বিশেষজ্ঞদের অভিমত
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ আইন মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করবে। মানুষ ভীত হয়ে পড়বে। তারা কথা বলতে ভয় পাবে। ৫৭ ধারার যে অপপ্রয়োগ হচ্ছিল নতুন আইন অন্যভাবে প্রকাশ পাবে। আইনের ৩২ ধারা সরকারি-আধাসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করেন এবং কোনো ধরনের তথ্যউপাত্ত যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করেন তা গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবে গণ্য হবে। এ জন্য ১৪ বছরের জেল এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ধারার অপরাধকে জামিন অযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ মানহানিকর তথ্য দিলে তার বিরুদ্ধে তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ৩১ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এসব ধারা সমাজে আতঙ্ক তৈরি করবে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহসী হবেন না। বিশেষ করে গণমাধ্যমের সাথে জড়িতরা হয়রানির শিকার হবেন। গতকাল নয়া দিগন্তকে সিনিয়র সাংবাদিক, বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদেরা এ কথা জানান।
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক মাহফুজ উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, নতুন এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীন চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করা। ক্ষমতাসীনদের অপরাধের ঢাকনা বন্ধ করা। এ আইন লঙ্ঘন করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার যে বিধান রাখা হয়েছে তা আমাদের এই দেশে অকল্পনীয়। তিনি বলেন, এ আইনে নতুন যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে এটা ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কোনো আলোচনা করা যাবে না, মুক্তভাবে কোনো কথা বলা যাবে না, এর ফলে হয়তো মানুষ সতর্ক হবে। তবে দেশে যে মুক্তবুদ্ধি চর্চা হতো তার পথ রুদ্ধ হবে। মুক্ত চিন্তার জগতটা একটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হবে। মাহফুজ উল্লাহ বলেন, এই আইনের মাধ্যমে সরকার প্রতিপক্ষকে আঘাত করবে। তবে বিরোধী দল দমন হবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ আইন পাস হলে আওয়ামী লীগই প্রথম এর শিকার হবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, এমনিতেই নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে। নতুন এ আইন পাস হলে নাগরিকদের অধিকার সঙ্কুচিত হবে। বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনার ওপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত হয়নি। নাগরিক অধিকার হরণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের একজন নাগিরক হিসেবে আমি শঙ্কিত না হয়ে পারি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল নয়া দিগন্তকে বলেন, নতুন যে আইনটি করা হয়েছে তা আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার চেয়েও খারাপ একটা আইন। কারণ এখানে আরো নতুন ধরনের অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন ৫৭ ধারার অপরাধগুলোর সংজ্ঞায় যে অস্পষ্টতা ছিল সেটাও অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং এ আইনের বিষয়ে বিশদ যে অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে এ আইনের দ্বারা বাংলাদেশে ভিন্নমত চর্চা করা, বিরোধী রাজনীতি করা, সরকারের কোনো এমপি-মন্ত্রী বা সমাজের যেকোনো পাওয়ারফুল লোকের বিরুদ্ধে সৎ সাংবাদিকতা করা, তার বিরুদ্ধে কোনো শব্দ উচ্চারণ করা, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। এ আইন করার মধ্য দিয়ে সরকারের পাওয়ারফুল সেকশন তাদের অন্যায় অবিচার, জুলুম যেটার বিরুদ্ধে সৎ সাংবাদিকতা করা, এটার বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ বন্ধ করতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি মনে করি বিরোধী রাজনীতিক নয়, সমাজের যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, বিশেষ করে দেশের নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিক সমাজের অবশ্যই এ আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। এ আইন যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে বাংলাদেশে সৎ সাংবাদিকতা করা, স্বাধীন কণ্ঠে কোনো বিষয়ে সমালোচনা করা, বিরোধী রাজনীতি করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগে এ ধরনের আইন করার বিশেষ উদ্দেশ্য আছে বলে আমি মনে করি।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, নতুন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে এ আইনে সম্পূর্ণভাবে মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ ও মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এ আইন বাস্তবায়ন হলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা নয়, কোনো সাংবাদিকতাই করা যাবে না। সরকারের কোনো অফিসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করলে তারা বলবে আমাদের অনুমতি নেয়া হয়নি। এটাতো হতে পারে না। এ আইনের ফলে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো: হাসানুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের তো বাকস্বাধীনতা আছে। আমি যা ইচ্ছা তাই বললাম এতে অন্যকে হার্ট করে না, মানহানি করে না। সত্য কথা বললে বা প্রকাশ করলে মানহানি করে না। মিথ্যা কথা বললে বা প্রকাশ করে মানহানি করে তাহলে মামলা হওয়া উচিত। সত্য প্রকাশ করলে তাতে মানহানি হলো বা না হলো এতে মামলা হওয়া উচিত নয়। সত্য প্রকাশ করলে কেউ যদি বলে তার মানহানি হয়েছে, আর মামলা করতে যায় তাহলে ওই মামলা নেয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এটা সরকারের জন্য একটা হাতিয়ার। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ যেন কোনো কথা বলতে না পারে, লেখালেখি করতে না পারে সে জন্য এ ধরনের আইন তৈরি করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ও বিএফইউজের (একাংশ) সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল নয়া দিগন্তকে বলেন, দেখেন, বাংলাদেশে অপরাধের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। অপরাধী, জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ করছে। কাজেই সেই অপরাধ দমনের জন্য আধুনিক আইনের প্রয়োজন আছে। এ ধরনের কোনো আইন হলে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে আমাদের উদ্বেগ হচ্ছে, সেই অপরাধী বা জঙ্গি-সন্ত্রাসী ধরার জন্য যে আইন হচ্ছে সেই আইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ হয় কি না। ৫৭ ধারা যখন হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল এটা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু দুঃজনক হচ্ছে পরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এটার অপপ্রয়োগ হয়েছিল। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে ধারাগুলো আছে তার মধ্যে কিছু আছে যার অপপ্রয়োগ হবে, এ রকম আশঙ্কা করছি। সেই আশঙ্কা থেকেই বলছি, এটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খসড়া হয়েছে। এটা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন নিতে হলে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হবে। এ আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যাতে অপপ্রয়োগ না হয় সে জন্য গণমাধ্যমের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের সাথে আলোচনা করে এ উৎকণ্ঠা দূর করা উচিত।
- Courtesy:Daily Naya Diganta/Jan 31, 2018
No comments:
Post a Comment