হাছান আদনান
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ১০৬টি শাখা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা-১ অঞ্চল। একজন মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে এ আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীনে বিতরণকৃত ঋণ ৩ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা বা ৪৮ শতাংশই ডিসেম্বর শেষে খেলাপির খাতায় চলে গেছে। খেলাপি হওয়া ঋণ থেকে ২০১৭ সালে ৭৫৫ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সোনালী ব্যাংকের। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৮৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিগত বছরে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ অর্জন করেছে ঢাকা-১ অঞ্চল। এ অঞ্চলেরই ১ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার অবলোপনকৃত ঋণ থেকে গত বছর এক পয়সাও আদায় সম্ভব হয়নি।
ঢাকা-১ অঞ্চলের চেয়েও খারাপ অবস্থা সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের। শাখাটির বিতরণকৃত ১১ হাজার ১০১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকাই গেছে খেলাপির খাতায়। খেলাপি ঋণ থেকে ২০১৭ সালে ১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল শাখাটি। কিন্তু বছর শেষে আদায় হয় মাত্র ১৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী বছরে স্থানীয় কার্যালয় লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে। শাখাটির অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের পরিস্থিতি আরো খারাপ।
সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৮ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করেছে সোনালী ব্যাংক। ২০১৭ সালের শুরুতে খেলাপি ঋণ থেকে ৬ হাজার ৪৩ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ব্যাংকটি। কিন্তু আদায় করতে পেরেছে ১ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৯৮ কোটি টাকা নগদ আদায় হয়েছে। বাকি ২৯৩ কোটি টাকা আদায় দেখানো হয়েছে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে। সোনালী ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলন-২০১৮ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে সবচেয়ে বড় ব্যাংকটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এবং ছোট অংকের ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছেন। কিন্তু বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে মামলা করেও টাকা আদায় সম্ভব হচ্ছে না।
এ বক্তব্যের সমর্থন মিলছে পরিসংখ্যানেও। বিগত বছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে সোনালী ব্যাংকের ময়মনসিংহ অঞ্চলে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ আদায় সিলেট অঞ্চলে। এছাড়া রাজশাহীতে লক্ষ্যমাত্রার ৪৮ শতাংশ, ফরিদপুরে ৪৪, রংপুরে ৩৯, কুমিল্লায় ৩৮ ও বরিশালে ৩৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করেছে সোনালী ব্যাংক। বিপরীতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখা মাত্র ২ শতাংশ ও রমনা করপোরেট শাখা ৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে।
বড় অংকের ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় সম্ভব না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি বলে মনে করেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল মাসুদ। তিনি বলেন, ছোট গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে মামলা করলে সফলতা আসছে। কিন্তু বড় ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা অসহায়। একের পর এক রিট করার কারণে বড় খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১০ সাল থেকে সোনালী ব্যাংকের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। অতীতে বিতরণ করা ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তবে দুর্যোগের মধ্যেও আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। বিদায়ী বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সফল হয়েছি।
প্রত্যাশিত হারে আদায় না হওয়ায় বিদায়ী বছরে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৬ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। বিদায়ী বছর শেষে তা বেড়ে ১৩ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে ২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা বেড়েছে। এছাড়া স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অসাধ্য হওয়ায় অবলোপন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক।
বিদায়ী বছরের শুরুতে পরিকল্পনা অনুযায়ী আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয় সোনালী ব্যাংক। কিন্তু মহাব্যবস্থাপকদের দ্বারা পরিচালিত সব কয়টি আঞ্চলিক কার্যালয় এক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকটির ঢাকা অঞ্চল-২ লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে। ৪৬৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আদায় করেছে মাত্র ৭১ কোটি টাকা। একইভাবে খুলনা অঞ্চলিক কার্যালয় ১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা আদায়ের কথা থাকলেও মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। ১৯৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও মাত্র ৪৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ করপোরেট শাখার। বিদায়ী বছরে ১২৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের কথা থাকলেও মাত্র ৩ কোটি টাকা আদায় করেছে এ শাখা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য বহুল সমালোচিত রমনা করপোরেট শাখা আদায় করেছে মাত্র ১২ কোটি টাকা। বিদায়ী বছর শাখাটির ৩৮৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, ব্যাংকের ১ হাজার ২০৯টি শাখার মধ্যে ৬০০ শাখায় খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশেরও কম। কিন্তু ২০টি শাখায় মোট ঋণের ৮৪ শতাংশ এবং পাঁচটি শাখায় ৫৪ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। কিছু অসৎ ঋণগ্রহীতার কাছে ব্যাংকের টাকা আটকে আছে। এটা বাদ দিলে সোনালী ব্যাংকের ঋণখেলাপি খুব বেশি নয়। মূল সমস্যা হচ্ছে, বড় শাখায় বড় ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না।
- Courtesy: Bonikbarta.com/Feb 4, 2018
No comments:
Post a Comment