Search

Thursday, March 1, 2018

চট্টগ্রামে বেপরোয়া ছাত্রলীগ, নেপথ্যে বুড়োদের খেল



গঠনতন্ত্র মতে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অরাজনৈতিক সহযোগী সংগঠন। যা ছাত্রলীগের সিংহভাগ নেতাকর্মীরও জানা নেই। তারা জানেন, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ‘ছাত্র রাজনৈতিক’ সংগঠন। 


সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় বলে থাকেন ছাত্রলীগ শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানগার্ড। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা চলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও এমপিদের কথায়। কারণ এদের রয়েছে প্রাপ্তির বড় নেশা। পদ-পদবি, টেন্ডার, সরকারি প্রকল্প হাতানো, বালু উত্তোলন, পাহাড় কাটা, থানা ও উপজেলা প্রশাসন বাণিজ্য, মাদক পাচার ও বিক্রয়সহ নানা অপরাধে সুবিধার সহজ মাধ্যম হচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা।


বিনিময়ে মন্ত্রী-এমপিরাও যথেচ্ছা ব্যবহার করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। যারা যে কোনো স্থানে, যে কোনো সময় হামলা-মারামারি ও সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দ্বিধা করে না। মূলত ছাত্রলীগের নৈরাজ্যের নেপথ্যেই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বুড়োদের খেল। এমন অনুযোগ ছাত্রলীগের নিচু ও মধ্যম সারির নেতাকর্মীদের। তাদের অভিযোগ, প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে উঁচু সারির নেতারা এ ব্যাপারে মুখ খুলেন না।

নেতাকর্মীরা জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর চট্টগ্রাম মহানগর, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তর দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নৈরাজ্যের পেছনে বার বার উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বর্তমান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের নাম।  মহানগর থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সবখানে ছাত্রলীগ এই দুই নেতার অনুসারী হিসেবে দু’গ্রুপে বিভক্ত। যা এখন ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল ছাত্রলীগেও।

যদিও স্কুল ছাত্রলীগ বলতে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে কোনো অস্তিত্ব নেই। তবুও এই স্কুল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মহানগর, ওয়ার্ড ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় চলে। বড়ভাইদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্কুল ছাত্রলীগের কিশোর ছাত্ররাও বেপরোয়া। গত তিনমাসে এই স্কুল ছাত্রলীগের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে সুভাষ বড়ুয়া, আদনান ও ইব্রাহিম নামে তিন কিশোর। যত্রতত্র ঘটছে ভয়াবহ সংঘর্ষও।

এদের সবার চোখে মুখে শুধুই প্রাপ্তির নেশা। কারও নেশা সংগঠনের শীর্ষ পদে আসীন হয়ে নেতৃত্বের প্রভাব সৃষ্টি করা। কারও নেশা আধিপত্য বিস্তার করে বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করা। গত মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে এমন এক ভয়ংকর নেশায় মেতে উঠে উত্তর জেলা ছাত্রলীগ। বিস্ফোরণ, হাতাহাতি-মারামারিতে পণ্ড হলো তাদের সম্মেলন। আর এ ঘটনায় উঠে আসে আরেক বুড়োর খেল। তিনি হচ্ছেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। 

নেতাকর্মীরা জানান, যে কারণে সম্মেলন, সে সম্মেলনে গঠনতন্ত্রের বাইরে বিনা কাউন্সিলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আগে থেকেই ঠিক করে ফেলেন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। যা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জেনে যান ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ফলে এই ঠিক, বেঠিক করে দেয়ার জন্য আগে থেকেই সম্মেলন পণ্ডের প্রস্তুতি নেন অন্য নেতার অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। যেসব নেতারাও ওইদিন সম্মেলন মঞ্চে উপিস্থত ছিলেন। এরমধ্যে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছিলেন অন্যতম। নেপথ্যে ছিলেন রাঙ্গুনিয়ার সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসান মাহমুদের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও। ছিলেন হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও। 

