Search

Thursday, January 25, 2018

ক্যাম্পাসে এ কার ছবি!


রেজানুর রহমান



ছবিগুলোর দিকে তাকাতে পারছি না। লজ্জার পাশাপাশি উদ্বেগ, উত্তেজনাও ভর করেছে। ছবি এত বীভৎস হয়! ছবি এত লজ্জাতুর হয়? ছবি এত অশ্লীল হয়? এগুলো কার ছবি? আমার আপনার আমাদের ছেলে-মেয়েদেরই ছবি। ওদেরকে পড়তে পাঠিয়েছি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোথায় ওদের সাফল্যের ছবি দেখব, পরীক্ষায় ভালো করেছে তার ছবি, খেলাধুলায় মেডেল জিতেছে তার ছবি, গান গেয়ে-অভিনয় করে সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তার ছবি দেখার অপেক্ষায় সারাক্ষণ উম্মুখ থাকব—অথচ কি সব বীভৎস ছবি দেখলাম দেশের প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে, টিভি চ্যানেলে! আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো এসব ছবি প্রদর্শনের রীতিমতো একটা প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এক্সক্লুসিভের নামে কে কতটা খোলামেলা, রগরগে ছবি দেখাতে পারে তার প্রতিযোগিতা। এখানে একটা যুক্তি উঠতেই পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পড়াশোনা বাদ দিয়ে আপনি চুলের মুঠি ধরে অশ্লীল লড়াই করবেন আর আমি ছবি তুলব না, তা তো হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় হলো পড়াশোনার জায়গা। চুলের মুঠি ধরে অশ্লীল লড়াই করার জায়গা তো নয়...!

লড়াইয়ের সঙ্গে অশ্লীল শব্দটা জুড়ে দিয়ে একটু যেন চমকে গেলাম। লড়াইও অশ্লীল হয়? হ্যাঁ, হয়ই তো। ২৪ জানুয়ারি দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার ওপর যত ছবি প্রকাশ হয়েছে তার সবই অশ্লীল লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। যেমন কালের কণ্ঠে যে ছবিটি ছাপা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে একদল ছাত্র নারকীয় কায়দায় মারধর করছে প্রতিপক্ষের একজন ছাত্রনেতাকে। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার একপর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দীকে বেধড়ক মারধর করা হয়’। দৈনিক প্রথম আলোয় দুটি ছবি ছাপা হয়েছে। একটিতে দেখা যাচ্ছে, তিন-চারজন ছাত্রী অন্য এক ছাত্রীর চুলের মুঠি ধরে নারকীয় ভঙ্গিতে টানছে। এই ছবির নিচে ক্যাপশন লেখা হয়েছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়নের বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা। মানবজমিনে প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ছাত্রকে উপর্যুপরি লাথি মারছে ২০-২৫ জন ছাত্র। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। উপাচার্যের কক্ষের গেট ভাঙছে উত্তেজিত ছাত্ররা। সমকালের তিনটি ছবির নিচে ক্যাপশন লেখা হয়েছে—‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দের ব্যানারে মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অবরোধ করতে গিয়ে তাঁর কার্যালয়ের গেট ভেঙে ফেলে শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের ব্যাপক মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।’ যুগান্তরের একটি ছবিতে দেখা যায়, এক ছাত্রীর শরীরে ফিল্মি স্টাইলে লাথি মারছে একজন ছাত্র। নিচে ক্যাপশন লেখা—ঢাবিতে যৌন নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে  আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। ইত্তেফাকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, এক ছাত্রীর ওপর রড উঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছে কয়েকজন তরুণ। নিচে ক্যাপশন লেখা, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবরুদ্ধ উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানকে উদ্ধারে গিয়ে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর রড হাতে চড়াও হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা’। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত চারটি ছবির একটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ছাত্রীর মাথার চুলের মুঠি ধরে টানছে একজন ছাত্র। তাকে সহায়তা করছে অন্য একজন ছাত্রী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছবিটির ক্লক ওয়াইজ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওই ছাত্রীকে নারকীয় কায়দায় মারধর করছে দুজন ছাত্রী। আক্রান্ত ছাত্রীর শরীর থেকে ওড়না খসে পড়েছে। অপর ছবিটি শুধু নারকীয়ই নয়, চরম অশ্লীলও বটে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আগের নিরীহ ছাত্রীটিকে চুলের মুঠি ধরে টানছে একজন ছাত্রী। তার পাশে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন ছাত্র। আক্রান্ত ছাত্রী প্রাণপণে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ফলে তার শরীরের পোশাক বেসামাল হয়ে উঠেছে। পরের ছবিটি আরো মারাত্মক। আক্রান্ত অসহায় ছাত্রীটি বুকে ওড়না চেপে তার সম্ভ্রম ঢাকতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে একজন আলোকচিত্রী তার অসহায় পরিস্থিতির ছবি তুলছে। পরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এতক্ষণ যারা মেয়েটির ওপর চড়াও হয়েছিল তারাই আবার মেয়েটির ওড়না ধরে টান দিচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ছাত্র।

শেষের ছবিটির দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ছবিতে অসহায় মেয়েটি বুকে ওড়না চেপে তার আব্রু ঢাকার চেষ্টা করছে। অথচ তার ওড়না টেনে নিচ্ছে একজন মেয়ে। এই মেয়েটির চেহারা অনেক সুন্দর। দেখতে পরির মতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এই ছবিটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। একজন সাংবাদিক লিখেছেন, ‘হঠাৎই বিশ্বজিতের ছবিটি মনে পড়ল। এভাবেই না চারপাশ ঘিরে ধরে মৃত্যু এসেছিল। সে মৃত্যুও আমাদের অপরাধী করেনি। হামলাকারী মেয়েটি সম্পর্কে একজন মন্তব্যে লিখেছেন, ‘সুন্দর চেহারার মেয়ে অথচ কি বীভৎস রূপ...’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যা ঘটছে তাকে বীভৎস রূপের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। জানি না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকার এ ব্যাপারে কী ভাবছে। তবে কিছু সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছি। তেজগাঁও নাবিস্কো মোড়ের একটি পত্রিকা বিক্রির দোকানে বেশ ভিড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনার খবরের ওপরই সবার চোখ। নানাজন নানা মন্তব্য করছে। পত্রিকায় একটি মেয়ের ওড়না টেনে ধরার ছবি দেখে একজন মন্তব্য করল—হ্যারা দেখি মাইয়াগো বুকের ওড়না ধইর‍্যা টানাটানি করে! হ্যারা কি তাইলে লেহাপড়া করে না? অন্য একজন একটা অশ্লীল মন্তব্য করল। তার মন্তব্য শুনে কান চেপে ধরলাম। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। ছি: ছি: কী লজ্জা... 

  • লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার; সম্পাদক, আনন্দ আলো



No comments:

Post a Comment