যের হার ০৯ শতাংশ হ্রাস পায়।
সমাজের পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের মাসিক ভাতা ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি করা হয়। বয়স্ক ভাতা ও ভাতাগ্রহীতার সংখ্যা উভয়ই বাড়ানো হয়। এছাড়া দুঃস্থ মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে ‘দুঃস্থ’ মহিলাদের ঋণদান কর্মসূচি চালু করা হয় সেই সময়ে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গ্যালব্রেইথ (১৯০৮-২০০৬) বলেন, In economics, hope and faith co-exist with great scientific pretension and also a desire for respectability. বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে জিয়াউর রহমানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিন্তায় এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। জিয়া তাঁর যুগান্তকারী ১৯-দফা কর্মসূচিতে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর যে চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, আজ অবধি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার মূলে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রয়োজন ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তা ধারণ করতেন। তারই দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) অতীতে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতিতে জোর দিয়ে এসেছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যহত রাখবে বলেই জাতি প্রত্যাশা রাখে।