ঋণ দেওয়ার বিনিময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন নিয়েছেন বহুল আলোচিত ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী)।
এ ছাড়া এ দু’জন টাকার বিনিময়ে ব্যাংকে অনেক কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সুপারিশে দেওয়া ঋণ পরিশোধ না হলেও অভিনব কায়দায় পরিশোধ দেখানো হয়েছে। মাত্র তিনটি ঋণ হিসাব এবং এক বছরের নিয়োগের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে চাঞ্চল্যকর এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের গুরুতর অনিয়মের মাধ্যমে তাদের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। এ অনিয়ম বের হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় এখন এক কোটি টাকার বেশি অঙ্কের সব ঋণে বহির্নিরীক্ষক দিয়ে বিশেষ অডিট করাচ্ছে ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নমুনা ভিত্তিতে মাত্র কয়েকটি ঋণ হিসাবের ওপর নিরীক্ষণ চালিয়ে ব্যাপক এ জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। আমানতকারীদের অর্থ লোপাট, ব্যাংকটির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হওয়ায় অনিয়মের ধরন এবং জালিয়াতির মাধ্যমে কত টাকা তছরুপ হয়েছে, তা বের করা জরুরি। একই সঙ্গে ব্যাংকের সম্পদের প্রকৃত চিত্র নির্ণয় করা আবশ্যক। এমন পরিস্থিতিতে বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে তার অনুমোদন প্রক্রিয়া, ঋণের সদ্ব্যবহার, সহায়ক জামানত, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাচাইসহ সার্বিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে চিহ্নিত করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর মানি লন্ডারিং বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে।
ঋণ হিসাব থেকে দু’জনের নামে পে-অর্ডার ইস্যু
মহীউদ্দীন খান আলমগীরের একক সুপারিশে গত বছর তনুজ করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয় ফারমার্স ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদ, ক্রেডিট কমিটি বা ইসি কমিটির অনুমোদন ছাড়াই এ ঋণ দেওয়া হয়। গত বছরের ১৯ জুলাই গ্রাহকের একটি মেয়াদি হিসাব থেকে এক কোটি ২২ লাখ টাকা তার চলতি হিসাবে স্থানান্তর হয়। একই দিন ৪২ লাখ টাকা নগদে উত্তোলন করেন ওই গ্রাহক। প্রথমে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নামে ৮০ লাখ টাকার একটি পে-অর্ডার ইস্যু করে তনুজ করপোরেশন। পরে আবার বাতিল করে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নামে ১৮ লাখ টাকা ও মাহাবুবুল হক চিশতীর নামে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। অবশিষ্ট ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা জনৈক জাকির হোসেন নামের অপর ব্যক্তির।
জাহান ট্রেডার্স নামে অপর একটি ঋণ হিসাব থেকে গত বছরের ১৯ মার্চ এক কোটি ৪০ লাখ টাকা আরেকটি চলতি হিসাবে স্থানান্তর হয়। এই ঋণও দেওয়া হয় মহীউদ্দীন খান আলমগীরের একক সুপারিশে। আর উভয় গ্রাহক নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও পুরো টাকা তুলেছেন নগদে। ফলে অবশিষ্ট টাকাও প্রকৃত খাতে ব্যবহার হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সাথে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সার্বিক অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের অডিট কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী বলেন, ‘পদত্যাগ করার পর চেয়ারম্যান এবং তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার হচ্ছে। সুবিধাবাদীরা এটা করছেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর আজ চেয়ারম্যান থাকলে কেউ এসব বলতে পারত না।’ পে-অর্ডারের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘পে-অর্ডারে কত আছে?’ সুনির্দিষ্ট অঙ্ক বলার পর তিনি বলেন, ‘এটা আমার স্মরণে নেই।’ তিনি বলেন, ‘একজন চেয়ারম্যান, যিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বর্তমানে এমপি। পদত্যাগ করার কথা পরিচালনা পর্ষদে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সামনে তার পদত্যাগপত্রে সই হয় কীভাবে। এটা আপনারা একটু দেখেন।’
লোকবল নিয়োগে অনিয়মের ক্ষেত্রে তার সংশ্নিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে বাবুল চিশতী বলেন, ‘নিয়োগে তো কমিটি থাকে। নিয়োগ কমিটির ঊর্ধ্বে কেউ নয়। কমিটি অনুমোদন দিলে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন।’ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে একটি পরীক্ষা নেওয়া হলেও নম্বরপত্র মূল্যায়ন না করে আর্থিক লেনদেনের বিপরীতে নিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটা সঠিক নয়। এসব অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অংশ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বাবুল চিশতী বা পর্ষদের কোনো সদস্যের অ্যাকাউন্টে টাকা গিয়ে থাকলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ। কেননা, ঋণগ্রহীতার অ্যাকাউন্ট থেকে পরিচালকের অ্যাকাউন্টে টাকা যাওয়ার কথা নয়। এই একটি কারণেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের পর্ষদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তারা এখন ঘাপটি মেরে বসে থাকবেন। ব্যাংকের অবস্থা ভালো হলে আবার চেয়ারম্যান হবেন। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের শেয়ার বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত।
ফারমার্স ব্যাংকের বর্তমান এমডি মো. এহসান খসরু বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে বহির্নিরীক্ষক দিয়ে ফাংশনাল অডিটের কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ থাকা গুলশান ও মতিঝিল শাখার পরিদর্শন শেষ পর্যায়ে এসেছে। ব্যাংকটির ৫৬টি শাখার মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ রয়েছে ১৫টির মতো শাখায়। রোববার থেকে বাকি শাখার পরিদর্শন শুরু হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত সময়ের মধ্যে এসব পরিদর্শন শেষ করে পাঠানো সম্ভব হবে বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে অর্ধেকের বেশি রয়েছে এক কোটি টাকার বেশি অঙ্কের।
