হাছান আদনান
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু নভেম্বরেই তা ১৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ডিসেম্বরের ঋণ যোগ করলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। সে তুলনায় আমানত বাড়াতে না পারায় তারল্য সংকটে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে তাই ঋণের সুদহারও বাড়িয়ে দিচ্ছে এসব ব্যাংক।
জানা গেছে, বছরের শুরু থেকেই বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে গ্রাহকদের চিঠি দিচ্ছে। কৃষিঋণের সুদহার এরই মধ্যে ১২ শতাংশের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এসএমই ঋণের সুদহার। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক এসএমই ঋণের সুদহার ২০ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ফেনী শহর শাখা থেকে ৪৫ লাখ টাকার কৃৃষিঋণ নিয়েছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ফাওজান মত্স্য খামারের নামে নেয়া এ ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। নতুন বছরের শুরুতেই সুদহার ১৩ শতাংশ নির্ধারণ করে গ্রাহককে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকটি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, কৃষিঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশের বেশি সুদ আদায়ের সুযোগ নেই।
বেসরকারি ব্যাংকের এমডিরা বলছেন, দীর্ঘ স্থবিরতার পর গত ছয় মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলো অস্বাভাবিক হারে ঋণ বিতরণ করেছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশে ঠেকেছে। আমানতের প্রবৃদ্ধি না বাড়ায় তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমানত সংগ্রহে এর সুদহার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে। আর বেশি সুদে আমানত সংগ্রহের কারণে ঋণের সুদহারও বাড়াতে হচ্ছে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, বাজারের পরিস্থিতিই আমানত ও ঋণের সুদহার বাড়াতে মূল ভূমিকা রাখছে। আমানতের জন্য ৮ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হলে ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া যায় না। এজন্য ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি শ্লথ। কয়েক বছর ধরেই রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিম্নমুখী। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো খাদ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতির বিপুল এলসি খুলেছে। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে এলসিগুলো নিষ্পন্ন হলে সঙ্গে সঙ্গে টাকা পরিশোধ করে দিতে হবে। এ অবস্থায় ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকটের তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৫৭টি তফসিলি ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৯২ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকেরই ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য। বাকি টাকার মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ সেভাবে না বাড়লেও অস্বাভাবিক বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ। ফলে নগদ টাকার তীব্র সংকটে পড়তে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, গত তিন বছরে ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই আমানতের সুদহার কমিয়েছে। কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদহার ২ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে এনেছিল। সে সময় আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির নিচে না নামানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দফায় দফায় সার্কুলার জারিসহ বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংকই তা আমলে নেয়নি। ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো লাভ না হওয়ায় মানুষ ব্যাংকবিমুখ হয়ে সঞ্চয়পত্র, শেয়ারবাজারসহ ভিন্নমুখী বিনিয়োগ শুরু করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ডেরই ফল।
বাস্তবতার নিরিখেই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমাতে বাধ্য হয়েছিল বলে জানান এবিবির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছিল। আমানতের সুদহার কমিয়ে পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আনলে ব্যাংকগুলো টিকতে পারত না। গত তিন বছর ঋণের সুদহার ধীরে ধীরে কমানো হয়েছিল। বাজারের পরিস্থিতির বিচারেই আমানত ও ঋণের সুদহার ওঠানামা করে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার বাড়ালেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখন আগের সুদই আদায় করছে। হাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকায় সুদহার বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করছে না তারা। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওবায়েদ উল্লাহ্ আল্ মাসুদ বলেন, এ মুহূর্তে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের এডি রেশিও (আমানত ও ঋণ অনুপাত) ৯০ শতাংশের কাছাকাছি। ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ করতে হলে অবশ্যই আমানত সংগ্রহ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় অংকের আমানত সংগ্রহ করা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য দুরূহ। এজন্য সব বেসরকারি ব্যাংকের ভরসা এখন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। প্রতিনিয়ত আমাদের কাছ থেকে আমানত নেয়ার জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলো ভিড় বাড়াচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, গ্রাহকরা ঋণের জন্য আমাদের কাছে আসুক। এজন্য সুদহার বাড়ানোর প্রয়োজন নেই আমাদের।
ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ হলেও কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আগ্রাসী ব্যাংকিং হিসেবে চিহ্নিত করে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও এডি রেশিও কমানোর বিরোধিতা করছেন বেসরকারি ব্যাংকের এমডিরা।
- Courtesy: Banik Barta Jan 24, 2018
No comments:
Post a Comment