গোলাম মোর্তোজা
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল প্রিয় শিক্ষক- লেখক। তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। তার উপর হামলার আশঙ্কা অনেক বছর ধরেই ছিল। পুলিশি নিরাপত্তাও তাকে দেয়া হয়েছিল। সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকা অবস্থাতেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়েছে। যে, হামলা জঙ্গিরাই করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনিও বলেছে, ফয়জুর জঙ্গি মতাদর্শ ধারন করেই হামলা করেছে। ’জাফর ইকবাল নাস্তিক, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লেখেন’- সেকারণেই তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে ফয়জুর। র্যাবের তথ্য তেমনই বলছে।
জঙ্গি বিষয়টি আবার আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। আজকের লেখায় সে বিষয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব।
১. এদেশে অনলাইনে যারা লেখেন, তাদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করা শুরু হয়েছিল।এসব লেখকদের কেউ কেউ আপত্তিকর অনেক কিছু লিখেছেন। আপত্তিকর শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেই নয়, যে কোনো বিবেচনাতেই আপত্তিকর।সে সব দেখে কিছু মানুষ ক্ষুদ্ধ হতেই পারেন, হত্যা করতে পারেন না।
তবে অনলাইনের লেখকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, কাউকে অসম্মান বা আপত্তিকর কিছু লেখেন নি। অদ্ভূত ব্যাপার হলো, অনলাইনে যারা লেখেন তাদের প্রায় সবাইকে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং প্রচারণা চালানো হয়েছে। কাজটি সামনে থেকে করেছে হেফাজতে ইসলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে হেফাজতের তীব্র বৈরি সম্পর্ক।২০১৩ সালের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের সমাবেশ প্রতিহতের মধ্য দিয়ে যা চুড়ান্ত রূপ নেয়।
তারপর থেকে সরকার কৌশল পরিবর্তন করে। হেফাজতকে সুযোগ- সুবিধা দিয়ে, বিএনপি- জামায়াতের কাছ থেকে ভাগিয়ে নেয়ার নীতি নেয়।চট্রগ্রামে রেলের জমিসহ অনেক কিছু হেফাজতকে দেয়া হয়।সরকারের সঙ্গে মিত্রতা তৈরি হতে থাকে সরকারের। এই সময় হেফাজত অনলাইন লেখকদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে আন্দোলন করতে থাকে। হেফাজতের প্রচারণা অনুযায়ী যারা ‘নাস্তিক’ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। সরকারকে ৮০ জনের একটি তালিকা দেয় হেফাজত। সেই তালিকার থেকে তাৎক্ষনিকভাবে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে সরকার। এর ফলে সরকার ভেতরে- বাইরে থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে।ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ আরও দু’একটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা হেফাজত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বসে ৮০ জন থেকে তালিকা ৩৫ জনে নামিয়ে আনে।বেশ কয়েকজন অনলাইন লেখক তখন রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বিদেশে চলে যায়। তালিকা চুড়ান্ত করলেও, হেফাজতের চাহিদা অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেয়া অব্যাহত রাখে না।
তারপর প্রায় নিয়ম করে অনলাইন লেখক বা ব্লগারদের চাপাতি দিয়ে কূপিয়ে হত্যা করা শুরু হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া প্রায় সবার নাম তালিকায় ছিল।আরও পরিস্কার করে বললে, তালিকা অনুযায়ী হত্যাকান্ড চলতে থাকে।
রাজিব হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানানোর জন্যে তার বাসায়ও গিয়েছিলেন। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী। মূলত তার কিছুদিন পর থেকেই সরকারের অবস্থান পুরোপুরি বদলে যায়।
হত্যাকান্ডের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন:‘...আর এই লেখার জন্য কোনও অঘটন ঘটলে দোষ সরকারের ওপর আসবে কেন? সবাইকে সংযমতা নিয়ে চলতে হবে। সবাইকে একটা শালীনতা বজায় রেখে চলতে হবে। অসভ্যতা কেউ করবেন না। অসভ্য আচরণ করলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আমরা নেব না।’ -শেখ হাসিনা, ১৪ এপ্রিল ২০১৬ হত্যাকান্ডের শিকার হন দীপন- অভিজিৎরা। তদন্ত বিচার কোনো কিছুই গতি পায় না।
২. জাফর ইকবালের উপর আক্রমণকারীদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সাগর-রুনি, দীপন-অভিজিৎদের ক্ষেত্রেও এমন নির্দেশ এসেছিল। ‘নির্দেশ বাবু’র কি অবস্থা, তা তো কারও অজানা নয়।
তদন্তের আগেই প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, ‘হামলাকারী কারা হামলার ধরন থেকেই স্পষ্ট’। পুলিশি তদন্তের আগেই সাম্প্রতিক অতিকথক ওবায়দুল কাদের ৪ মার্চ বলে দিয়েছেন, ‘হামলাকারীর স্বীকারোক্তি শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি...। এই হামলা চক্রান্ত, এটা সত্য। চক্রান্ত তাদের, যাদের বিএনপি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।’
উপরে যে ঘটনাক্রম উল্লেখ করেছি তা থেকে তো ‘হামলাকারী কারা হামলার ধরন থেকেই স্পষ্ট’- হওয়ারই কথা!
ওবায়দুল কাদের যে বিএনপিকে দায়ী করলেন, তার ভিত্তিটা কী? ঘটনাক্রম তা বলে না, তদন্তও হয়নি। তাহলে কি কাউকে বাঁচানো, কাউকে ফাঁসানোর উদ্দেশেই তদন্তের আগে এমন মন্তব্য ?
