Search

Sunday, March 4, 2018

সংকটটা খুব গভীর


সাম্প্রতিক এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। একে বেশকিছু পণ্ডিত ব্যক্তি শিক্ষার সর্বনাশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমার মতে যা শিক্ষার সর্বনাশ, তা দেশেরও সর্বনাশ। যা হোক, শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, এবার এমন কড়া ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যে প্রশ্ন ফাঁসের আশঙ্কা মোটেই নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব কটি পরীক্ষারই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। গত ৯ বছর ধরেই বিচ্ছিন্নভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু এবার ব্যাপারটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর অদক্ষতা এবং ব্যর্থতাকেই বহুলাংশে দায়ী করতে হয়। কারণ এ ধরনের পাবলিক পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তাদেরই। প্রশ্ন ফাঁস কেন ঘটে এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি কীভাবে রোধ করা যায়- এ বিষয়গুলো দেশবাসীকে তাদের জানানো উচিত। অন্তত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জাতীয় সংসদে আলাপ-আলোচনা হবে এবং শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবেন, এটা আমাদের খুবই কাম্য ছিল।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখা গেল, বেশকিছু অসাধু শিক্ষক এবং কিছুসংখ্যক প্রতারক এই মহা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। দেশে মহামারী আকারে বিরাজমান দুর্নীতির সঙ্গে পরীক্ষায় জালিয়াতির মতো দুর্নীতিও ভালোভাবেই যুক্ত হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে একদল শিক্ষক, যারা মানুষ গড়ার কারিগর বলে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। বাস্তবে তারা মানুষ ধ্বংসের কারিগর হিসেবে জনসমক্ষে আবির্ভূত হয়েছে। একদিকে তারা শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা দিচ্ছে না, অন্যদিকে পরীক্ষার ব্যাপারে তরুণ বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের অসৎ-অন্যায় কর্মে দীক্ষা দিচ্ছে। কিছুদিন আগে দ্য ডেইলি স্টারে (১৪.০২.১৮) দেখা গেল, পরীক্ষা শেষে চট্টগ্রাম শহরের একটি কেন্দ্রে ফটোসাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে একদল ছাত্রী লজ্জায় মুখ ঢেকে নিচ্ছে। এ লজ্জা দেশের। এর দায়ভার শিক্ষা ও পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিতে হবে।

পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্নীতির ফলে অসংখ্য সৎ, পরিশ্রমী এবং মেধাবী ছাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়েছে এবং দুঃখ পেয়েছে। এমনই দেশের অসংখ্য অভিভাবকের হতাশার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল গত মাসের ১৪ তারিখে বিবিসির বাংলার প্রবাহ অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়ার এক মহিলা অভিভাবকের কণ্ঠে। দেশব্যাপী দুর্নীতির যে বাড়বাড়ন্ত চলছে, তা শিক্ষা ক্ষেত্রেও এত বিপুলভাবে বিস্তার লাভ করবে তা আমাদের প্রত্যাশিত ছিল না। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে অর্জিত উন্নয়ন নিয়ে আমরা যখন গর্ববোধ করি, তখন এই প্রশ্ন ফাঁসের মহামারী আমাদের দারুণভাবে হতাশ করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যদি সত্য এবং সততা পরিত্যক্ত এবং বর্জিত হয়, তাহলে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্যটিই নষ্ট হয়। কারণ শিক্ষার উদ্দেশ্যই হল সৎ, শিক্ষিত ও মেধাবী মানুষ তৈরি করা। ফাঁসকৃত প্রশ্ন এবং নকলবাজির মাধ্যমে পাস করা একদল নকল এবং তস্কর মানুষ দেশের সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু এ প্রশ্ন ফাঁস এবং পরীক্ষায় দুর্নীতি রোধ করা কি একটি সরকারের পক্ষে খুবই দুরূহ কাজ? সরকার জঙ্গিদের যে কঠিন হাতে দমন করেছে, একই কঠোরতার সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষার সর্বপ্রকার দুর্নীতি দমন করতেও সক্ষম বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ব্যাপারে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) যেভাবে পরীক্ষা নেয়, সেই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা যেতে পারে।

পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস, নকলবাজি, টাকার বিনিময়ে ফলাফল পরিবর্তন- এ ধরনের নানা রকমের দুর্নীতির কথা দেশে শোনা যায়। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার ফলে এবং বয়স্ক হওয়ায় বহু তরুণ আমাদের কাছে এসব বিষয়ে দুঃখ এবং হতাশা ব্যক্ত করে থাকে। তরুণদের এক বিরাট অংশের মনে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, দেশে ন্যায়-নীতি বলে কিছু নেই, বাংলাদেশে এগুলো চলে না। সৎপথে উন্নতি হয় না। দেশে আয়-উন্নতির জন্য দরকার হয় অন্যায়-অসৎ তথা ‘দুই নম্বরি পথ’, আর এ অন্যায় এবং অসৎ পথের প্রথম পাঠটি আমাদের কিশোর-কিশোরীরা এসএসসি পরীক্ষা থেকেই শুরু করছে। তারপর জীবনের নানা ঘাটে তারা দেখতে পায় ঘুষ-দুর্নীতির রমরমা ব্যবসা। চাকরির পরীক্ষায়ও একই কাণ্ড ঘটে। প্রশ্ন ফাঁস হয় এবং পরীক্ষায় সফল হলেও মেধাক্রম অনুযায়ী নিয়োগ হয় না। তার জন্য দরকার হয় বড় কর্তাদের বড় অঙ্কের টাকা প্রদান। অবৈধ টাকার বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা তাই কর্মজীবনে সে টাকা সুদে-আসলে তোলার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে কিছুসংখ্যক সংসদ সদস্য বা এমপিদের নিয়োগ বাণিজ্য সবারই জানা।

