এ হোসেইন
ঘটনা নয় , অতি মর্মান্তিক , হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। সোনারগাঁয়ের অদূরে, ত্রিবর্দিতে। ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কে। ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে। শিশু ও নারীসহ ১০জন প্রাণ হারায় এই দুর্ঘটনায় নিতান্তই বেঘোরে। সিডিএম পরিবহণের লোকাল যাত্রীবাহী বাসের চালক মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত রেখে বাস চালাচ্ছিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে আজদাঁহা ট্রেলারে গিয়ে ধাক্কা লাগালে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল ১০ জনের , জখম হলো আরও ১০ জন।
এটি সাম্প্রতিককালের অন্যতম মর্মান্তিক — সড়ক দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, শুধুমাত্র ২০১৭ সালে প্রায় ৫হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যাতে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আরো প্রায় ১৬ হাজার মানুষ হারিয়েছে হাত-পা অথবা শরীরের মূল্যবান কোন অংগ। ২০১৭ সালে সড়ক দূর্ঘটনা বেড়েছে ১৫.৫ শতাংশ (তথ্য-যুগান্তর/ জানুয়ারি ১৩, ২০১৮।
ওয়াকিবহাল মহল নিশ্চয় একমত হবেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। কেননা, এইসব জরিপ সাধারণত জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রতিদিন সড়কে দুর্ঘটনা হচ্ছে, যার অনেকগুলোর খবর জাতীয় পত্রিকায় পৌঁছায় না। এইভাবে, বছরের পর বছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, নয়ত সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হচ্ছে। এই ধরণের হাজারো পরিবারের লাখো সদস্যের জন্য তা হয়ে আসে সারা জীবনের কান্না আর অসহায়ত্ব। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিই হয়তো মারা যাচ্ছে অথবা পরিবারের একটি সদস্য পুঙ্গু হয়ে পরিবারের বোঝা হচ্ছে। কখনো কখনো চরম অবহেলায় সড়কেই চোখের নিমেষে প্রাণ হারায় অমিত সম্ভাবনাময় মানুষ।
সড়কে এই দুর্ঘটনার পিছনে প্রথমত রয়েছে চালকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। তারা একটু সতর্ক হলেই কমে যেতে পারে এই ধরণের দুর্ঘটনা।
চালকদের পুরনো রোগ অতিব্যস্ততা। গাড়ি চালানোর কথা ঠাণ্ডা মাথায় কেননা তিনি অনেকগুলি প্রাণের দায়িত্ব নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ গলদঘর্ম হয়েছে বলতে গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলতে। চালক সেই নিষিদ্ধ কাজটিই জেনে শুনে করেছে। চালকরা তাদের সপক্ষে বলেন তারা তো ইচ্ছ করে জীবহত্যা করেন না। দুর্ঘটনা হয় অনিচ্ছায় । মালিকরাও তাদের পক্ষে গীত গান।
এই গান তারা গাইতেই থাকবেন। কেননা তাদের স্বার্থ আছে। তাছাড়া চালকরাও তো ছাপোষা মানুষ। তাদেরও বৌ-বাচ্চা আছে। সব ঠিক। তবে কোথায় যেনো বেসুরো সুর। শাহবাগের মোড়ে দুই এক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় এক ছাত্রী নিহত হয়। তোলপাড় সেই ঘটনায পুলিশের তৎপরতায ধরা পড়ে কিশোর বয়সী এক ড্রাইভার। তার বেশ মোটা সাজা দেওয়া হয়। সে ইচ্ছে করে চাপা দেয়নি। গরিব ঘরের ছেলে। পত্রিকার পাতায় তার ছবি দেখে খুবই খারাপ লেগেছিল। কেননা সে ঐ বয়সে লাইসেন্স পেল কি করে?