আলাপকালে নেতাকর্মীদের অনেকেই জানান, সম্মেলনের আগেই মিরসরাই উপজেলার তানভীর হোসেন তপুকে সভাপতি এবং সন্দ্বীপ উপজেলার মফিদুল ইসলাম জিকুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হবে এমন কথা সবার মুখে মুখে ছিল। এই দুইজন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপির সুনজরে ছিল। দুইজনের কমিটির ফাইল ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের হাতে তুলে দেয়ার পর শুরু হয় হট্টগোল। 

বিশেষ করে রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারী উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এই হট্টগোল শুরু করে। একপর্যায়ে মিরসরাই-সিতাকুণ্ড ও সন্দ্বীপ উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতি-মারামারি শুরু হয়। এ সময় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিরোধী স্লোগানও দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। হাতাহাতি-মারামারির চেয়েও ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য ছিল সম্মেলন মঞ্চ। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে লক্ষ্য করে চেয়ার ছুড়ে মারেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। 

একপর্যায়ে অতিথিরা চলে যাওয়ার সময় রাউজান উপজেলা ছাত্রলীগের এক নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পথ আগলে ধরেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ওই ছাত্রলীগ নেতার ওপর চড়াও হন।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়ব সংঘর্ষের সময় সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ছাত্রলীগে ঢুকে পড়া জামায়াত শিবিরের লোকজনই মারামারির ঘটনা ঘটিয়ে সম্মেলন পণ্ড করেছে। সভাপতি বখতিয়ার সাঈদ ইরান বলেন, বহিরাগতরা পরিকল্পিতভাবে সম্মেলন পণ্ড করার জন্য এই ঘটনা ঘটিয়েছে। দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। এদিকে সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়ব ও সভাপতি বখতেয়ার সাঈদ ইরান ও দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাসান মাহমুদের অনুসারী বলে জানা গেছে। হাসান মাহমুদ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তাদের এই কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর আর কোনো সম্মেলন হয়নি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের। তবে রাউজানের তরুণ নেতা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন বলেন, এসব বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। এটুকু বলবো নেতাকর্মীরা কেউ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস না পেলেও ক্ষোভ পুষে রেখেছিল। এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। 

এর আগের দিন সোমবার বিকালেও চট্টগ্রাম লালদীঘির মাঠে প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্মরণসভায় একই ঘটনা ঘটায় ছাত্রলীগ। সেখানে দফায় দফায় হাতাহাতি-মারামারি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনার পর রাতে ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে কোনোমতে শেষ হয় স্মরণসভা। আর এই সংঘর্ষ ঘটে মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারী ও আ জ ম নাছির উদ্দিন অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর মধ্যে। যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। 

এই দুই নেতার অনুসারী হিসেবে নগরীর সিটি কলেজ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ছাত্রলীগ দুই গ্রুপে বিভক্ত। তারাও পদ-পদবি, টেন্ডার, সরকারি প্রকল্প ও ব্যবসা হাতিয়ে নেয়া ও মাদক পাচার-বিক্রির মতো কাজে লিপ্ত। এসব কাজে আধিপত্য বিস্তারের নেশায় প্রায় সময় তারা সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। 

এর কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরের কার্যালয় এবং সাধারণ মানুষের গাড়ি ভাঙচুর করার পাশাপাশি তিন সাংবাদিকের ওপরও হামলা চালিয়ে আহত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জড়িত আট শিক্ষার্থীকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

তবে ছাত্রলীগের এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ নগর ও জেলা আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ছাত্রলীগে টোকাই শ্রেণি এবং হাইব্রিডের আধিপত্য বেড়ে গেছে। যারা তদবির করে পদ-পদবি নিয়েছে কিংবা নিতে চায় তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে এসব করছে। এ রকম প্রাপ্তির নেশায় বেপরোয়া এখন ছাত্রলীগ। আবার মন্ত্রী-এমপিরাও টোকাই এবং হাইব্রিডকে সঙ্গে নিয়ে যায় যে কোনো কর্মসূচিতে। এটাই হচ্ছে ছাত্রলীগে বুড়োদের খেল। যা কোনো নীতিতে পড়ে না। 

  • Courtesy: Daily Manabzamin Mar 01, 2018


No comments:

Post a Comment