মিজানুর রহমান খান
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারীকে পরিচয় না দিয়ে গ্রেপ্তারের ঘটনা থেকে মনে হয়, আমাদের শাসকেরা যেন কোনোভাবেই মানতে রাজি নন যে গ্রেপ্তার মানবিক হতে পারে। ডিবি নামটির মধ্যে এককালে একটা পরিশীলিত ও সৌম্য ভাবমূর্তির বিষয় ছিল। কিন্তু তারাও ধীরে ধীরে পোশাকি বাহিনীর মতো অহেতুক উগ্রতা দেখাতে চাইছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের মতো একটি স্থান থেকে একজন রাজনৈতিক কর্মীকে যেভাবে অস্ত্র উঁচিয়ে গ্রেপ্তার করা হলো, যেখানে স্বীকৃতমতে তারা কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধের’ আশঙ্কা করেনি, সেটা নজিরবিহীন।
ওই গ্রেপ্তারের ঘটনায় বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্টের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক ঐতিহাসিক রায়ে দেওয়া দিকনির্দেশনার লঙ্ঘন ঘটেছে। রায়ে বলা আছে, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো কর্মকর্তা তাঁর পরিচয় প্রকাশ করবেন এবং যদি দাবি করা হয়, তাহলে গ্রেপ্তার ব্যক্তি বা গ্রেপ্তারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে তিনি তাঁর পরিচয়পত্র প্রদর্শন করবেন।’
গত মঙ্গলবার ডিবির প্রেসক্লাব অভিযানে পরিচয়পত্র দূরে থাক, উপস্থিত সাংবাদিকেরা আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে বসেছিলেন, এই অস্ত্রধারীরা কারা? নাশকতাকারী ভেবে অনেকে চিৎকার শুরু করলে তাঁরা বলেছেন ‘আমরা পুলিশ’। পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন, ‘অপ্রীতিকর অবস্থা এড়াতে মানুষকে অবশ্যই অস্ত্রধারীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত করাতে হবে।’ একটি ডিবি টিম একজন ফেরার আসামিকে গ্রেপ্তারে কেন অনাবশ্যক শক্তি প্রদর্শন করল, সে বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন ও বিস্ময় দেখা দিলেও তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এই নিবন্ধকারের কাছে বারীর স্ত্রীর দাবি, তাঁর স্বামী ৯০টির বেশি ‘রাজনৈতিক’ মামলার আসামি, দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। পুলিশ এত দিন যাঁকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলো, তাঁকে এবার প্রেসক্লাবে পেয়ে এভাবে শোরগোল ফেলে ধরার দরকার পড়ল কেন?
ওই গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইনের বহুবিধ লঙ্ঘন ঘটেছে। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ডিবি সদস্যদের হাতে শামীম রেজা রুবেল হত্যাকাণ্ড ঝড় তুলেছিল। তখন আওয়ামী লীগ সরকার বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন করেছিল। সেই কমিশনের আলোকেই দুই বছর আগে আপিল বিভাগ গ্রেপ্তার ও রিমান্ড সম্পর্কে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
প্রেসক্লাব থেকে সাদাপোশাকে ডিবির অভিযান সেই বিচার বিভাগীয় কমিশনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেবে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান কমিশনের সুপারিশের অনেকটা বাস্তবায়ন করেছিল আওয়ামী লীগ। খান কমিশন তার সুপারিশে বলেছিল, গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে কী কারণে এবং কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পুলিশ তা নিয়ে লুকোচুরির আশ্রয় নেবে না। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে তা জানাতে হবে অথবা তাঁর মনোনীত আইনজীবীকে সংবাদ দেবে। ব্লাস্টের মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বরাতে ২০০৩ সালে হাইকোর্টের গাইডলাইনে বলা ছিল, গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। বারীকে গ্রেপ্তারের ১১ ঘণ্টা পরে বারীর স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশের তরফে কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেননি। ফোনে তিনি পুলিশ কর্মকর্তা মি. দীপককে পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জানাননি ঠিক কোন মামলায় তাঁকে ধরা হয়েছে।
খান কমিশন এটাও বলেছিল, ‘যদিও ধৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটবর্তী হাকিমের কাছে পাঠানোর বিধান আছে, তবু স্থান-কালভেদে অধিক সময় থানাহাজতে রাখার প্রয়োজন না থাকলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’ দুপুর ১২টার দিকে ধরার পরে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করার কোনো চেষ্টা ছিল বলে জানা যায়নি।
ব্লাস্ট মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২৪ মে ২০১৬ তারিখে দেওয়া রায়ে বলেছিলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ যখন কেবল অত্যন্ত দরকারি হয়ে পড়বে এবং তাদের কর্তব্য পালনে প্রয়োজনের সীমা পর্যন্ত তারা শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।’
প্রেসক্লাবের ঘটনা থেকে প্রতীয়মান, সরকার বা পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে উদাসীন, এটা সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে অবহিত করানো দরকার। এতে বলা আছে, ‘কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো ধরনের উসকানি কিংবা কোনো ধরনের নির্যাতন বা বেদনাদায়ক কিছু হতে দেওয়া সহ্য করবে না কিংবা অন্য কোনো প্রকারের নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি কিংবা কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উচ্চতর আদেশ প্রয়োগ করবে না কিংবা একটি যুদ্ধ বা একটি যুদ্ধের হুমকি, জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অন্য কোনো জরুরি অবস্থার (পাবলিক ইমার্জেন্সি) মতো ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিকে নির্যাতন কিংবা অন্যান্য নিষ্ঠুরতা, অমানবিক কিংবা অবমাননাকর আচরণ কিংবা শাস্তিদানের যৌক্তিকতা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।’
১৯৯৮ সালে খান কমিশনের নির্দেশনা শুধরে ২০১৬ সালের রায়ে যা লেখা হয়েছিল, তার বিচ্যুতি প্রমাণিত বলা যায়। কারণ এতে বলা আছে, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য কর্মকর্তা কাউকে গ্রেপ্তার করার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিন্তু অনধিক ১২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান, সময় এবং অন্তরীণ রাখার স্থান সম্পর্কে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়কে এবং তেমন আত্মীয়ের অনুপস্থিতিতে গ্রেপ্তার ব্যক্তির সুপারিশমতে তাঁর কোনো বন্ধুকে অবহিত করবেন।’ এমনকি এ কথাও বলা আছে, ‘বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হলে তাঁর নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। শফিউল বারীকে গ্রেপ্তারের পর এটা তামিল হয়নি। ডিবির ওই টিম এটা জানত কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। তবে না জানাটা দাবি করা হবে দোষণীয়।
বারীর স্ত্রী বলেছেন, তাঁকে বা তাঁদের আইনজীবীদের বারীর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। অথচ সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁর পছন্দ অনুযায়ী একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের কিংবা তাঁর কোনো নিকটাত্মীয়র সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করবেন।’
সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে যথাবিহিত ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। নির্বাচনী বছরটিতে মনে হচ্ছে ওই নির্দেশনা পালন করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙাতে পুনরায় বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ দরকার পড়বে।
- Courtesy: Prothom Alo Mar 10, 2018
No comments:
Post a Comment