খুলনা সিটি নির্বাচন
খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যে পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি, সেটি বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও ছবিতেই অনেকটা পরিষ্কার। নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় ছিল। তবে ঘটনাগুলো যেভাবে ঘটেছে, তা খুলনাবাসীকে মোটেই অবাক করেনি। সুতরাং ভোটকেন্দ্রগুলোর বাইরের পরিবেশ দৃশ্যত শান্ত থাকা আর ভেতর-বাইরের সবটাই সরকারি দলের কবজায় থাকার মতো একটি পরিবেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন যে সম্ভব নয়, তা সহজপাঠের মতো বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি। এটা অশনিসংকেত।
গাজীপুরসহ চারটি সিটি নির্বাচন ঘিরে এখন যে প্রশ্নটি জ্বলে উঠবে, তা হলো খুলনায় যে নির্বাচন হলো, সেসব স্থানেও আওয়ামী লীগ ও ইসির মতে ‘চমৎকার ও সুন্দর নির্বাচন’ হলে, এই রকম সিটি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে কি হবে না? আমরা সহজে যা বুঝি তা হলো জনসাধারণকে ফাঁকি দেওয়া কিংবা সত্য আড়াল করা যায় না। খুলনায় নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের পক্ষপাত এবং বিরোধী দলের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রাক্-নির্বাচনী পর্বের কিছু ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভোটের দিনের যে বিবরণ আমরা পেয়েছি, তা কার্যত প্রাক্-নির্বাচনী পর্বেরই ধারাবাহিকতা।
তবে নির্বাচন কমিশনের মুখপাত্রের ‘দু-একটি বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা দর্শন করা নিশ্চয় খুলনাবাসীকে মর্মাহত করবে। কারণ, তারা দেখেছে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইসি ও আওয়ামী লীগ অস্বীকার করতে পারবে না যে বিএনপির ‘পরাজিত’ প্রার্থী এক লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন। যে প্রার্থী এতটা বিপুল পরিমাণ ভোট পেতে পারেন, তাঁর পোলিং এজেন্ট দিতে লোকবলের অভাব পড়েছিল, সেটা বিশ্বাস করানো কঠিন। প্রথম আলোর অন্তত পাঁচজন সাংবাদিকের সরেজমিন পরিদর্শন করা ৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে তাঁরা ৬০টি কেন্দ্রে কোনো পোলিং এজেন্ট দেখেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তাঁর দলীয় প্রার্থীর মেয়র হওয়ার খবর শুনে স্মরণ করেছেন যে খুলনার এই এলাকাটিতে আওয়ামী লীগ আগে কখনো এত ভালো করেনি।
নির্বাচন কমিশনকে নির্মোহ থাকতে হবে। ঢাকায় বিএনপির ফল প্রত্যাখ্যান ও সিইসির পদত্যাগ দাবি রাজনৈতিক। কিন্তু বিএনপি প্রার্থীর ১০৫ কেন্দ্রে ভোট ডাকাতির অভিযোগ এবং ৪৫ কেন্দ্রে পুনঃ তদন্তের দাবি আইনগত বিষয়। বিএনপি যদি সত্যি সত্যি প্রতিকার চায় তাহলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে আসতে হবে। এটাও লক্ষণীয় যে বিএনপি ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হওয়ার কথা বলছে না। ‘পরাজিতরা’ কখনো যে আইনি লড়াইয়ে যেতে চায় না, সেই পরিস্থিতি ইসির জন্য অবমাননাকর। আর তা নির্বাচনী আইন সংস্কারের অপরিহার্যতাকেই নির্দেশ করে। আশা করব, বিএনপি মেঠো বক্তৃতার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালেও আসবে।
ইসিকে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের হম্বিতম্বি গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার জন্য সুখকর নয়। এই নির্বাচন সারা দেশের ভোটারদের মধ্যে একটা আস্থা তৈরির সুযোগ এনেছিল। কিন্তু তা হলো না। সিইসি ও কমিশনারদের নীরবতা হয়তো তাৎপর্যহীন নয়।
এসব সত্ত্বেও আমরা আশা করব, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা নির্বাচনী বিভেদ ভুলে সবাইকে নিয়ে খুলনাবাসীর উন্নয়নে কাজ করবেন। মেয়র পদে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই।
- Courtesy: Prothom Alo /সম্পাদকীয় /May 17, 2018
No comments:
Post a Comment