৩. অনলাইন লেখক- প্রকাশক হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে নাস্তিকদের পক্ষ নেয়া হয়, সরকারের এমন পরিচিতি তৈরি হয়ে যায় কিনা, ভয়ে ছিল সরকার। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কারও কারও বক্তব্যে তার প্রকাশও ঘটে।
সরকার এখনও সেই ভয়েই আছে। ফলে হত্যাকান্ডগুলোর তদন্ত হয়নি। সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। কিন্তু ধর্ম অবমাননা করে জাফর ইকবাল তো তেমন কিছু জীবনে কখনো কোনোদিন লেখেননি। কিছু লেখেন নি প্রকাশক দীপনও। দীপন খুন হয়েছেন, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল অল্পের জন্যে বেঁচে গেছেন।
পূর্বের হত্যাকান্ডগুলোর সঙ্গে জাফর ইকবাল হত্যা প্রচেষ্টা মিলিয়ে দেখলে, কিছু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।
ক. পূর্বের হত্যাকান্ডগুলোতে যে ধরনের চাপাতি ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে, জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে একই রকম চাপাতি ব্যবহৃত হয় নি। যতদূর জানা গেছে তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের চাকু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে জাফর ইকবালকে।
খ. পূর্বের সব আক্রমণকারীরা ছিল হত্যাকান্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ।ঘাড়ের কোন স্থানে এক কোপে হত্যা করা যাবে, সে বিষয়ে আক্রমণকারীরা ছিল পারদর্শী বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
গ. ফয়জুরের চাকু এবং কোপ দেয়ার ধরন দেখে তাকে দক্ষ- পারদর্শী বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনে হয় নি।
ঘ. ফয়জুর যত কাছে থেকে সময় নিয়ে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছে, সে দক্ষ হলে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
৪. জাফর ইকবালের উপর আক্রমণ জঙ্গিরাই করেছে, সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সঠিক তদন্ত অপরিহার্য।’সঠিক তদন্ত’ বিষয়টির সবচেয়ে বড় অনুপস্থিতি এদেশে।
নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তিন জন পুলিশ, জাফর ইকবালকে অরক্ষিত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিন জনের দুই জন আবার স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মঞ্চে ঠিক জাফর ইকবালের পেছনে অবস্থান নেয়া ঘাতক যখন আক্রমণ করেছে, পুলিশ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘নিরাপত্তায় ত্রুটি ছিল না’। জাফর ইকবালের পরিবারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ইয়াসমিন হকও বলেছেন ‘পুলিশের কিছু করার ছিল না’। আবার স্মার্ট ফোনে ব্যস্ত থাকা দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
জাফর ইকবাল বিশেষ মানুষ, বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছেন।ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে ঢাকায় আনা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী নিজে পুরো বিষয়টি তদারক করেছেন। প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিকভাবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে দেশের বাইরেও পাঠানো হতো। একারণেই সম্ভবত অধ্যাপক ইয়াসমিন হক কোথাও কোনো ‘ত্রুটি’ দেখছেন না, কোনো অভিযোগও করছেন না। তাছাড়া সৌভাগ্যবশত জাফর ইকবাল বেঁচে আছেন। ফলে দোষ- ত্রুটি বা অভিযোগের দিকে যান নি তিনি।
বিষয়টি আসলে অভিযোগের নয়। সত্য বিষয়গুলো সামনে আনা জরুরি, ভুল বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যে।
জাফর ইকবাল যে গুরুত্ব পেয়েছেন, সাধারণ একজন আক্রান্ত হলে সেই গুরুত্ব পেতেন না, পাবেন না। বিশেষ হেলিকপ্টার, বিশেষ তদারকি- কোনো কিছুই পাবেন না। আঘাত গুরুতর না হলেও, শুধু রক্তক্ষরণেই তিনি মারা যাবেন।অধ্যাপক ইয়াসমিন হকের থেকে বক্তব্য ব্যক্তিকেন্দ্রীক না হয়ে সামগ্রিক হলে, অন্যদের জন্যে উপকারের হতে পারত। পুলিশি নিরাপত্তার দূর্বলতা, ব্যর্থতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্যেই সত্যটা সামনে আনা প্রয়োজন ছিল, সরকারকে অভিযুক্ত করার জন্যে নয়।
৫.আক্রমণকারী ফয়জুরের মামা কৃষক লীগ নেতা, সেকারণে দায় আওয়ামীলীগ বা কৃষক লীগের- বিষয়টি এত সরলিকরণ করা ঠিক নয়। বিএনপির উপর দায় চাপিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা- মন্ত্রীদের দেয়া বক্তব্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।সরকারে যারা থাকে, দায় মূলত তাদের। একথা মনে রাখা দরকার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের।’সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করছি বা হচ্ছে’- যত জোর দিয়েই এসব কথা বলা হোক না কেন, মানুষ তা বিশ্বাস করছে না। সত্যটা মানুষের অজানা থাকছে না। সব কিছু দেখেই মানুষের পারসেপশন তৈরি হচ্ছে ‘হত্যাকান্ডগুলোর বিচার করা হচ্ছে না, চাপা দিয়ে দেয়া হচ্ছে’।
মানুষের এই পারসেপশন দূর করার দায়িত্ব সরকারের। তা করতে হবে কাজ দিয়ে, গল্প বলে এই পারসেপশন দূর করা যাবে না। সরকার বা আওয়ামী লীগ এখন ভাবতেই পারে, এসব পারসেপশন ধারন করা নাগরিকদের গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। এমন মানসিকতা ধারন করে থাকলে, এখন না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে অনেক বড়ভাবে মূল্য দিতে হবে আওয়ালী লীগকে। এই হত্যাকান্ডের সময়কাল ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না, দায় আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে।
- গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
No comments:
Post a Comment