Search

Tuesday, February 20, 2018

চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধী তৈরির নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক বড়ভাই’


চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধী তৈরির নেপথ্যে ‘রাজনৈতিক বড়ভাই’। যাদের সঙ্গে মিশে বিপথগামী হচ্ছে স্কুলপড়ুয়া কিশোররা। তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর অস্ত্র। যা পেয়ে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ ও মাদকদ্রব্য বিক্রির মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে কিশোররা। 

গত রোববার সন্ধ্যা ৭টায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আদালতে হাজির করার পর পুলিশকে গুলির দায়ে আটক ৬ কিশোর সরল মনে এই স্বীকারোক্তি প্রদান করে। শুক্রবার পুলিশকে গুলি করার ঘটনায় শনিবার ও রোববার দুইদিনে ৬ কিশোরকে আটক করে পুলিশ।

যারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও একই স্বীকারেক্তি প্রদান করে। স্বীকারোক্তিতে পুলিশকে গুলি করা পিস্তলটি রাজনৈতিক বড়ভাই ফারুকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। আবার ঘটনার পরপরই ফারুককে পিস্তলটি ফেরত দেয়া হয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দেন। 

ফারুক নগরীর এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা। সে পেশাদার ছিনতাইকারী। তারই নির্দেশে আটক খোকন চৌধুরী (২৪) গুলি লোড করে পিস্তল নিয়ে তার সহযোগী আয়মান জিহাদের বন্ধুকে মারতে যাচ্ছিল। এমন স্বীকারোক্তি দেন খোকন চৌধুরী নিজেই। আদালত তাদের এই স্বীকারোক্তি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেন। 

চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার আবদুল ওয়ারিশ গতকাল সোমবার সকালে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, শুক্রবার নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেইটে রেলস্টেশন সড়ক মুখে তল্লাশি চৌকিতে পাঁচলাইশ থানার এসআই আবদুল মালেককে গুলি করার পর ঘটনাস্থল থেকে আবদুল হাকিম অভি (১৯) এবং দুই দিনের অভিযানে ৫ জনকে আটকের পর সন্ধ্যা ৭টায় সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। এরপর আটককৃত ৬ জনই পৃথক পৃথক জবানবন্দি দেন আদালত। পরে আদালত তাদের কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন। 

তিনি বলেন, আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে এ পর্যন্ত ১০ কিশোর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। যাদের বয়স ১৭ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। এদের বেশিরভাগই এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। তবে এরমধ্যে একজন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রও রয়েছে। রয়েছে দুজন  পেশাদার ছিনতাইকারীও।  

এরমধ্যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে ছিনতাইকারী খোকন চৌধুরী। সে বোয়ালখালী উপজেলার দিলীপ চৌধুরীর ছেলে। তারা ওমরগণি এমইএস কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ফারুককেন্দ্রিক ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। স্বীকারোক্তি মোতাবেক  তাদের ‘বড়ভাই’ ফারুকই তাদের বিপথগামী করে তোলে। বড়ভাইয়ের নির্দেশে তারা সিআরবি এলাকায় প্রতিপক্ষের একজনকে খুন করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তল্লাশি চৌকিতে ধরা পড়ার ভয়ে তারা পুলিশকে গুলি করে পালিয়ে যায়। 

একইভাবে মাত্র দু’মাস আগে গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় নগরীর জামালখান এলাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে। আদনান হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক বড়ভাই যুবলীগ নেতা এনাম কিশোরদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল।

এভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর সবক’টি স্কুল-কলেজকেন্দ্রিক কিশোররা অবস্থান ভেদে রাজনৈতিক বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় নানা অপরাধে লিপ্ত রয়েছে। যারা দিন ও রাতে নগরীর বিভিন্ন সড়কের ব্যস্ততম মোড়, আবাসিক এলাকা, বিনোদন পার্কগুলোতে আড্ডা দেয়। 

নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে এ ধরনের প্রায় তিন শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। যারা হরহামেশাই চুরি-ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের মতো নানা অপরাধে জড়িত রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারে একে অপরকে খুন করতেও তারা পিছপা হচ্ছে না। 

তিনি আরো বলেন, কিশোর হওয়ায় এসব অপরাধে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে আগে পুলিশের ধারণা ছিল না। ফলে কিশোরদের দিকে পুলিশের নজর তেমন একটা ছিল না। আর এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে রাজনৈতিক বড়ভাইরা। যাদের নিয়ে নির্বিঘ্নে নীরবে নানা অপরাধ সংঘটিত করে যাচ্ছে কিশোররা। এরমধ্যে ইয়াবাসহ মাদক বিক্রি করার বিষয়টিও রয়েছে।   

প্রসঙ্গত, শুক্রবার বিকালে কিশোর গ্যাংয়ের গুলিতে আহত নগরীর পাঁচলাইশ থানার এএসআই আবদুল মালেক বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় একই থানার এসআই নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে ১০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। 

এ মামলায় ঘটনার দিন আটক আবদুল হাকিম অভি (১৯), শনিবার নগরীর মুরাদপুর থেকে আটক মাইনুদ্দিন ফরিদ ওরফে রাকিব (১৭) ও নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৫ নম্বর রোডের একটি বাসা থেকে আটক জুবায়ের হোসেন প্রত্যয় (১৭) রোববার জেলার আনোয়ারা উপজেলা থেকে আটক খোকন চৌধুরী (২৪) ও আয়মান জিহাদ (১৭) এবং নগরীর রহমান নগর থেকে আটক তানজিল করিম খান মাহি (১৮)কে আসামি করা হয়। 

এসআই নুরুল ইসলাম বলেন, মামলায় খোকনসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬ কিশোর গ্রেপ্তার হলেও চার জন বাইরে রয়েছে। পুলিশকে গুলি করা পিস্তলটিও উদ্ধার হয়নি এখনো। পিস্তলটির মালিক ফারুককেও খুঁজছে পুলিশ। 

তিনি বলেন, আটক ও আসামি কিশোররা বেশিরভাগই যুবলীগ সন্ত্রাসী কারাবন্দি অমিত মুহুরির অনুসারী। তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে শুলকবহর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা সোলায়মান বাদশার নামও উঠে এসেছে। তিনি ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি মোহাম্মদ ওয়াসিমের অনুসারী। তারা সবসময় নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৫ নম্বর রোডের ১২ থেকে ১৬ নম্বর বাড়ির সামনে আড্ডা দেয়। এ গ্রুপটির নেতৃত্বে আছে আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের কথিত ছাত্রলীগ নেতা একরাম ও আরিফ।

নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) শাহাবুদ্দিন বলেন, পুলিশকে গুলি করার ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামি সমপৃক্ত বলে আদালতে জবানবন্দি দেয়। তারা ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েক জনের নামও বলেছে। এরমধ্যে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী জুবায়ের হোসেন প্রত্যয় ও সাইফুদ্দিন ফরিদ ওরফে রাকিবের জামিন আবেদন করা হলেও প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও শিশু আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগার থেকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতিসহ পরীক্ষা শেষে তাদের গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত সেইফ হোমে পাঠানোর আদেশ দেন। 

  • Courtesy: Manabzamin Feb 20, 2018

No comments:

Post a Comment