কাদের গণি চৌধুরী
বছরের পয়লা দিন। স্কুল পড়ুয়া শিশুরা সেজে-গুজে নতুন বইয়ের জন্য ছুটছে স্কুলে। বই পেয়ে ওরা আনন্দে আত্নহারা। নতুন বই হাতে শিশুরা হাসছে, নাচছে, গাইছে। স্কুলে স্কুলে চলছে উৎসব। কোনও এক জাতীয় দৈনিক এনিয়ে কাব্যিক শিরনাম করেছে: "চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো"।
কিন্তু হবিগঞ্জের সুমিদের মুখে সেদিন হাসি ছিল না। ছিল চোখেমুখে বিভীষিকার ছায়া । চাঁদের হাসি নয়, ওদের মাথায় ভেঙ্গে পড়েছে আকাশ। সরকারের লেলিয়ে দেয়া পেটোয়া বাহিনী ওদের বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে। সে সঙ্গে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে সুমিদের চার ভাইবোনের স্বপ্ন।
আর কোন দিন বাবার আদর জুটবেনা তাদের ভাগ্যে। বাবার হাত ধরে আর কোন দিন ঈদগাহে যেতে পারবেনা সুমির ছোট ভাইটি। একমুঠো চকলেট নিয়ে এসে উঠোন থেকে সুমি বলে আর কেউ ডাকবেনা।
বাবার কাছে সুমির বায়না ছিল পিএসসি পাস করলে যেন সুন্দর দেখে একটি স্কুল ব্যাগ কিনে দেওয়া হয়। বাবা বলেছিল. দেবো মা। পিএসসিতো পাস করেছে, কিন্তু কে কিনে দেবে স্কুল ব্যাগ। কে নিয়ে যাবে স্কুল ছুটিতে বেড়াতে?
সুমির বাবা ইউনুস আলী হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ছাত্রদলের এক সময়ের ডাকসাইটে নেতা। ছাত্ররাজনীতি ছেড়ে যুবদলের রাজনীতিতে যোগ দেন বছর কয়েক আগে। দলীয় কাজে যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি মানুষের সুখ-দুঃখে সব সময় পাশে থাকতেন। চুনারুঘাটের এ কৃতিসন্তান বিএনপির দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জননন্দিত এ নেতাকে টার্গেট করে।প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করতে নানান মামলায় জড়ানো হয় তাকে। একে একে এগারটি মামলা দেয়া হয়। সম্প্রতি তিনি সব মামলায় জামিনে মুক্তিও পান । কিন্তু কে জানতো এ জামিন কেবল বিচারিক আদালতের। অাদালতের বাইরে তার প্রাণ কেড়ে নিতে ওঁত পেতে আছে সরকারের বাহিনী। ১জানুয়ারি রাত সোয়া ১২টায় পুলিশ ধরে নিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে বিরোধী দলের এ সক্রিয় কর্মীকে।
বড় মেয়ে সুমি পিএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে শুনে রবিবার ইউনুস বাড়ীতে আসেন। মেয়ে বুকে টেনে নিয়ে আদর করেন।হাতে গুঁজে দেন চকলেট। বললেন এসপ্তাহে তোদের স্কুল ব্যাগ কিনে দেব। তার পর ইউনুছ ৪বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হন। কে জানত এটিই বাবার হাত ধরে তাদের শেষ ঘোরাঘুরি।
শহীদ ইউনুছ আলীর বড় মেয়ে সুমি ৫ম শ্রেণী পাস করলো। আর ছেলে ও মেজ মেয়ে মাত্র তৃতীয় শ্রেনীতে। ছোট মেয়ে মায়ের অবসরের সঙ্গী।শহীদ ইউনুছ আলী একেবারে তৃনমূল থেকে উঠে আসা শহীদ জিয়ারআদর্শের এক সৈনিক। ছাত্রদল থেকে উঠ এসে সর্বশেষ চুনারুঘাট পৌর যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক এর দায়িত্ব পালন করেছেন । বিএনপির অন্য নেতাদের মতো ১১টি রাজনৈতিক ও ভূয়া মামলা দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে।
সব মাললায় মুক্তি পেলেন বেকসুর। তবে কেন ক্রসফায়ারে হত্যা করা হলো ইউনুস আলীকে?
সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেলো এক নির্মম কাহিনী।
গত সাড়ে ৫ মাস আগে যুবদল নেতা ইউনুস অালীকে গ্রেপ্তার করতে তার বাড়ী অভিযান চালায় পুলিশ । এই সময় ইউনুছ আলীকে না পেয়ে তার ৭ বছর বয়সী মেয়ে ও স্ত্রী উপর শাররিক ও যৌন নিযার্তন চালায় চুনারুঘাটের এসআই দেলোয়ার হোসেন ও তার সঙ্গী পুলিশ সদস্যরা । পরে ইউনুসের স্ত্রী বাদী হয়ে কোর্টে মামলা করেন চুনারুঘাট থানা এসআই দেলোয়ার হোসেনসহ অভিযুক্ত অন্য পুলিশ সদস্যের নামে । আর সেটাইকাল হয়ে দাঁড়ায় ইউনুছের পরিবারের । গত ২ মাস আগে কোর্ট আত্মসমর্পণ করেন ইউনুছ এবং সব মামলা জামিন পেয়ে মুক্ত হয়।এইদিকে এসআই দেলোয়ার হোসেন ইউনুছের স্ত্রীকে মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন এবং মামলা না তুলে পুরো পরিবারকে হত্যা করা হবে বলে বিভিন্ন সময় হুমকি দেন।
ইউনুছ তার মেয়ে এবং স্ত্রীর উপর শারীরিক ও পাশবিক নিযার্তনকারী এসআই দেলোয়ার হোসেন নামে দায়ের করা মামলা তুলবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্দ হন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস আই দেলোয়ার। গত পরশু এসআই দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্ব একটি টিম তুলে নিয়ে যায় ইউনুছকে বাড়ী থেকে। একদিন পর গতকাল ক্রসফায়রে হত্যা করে তাকে। এরপর মাদক ব্যবসায়ী বলে পোষা মিডিয়াতে চালিয়ে দেয় ।
গতকাল ইউনুছের চার সন্তানের আর্তনাদে বাতাস ভারি হয়ে উঠে। বাবার রক্তাক্ত লাশ সামনে রেখে বিলাপ করছে অবুঝ এ শিশুরা। তাদের একটি প্রশ্ন কেন বাবাকে হত্যা করা হলো? তার স্ত্রী ও পাড়া-পড়শীদেরআহজারিতে আল্লাহর আরশও যেন কাঁদছিল।
একবৃদ্ধা বিলাপ করছিলেন আর বলছিলেন - হে আল্লাহ তুমি কি পাষাণ হয়ে গেলে? আমরা যে এ শিশুদের কান্না আর সইতে পারছিনা। এ নিষ্ঠুরতার বিচার কি তুমি করবে না?
No comments:
Post a Comment