সম্পাদকীয়
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বহুল সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা বিলুপ্ত করে একই ধরনের 'অপরাধ' ও শাস্তি পুনর্বিন্যস্ত করে মন্ত্রিসভায় সোমবার অনুমোদিত 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮'র খসড়া নতুন করে পুরনো প্রশ্নগুলো সামনে এনেছে। নতুন আইনে যদিও সর্বনিম্ন ৭ বছরের শাস্তির বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে, এর ৩২ নম্বর ধারাটি আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে 'বেআইনিভাবে' প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, সংরক্ষণ ও প্রেরণ করেন, তাহলে তা 'গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ' হিসেবে গণ্য হবে। এর শাস্তি হিসেবে ১৪ বছর জেল ও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। আমরা মনে করি, এই বিধানটি কেবল বিভ্রান্তিকর নয়, বিপজ্জনকও। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত শীর্ষ প্রতিবেদনে ৩২ নম্বর ধারাটিকে যথার্থই 'ভয়ঙ্কর' আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের আশঙ্কা, এই ধারা সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত, এমনকি বিপন্ন করবে সাংবাদিকদের। বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সংঘটিত দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচন করতে হলে সেখানে উপস্থিত হয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ জরুরি। ক্ষেত্রবিশেষে গোপনীয়তাও জরুরি। বস্তুত বাংলাদেশ শুধু নয়, গোটা বিশ্বেই সাংবাদিকতার এ এক বহুল চর্চিত নিয়ম। নতুন আইনের ৩২ ধারা অনুসরণ করতে গেলে আর যাই হোক, সাংবাদিকতা চলবে না। আর সাংবাদিকদের এই তৎপরতা যে পরোক্ষভাবে প্রশাসন, সরকার তথা জাতির জন্যই কল্যাণকর, বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত গোপনে ধারণ ও প্রচারের মধ্য দিয়েই তা নানা সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। একই সঙ্গে 'বেআইনি প্রবেশ' বিধানটি হাস্যকর ছাড়া কিছু নয়। প্রবেশের অনুমতি নিতে যাওয়ার অর্থই তো প্রথমে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করা! আমরা জানি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বিষয়ক আলাদা আইন রয়েছে; রয়েছে গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত আলাদা আইনও। তারপরও ডিজিটাল নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনে এই ধারার সংযোজন অর্থহীন ছাড়া কী? আইনমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে, সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশ করলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে না এবং আইনে অযথা হয়রানি বন্ধের ব্যবস্থা রয়েছে, আমরা ভরসা করতে পারছি না। আমাদের মনে আছে, ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা নিয়ে তখনও বলা হয়েছিল যে, সাংবাদিকদের হয়রানি করা হবে না। বাস্তবে ওই ধারার এতটা অপপ্রয়োগ দেখা গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশ ছাড়া মামলা নেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়েছিল। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের সঙ্গে আমরা একমত যে, নতুন আইনের ৩২ ধারার সংযোজন অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাও গুরুতর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে। আমরা চাই, অবিলম্বে ধারাটি বাতিল করা হোক। ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিমত নেই। ডিজিটাল ডিভাইসের অপব্যবহারও আমরা প্রায়শই দেখছি। কিন্তু তার নামে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ৫৭ ধারার বদলে ৩২ ধারা বাংলা প্রবাদের নাকের বদলে নরুন প্রাপ্তিকেই রূপায়িত করবে।
- Courtesy: The Daily Samakal Jan 31, 2018
No comments:
Post a Comment