শুধু নিয়োগই নয়, বদলি এবং পদায়নের ব্যাপারেও অবৈধ টাকা-কড়ির লেনদেন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে। আমরা নিজেরাও এসব ঘটনা জানি। পুলিশ বিভাগে ঘুষের ব্যাপারটি সবারই জানা। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন উপকমিশনার এক সম্মেলনে প্রকাশ্যেই বলেছেন, পুলিশ বাহিনীতে ঘুষ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। তিনি ঢাকার একটি থানার ওসি বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হতে এবং একজন এসআইকে সুবিধাজনক তথা লাভজনক জায়গায় বদলি হতে কত টাকা ঘুষ দিতে হয় তার একটি তালিকাও দিয়েছেন (দ্য ডেইলি স্টার, ১৯.০২.২৮)। উল্লিখিত ঘুষের পরিমাণ অবাক করার মতো।

এত বড় অঙ্কের ঘুষ দেয়ার সক্ষমতা অর্জনের পেছনে যেমন অতীতের দুর্নীতি আছে, তেমনি বিশ্বাস করার কারণ আছে এই পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলির জন্য বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগ থেকে তারা বহুগুণ বেশি লাভবান হবে বলে তাদের আশা থাকে। আজকের পত্র-পত্রিকায় দেখা গেল, বর্তমানে দেশে যে ১০ হাজারের মতো পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগদান করা হবে, তাতেও নিয়োগ বাণিজ্যের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুলিশের কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং রাজনীতিক ও সংসদ সদস্যদের মতো কিছু লোক মিলিতভাবে এ নিয়োগ বাণিজ্যে অংশ নিতে পারে এ আশঙ্কায় পুলিশের সদর দফতর থেকে কয়েকটি মনিটরিং টিম সারা দেশ ঘুরে তদারকি করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।

দেশে বিরাজমান এ সর্বগ্রাসী দুর্নীতির প্রভাব শিক্ষাঙ্গনেও পড়েছে। আরও দশজন চাকরিজীবীর মতো শিক্ষকও দুর্নীতির মাধ্যমে ধনী হতে চায়। নিরামিষ নীতিকথায় তারা আটকে থাকতে চায় না। তাই তাদের একটি বড় অংশ বেছে নিয়েছে কোচিংবাজি, নকলে সাহায্য এবং প্রশ্ন ফাঁসের মতো জঘন্য অপরাধমূলক কাজ। ফলে শ্রেণীকক্ষে যথাযথ শিক্ষাদান, সত্যিকার পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা যাচাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মার খাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে দেশব্যাপী অপশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত একদল তরুণ-তরুণী, যারা দেশ ও জাতির উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারবে না।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, দেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কবল থেকে শিক্ষাঙ্গনও মুক্ত নয়। এটার লাগাম শক্ত হাতে অবিলম্বে টেনে না ধরলে দেশের সর্বনাশ হবে। কারণ উন্নয়নের মূল নায়ক হল মানুষ। মানবসম্পদই একটি দেশের বড় সম্পদ। আর মানুষ সম্পদে পরিণত হয় শিক্ষার গুণে। শিক্ষার ফল নির্ণয়ের জন্য যে পরীক্ষার অনুষ্ঠান, সেটাই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তবে সে শিক্ষা নামের প্রহসন দেশে এক বিরাট মানবসংকট সৃষ্টি করবে। এখনই শোনা যায়, দক্ষ লোকের অভাবের কারণে বহু বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করে এবং দেশের বহু কোটি ডলার তারা তাদের দেশে নিয়ে যায়।

আইন ও সুশাসনের অভাবের ফলে দেশে শিক্ষিত তরুণ সমাজের মধ্যে যে হতাশা বিরাজমান তা আমরা নিজেরাও দেখি। বহু প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী উন্নত পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার যুবসমাজের ওপর সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, শতকরা ৮২ জন তরুণ-তরুণী উন্নত ভাগ্যের আশায় দেশ ছেড়ে পশ্চিমা দেশে যেতে আগ্রহী। মেধাবী যুবসমাজের দেশত্যাগ, যাকে আমরা মেধা পাচার বলি, তার ফলে দেশের যে বিরাট ক্ষতি হয়, সেটা আমাদের জাতীয় নীতিনির্ধারকরা কি গভীরভাবে খতিয়ে দেখেছেন? দেশের নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতিসহ প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনা আসলে দেশের সর্বনাশেরই বড় দৃষ্টান্ত।

  • মো. মইনুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
  • Courtesy: Jugantor/03-03-18


No comments:

Post a Comment