এক মোটর দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালক পালিয়ে যায়। বাসটি থানায় নিয়ে যাওয়া হলে মালিক এক হাজি সাহেব এসে হাজির। গাড়ি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছিল এক সাংবাদিকের। সে কি কাকুতিমিনতি! বলে স্যার আমার মাত্র কোনো রকম ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হয়। ক্ষতিপূরণ ধরলে সেটা দিতে সে অক্ষম। তাকে বলা হলো ড্রাইভার তো পালিয়ে গেছে। তার লাইসেন্স তো নেই। এমন লোককে নিয়োগ দিয়েছেন কেন? সে সবিনয়ে জানালো জেনে শুনেই সে এমন ড্রাইভার রেখেছে কেননা সবই দু’নম্বর। তাদের দাবি তাই কম। লাইসেন্স নেই বলেই সে ঘুরে ফিরে সে তার কাছেই আসবে। এর সাথে পুলিশ এএসআইকে দেখা গেল, বড়োই ভালো মানুষ! সুপারিশ করছে ছাইড়্যা দেন স্যার গরিব মানুষ। জানি ড্রাইভার, ড্রাইভার নয়, বাসের মালিক। সে বেতন পায় না। পুলিশটি যে মনুষত্বের বিবেচনায় বলছে সে কথা আদৌ সত্যি নয়। কথা হলো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তবে গরিব হিসেবে সে দেবে প্রকৃত ক্ষতির পাঁচভাগের একভাগ। পাঁচ হাজার টাকা। বুঝলেন সাংবাদিক, পুলিশ বাসের মালিকের কাছে টুপাইস কামাবে। আর তাদের সহায়তায়ই ঐ ড্রাইভার সাহেবও গাড়ি লাইসেন্স ছাড়াই বাস চালাতে পারবে। তবে মালিক বৃদ্ধ হাজির পায়ে পড়া অনুরোধে তাকে ছেড়ে দিলেন সাংবাদিক। তাতে কার লাভ হলো? পুলিশের, চালকের আর মালিকের। আর ক্ষতিগ্রস্তের ? এহ বাহ্য!
পুলিশ, হাজি আর চালকের কথা বললাম। চালকের যে শাহবাগের ঘটনায় জেলফাঁস হলো তার জন্য মূলত দায়ী মালিক। কিন্তু সে পার পেয়ে গেল। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়। পরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খান নিজ সুপারিশে ১০ হাজার ড্রাইভার প্রার্থীকে লাইসেন্স দিয়েছিলেন। মোটর ভেহিকলস আইনের সব রীতিনীতি ভেঙে এসব অযোগ্যদের চাকরি দিয়ে বলেছিলেন, আরে ওদের অতো লেখাপড়ার কী দরকার। রাস্তায় গরু-ছাগল দেখে গাড়ি চালাতে পারলেই তো হলো। মূলত এই মন্ত্রী মহোদয়ই যানবাহনের সমস্যার নাটের শুরু। তিনি রাস্তায় যখন গাড়ি চলে তখনকার মতো ড্রাইভার-কন্ডাকটর ও হেলপারদের গাড়ির মালিক করে দিয়েছেন। কেননা গাড়ি চালানোর জন্য চুক্তিমাফিক নগদ টাকা শোধ করে তবে ‘মালিকের’ গাড়ি রাস্তায় তোলে যানবাহন শ্রমিক তথা মজলুম ড্রাইভার কন্ডাকটর ও হেলপার ভাইয়েরা। তখন মালিক বনে যায় শ্রমিকেরা । তারা যা ইচ্ছে ভাড়া তোলে । তাদেরকে মালিকরা সে লাইসেন্স দেয়। তবে হ্যাঁ, শ্রমিকদের গাড়ির টায়ার তেল-মবিল পুলিশ সবই ম্যানেজ করতে হয়। আর নির্দিষ্ট টাকা নিয়ে সুদখোর মহাজনেরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অন্য ব্যবসায় মজে থাকেন। আর সেখান থেকেই মজা লোটার মদদ পান ‘বড়াকর্তারা।” এক ঢিলে কয়েক পাখি মেরেছেন খান সাহেব। গোটা দুনিয়াতে যে অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছেন শাজাহান খান সেটা হলো মালিক-শ্রমিককে এক কাতারে ফেলা। মালিক-‘শ্রমিক’ মজা লুঠছে জনসাধারণের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে। সরকার থাকছে নিরাপদে আর তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে বাড়তি ফায়দা লূটে। আর সরকারের শাসনে অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে হরতাল ডেকে সে হরতাল পূর্ণ সফলও করছে। কাজেই চালকদের আর বেশি লেখাপড়ায় কী কাজ , ওরা তামুক সাজুক - এই যেন একটা ভাব। আমরা মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য চিত্র পরিচালকের মিডিয়া ট্রায়ালের কথা বলতে পারি। সেখানে যথা অপরাধীর যথাশাস্তি হয়নি।
আর তাই যা হবার তা হবেই । বেঘোরে মারা পড়বে নারীপুরষ-বৃদ্ধ আবাল বণিতা। আর টাকা এমন জিনিষ মন্ত্রীরও আত্মীয় স্বজন যদি মারাও যায় দুর্ঘটনায় তিনি রাহেলিল্লাই পড়ে ফেলবেন অবলীলায় নগদনারায়নের ডরে।
বর্তমানে যে হারে রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে তার দায়ভার বর্তমান দায়ভারহীন জনকল্যাণে নির্লিপ্ত ভোটারবিহীন অনৈতিক সরকার।
No comments:
Post a Comment