এ দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। এটা গোপনীয় বিষয়। এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না। বিএফআইইউ যা তথ্য পায়, তা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া হয়। আর মানি লন্ডারিং হলে সেটা যাবে দুদকে।
তারল্য সংকট এবং বিভিন্ন অনিয়ম প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গত ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং চেয়ারম্যান পদ থেকে মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। একই দিন অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতীও ব্যাংক থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর ১৯ ডিসেম্বর একেএম শামীমকে এমডি থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিতে চলমান তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে নতুন করে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
জনবল নিয়োগে অনিয়ম
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোকবল নিয়োগে অনিয়মের সঙ্গে তৎকালীন চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল চিশতীর সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা দু’জন যোগসাজশ করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, লোক নিয়োগে ব্যাংকের নিজস্ব নিয়মও মানা হয়নি। প্রতিবেদনে শুধু ২০১৭ সালে লোকবল নিয়োগের একটি চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, আলোচ্য বছর ব্যাংকটিতে ৮৫ কর্মকর্তা নিয়োগ হয়। এর প্রতিটিতে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সুপারিশ রয়েছে। এ ছাড়া অনেক প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্তের ওপর তার স্বাক্ষরসহ ‘পরিচালক জনাব চিশতী’ কথাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এসব নিয়োগের জন্য ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে সংক্ষিপ্ত একটি পরীক্ষা নেওয়া হলেও এসব উত্তরপত্রে কোনো নম্বর দেওয়া হয়নি। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এসব নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে।
ঋণ পরিশোধ না করেই সমন্বয়
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসটুআরএস করপোরেশন নামে প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফেরদৌস জবায়েত ইসলাম ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি। তার নামে গুলশান শাখায় সৃষ্ট চারটি হিসাবে ৪৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিটি ঋণ দেওয়া হয়েছে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সুপারিশের ভিত্তিতে। এর মধ্যে ১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার একটি মেয়াদি ঋণ ছাড়া অন্য ঋণের বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের কাছে কোনো তথ্যই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল যাওয়ার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে এসব ঋণ সমন্বয় দেখানো হলেও বাস্তবে সমন্বয় হয়নি। যে কারণে বিপুল অঙ্কের এ অর্থ জমা দেখানো হলেও ওই দিন শাখায় ছিল মাত্র আড়াই লাখ টাকা। অভিনব কায়দায় শুধু ভাউচারের মারপ্যাঁচে ঋণ সমন্বয় দেখানো হয়েছে।
ঋণ সমন্বয়ে জালিয়াতির কৌশলটি ছিল এ রকম- গত ২৬ নভেম্বর চারজন গ্রাহকের আট কোটি ৬০ লাখ টাকার স্থায়ী আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তারা নগদায়ন করেন। তারা হলেন- জামালগঞ্জ শাখার গ্রাহক আলী আশরাফ, মিরপুরের পাইকপাড়া শাখার গ্রাহক শংকর নকরেক, কুমিল্লা শাখার রাকিবুল হাসান ও ধানুয়া শাখার মো. পলিন। একই দিন ব্যাংকটির টাঙ্গাইল শাখায় ফারাহ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ফারিব অটো রাইস মিল ও আরসিএল প্লাস্টিকের হিসাবে নগদে ১১ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা দেখানো হয়। এরপর ৬ ডিসেম্বর ফারাহ ট্রেডের হিসাব থেকে পাঁচ কোটি ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন স্থায়ী আমানত নগদায়নকারী রাকিবুল হাসান। ফারিব অটো রাইস মিলের চলতি হিসাব থেকে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন স্থায়ী আমানত নগদায়নকারী আলী আশরাফ। আর আরসিএল প্লাস্টিকের হিসাব থেকে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন অপর স্থায়ী আমানত নগদায়নকারী মো. পলিন। এই তিন প্রতিষ্ঠানের চলতি হিসাব থেকে উত্তোলন করা ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এসটুআরএস করপোরেশনের মেয়াদি ঋণ সমন্বয় হয়েছে। এ ছাড়া নয় কোটি ১৫ লাখ টাকার অপর মেয়াদি ঋণটি টাঙ্গাইল শাখা থেকে গত ৫ ডিসেম্বর নগদ জমার মাধ্যমে সমন্বয় এবং ১০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার ঋণটি গত ৭ ডিসেম্বর বকশীগঞ্জ শাখায় নগদ জমার মাধ্যমে সমন্বয় দেখানো হয়েছে। এর বাইরে গ্রাহকের সাত কোটি ৬৫ লাখ টাকার ওভারড্রাফট ঋণে গত ২৯ সেপ্টেম্বরের পর কোনো লেনদেন নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরসিএল প্লাস্টিকের স্বত্বাধিকারী রাশেদুল হক চিশতী তখনকার অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল চিশতীর ছেলে। এসটুআরএস ব্যাংকটির ১৫টি শাখার সাজসজ্জার কাজ করেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের টাকা যথাযথ ব্যবহার না করে অন্যত্র ব্যবহার হয়েছে। পরিদর্শন চলা অবস্থায় সে তথ্য গোপন করতে এ জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
- Courtesy: AmaderShomoy.Com/সমকাল
No comments:
Post a Comment