Search

Thursday, May 17, 2018

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট — আকাশে অশ্বডিম্ব প্রেরণ (পার্ট ২)


জিয়া হাসান 


দেশীয় অপারেটরদেরকে বিক্রি করে , মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কাকে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দিয়ে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা হবে মানে কি? লাঞ্চ হয়ে গেল, কিন্তু তার আগে ডিলগুলো ক্লোজ করা হয় নাই কেন ? এত সাধের ময়না, তবে কথা কেন কয় না? সোফিয়া তো কথা বলেছিল?

মিয়ানমার সরকার, ২০১৯ সালে একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাবে। নিউজ রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি মিয়ানমার ইতিমধ্যেই দুইটি কোম্পানির সাথে ক্যাপাসিটি বুক করে ফেলেছে, সেল করার জন্যে। 

পাকিস্তান ২০১১ সালে পাকস্যাট 1R লাঞ্ছ করে। লাঞ্চিং-এর  আগেই তাদের ৬০% ট্রান্সন্ডার ক্যাপাসিটি বুক করা ছিল। 

কিন্ত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট লাঞ্চ হয়েছে, ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ । ১৫ বছরে এটার জীবন শেষ। তার মানে, প্রতি দিন এর পেছনে ৩০০০ কোটি ভাগ ১৫ বছর মানে, ৫৪৭৫ দিন = ৫৫ লক্ষ টাকার ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন তুলে আনতে হবে শুধুমাত্র ফিক্সড কস্ট কাভার করার জন্যে। অপারেশনাল কস্ট এবং সুদ বাদ দিলাম।

কিন্ত, সরকারের সহযোগী ৭১ টিভি মিডিয়ার মালিক মোজাম্মেল বাবু ২৪ এপ্রিলে একটি আলোচনা সভায় বলেছেন, "বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যে অরবিটাল স্লটে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) স্থাপন করা হবে, তার মাধ্যমে কাজ করা বাংলাদেশের টেলিভিশনগুলোর জন্য হবে একটি চ্যালেঞ্জ। "

সে দিনের মিটিং এ উপস্থিত আমার একজন সাংবাদিক বন্ধু জানিয়েছেন স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মালিকেরা ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১১৯.১ ডিগ্রিতে হওয়াতে এইটার থেকে কিউ ব্যান্ড কানেক্টিভিটি নিয়ে তারা কাজ করতে পারবেন না , কারণ তাতে বৃষ্টির কারণে ট্রান্সমিশন বিঘ্নিত হবে ।

“বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২৬টি রাখছেন কিউ-ব্যান্ডে। এ ব্যান্ডে টেলিভিশন চালাতে পারি না, এক ফোঁটা বৃষ্টি হলেও ফ্রিকোয়েন্সি কাজ করে না। ১৪টি সি-ব্যান্ডের জন্য আমরা আগ্রহী।”- মোজাম্মেল বাবু,, একাত্তর টিভি।

তারা বলেছেন,তাদের জন্যে বর্তমানের ৯০ ডিগ্রি বা ৮৯ ডিগ্রিতে স্থাপিত সিঙ্গাপুর বা চীনের কমার্শিয়াল স্যাটেলাইট গুলোই ভালো কারণ এগুলো যে কৌণিক অবস্থানে  আছে তাতে ভালো ট্রান্সমিশন পাওয়া যাবে, যেটা বন্ধু স্যাটেলাইটে পাওয়া যাবেনা।  সিঙ্গাপুর/চীনের স্যাটেলাইটের  অ্যাঙ্গেল বাংলাদেশের জন্যে সুবিধাজনক।

বলে রাখা ভালো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো আকাশে একটা ফিক্সড জায়গায় থাকে এবং এটা পৃথিবীর সাথে একই গতিতে ঘোরে। ফলে এই স্যাটেলাইটের অরবিটাল স্লট কেনার সময়ে সুবিধাজনক জায়গায় কেনা জরুর‌ি যেটা বাংলাদেশ কিনতে পারে নাই কারণ,  ২০১২ সালে বাংলাদেশে যে অরবিটাল স্লট কেনার জন্যে অঅবেদন করেছিল, সেই স্লট পায় নাই। ২০টি দেশ বাংলাদেশের অরবিটাল স্লট কেনার বিরোধিতা করেছিল। ফলে বাংলাদেশ ফাইনালি রাশিয়ান স্পুটনিক কোম্পানি থেকে অসুবিধাজনক স্লট ভাড়া নেয়- সরকারের ইগো প্রজেক্ট কমপ্লিট করার জন্যে ।


একই মিটিং এ মোজাম্মেল বাবু  বলেছেন তারা সি ব্যান্ড ব্যবহার করতে পারেন. কিন্ত বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সি ব্যান্ডে এনক্রিপশান সুবিধা না থাকাসহ অনেক অসুবিধা আছে।  তাহলে তাদের প্রযুক্তি চেঞ্জ করতে হবে। তাই হয়তো এটা চ্যানেল মালিকদের কথার কথা। 
কারণ তারা কিউ ব্যান্ডে সুবিধাজনক ট্রান্সমিশানের জায়গায় থাকতে চায়, যার অপশন বর্তমানে তারা সিঙ্গাপুর বা চাইনিজ কোম্পানিগুলো থেকে পাচ্ছেন। এইটা তারা সেই দিনের মিটিং এ বার বার বলেছেন। লিংক  যদি একাত্তর টিভি বা বাকিরা একজিস্টিং কন্ট্রাক্ট থেকে বের হয়ে প্রযুক্তি চেঞ্জ করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে রাজিও থাকে, তার মানে এখনো আলোচনা চলছে। এবং এর থেকে বোঝা যায় সরকার এখনও তাদের পেট মিডিয়া একাত্তর টিভিকেও তার ট্রান্সপন্ডার সেল করতে পারে নাই এবং এগ্রিমেন্ট কমপ্লিট করে নাই। ধোঁয়া ধোঁয়া আলাপ চলছে।

বিদেশী নেটওয়ার্ক এই ডাটা কিনবে সেই প্রশ্ন তো অনেক দুরের চাঁদ অার দেশী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর কাছেই ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নেবার বিষয়টা জাস্ট একটা উইশফুল থিঙ্কিং।

তাহলে কিসের ভিত্তিতে মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের মিডিয়া গুলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে ডাউনস্ট্রিম ব্যান্ডউইথ কিনবেই, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে ?

যদি আজকে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কগুলো বলে, তাদের অন্য কোম্পানির সাথে কনট্র্যাক্ট আছে, তাই, তারা কিনতে পারবে না। বা কিনতে হলে, সেই কন্ট্রাক্টের দায় বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তখন কি হবে ?

তাছাড়া এখানে কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল কার জন্যে সুবিধাজনক সে ধরনের অনেক ইস্যু আছে, যা নিয়ে কোন অভিজ্ঞতা নেই সরকারের ।

আমাদের প্রশ্ন, এই স্যাটালাইট উৎক্ষেপণের আগে এই কন্ট্রাক্ট গুলো শেষ করে ফেলা হয়নি কেন ? 

কে করবে এই সব কন্ট্রাক্ট ? সেখানে দুর্নীতির দায় কে নেবে ?

দ্বিতীয়ত ভারত যেখানে ফ্রি, ট্রান্সপন্ডার সার্ভিস দিয়ে বসে আছে, সাউথ এশিয়ান স্যাটেলাইটে, যে সার্ভিসটা নিতে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে চুক্তি সাক্ষর করেছে এবং শ্রীলঙ্কা নেপালের জন্যেও যে ফ্রি সার্ভিস নেয়ার দরজা খোলা রেখেছে , সেটা জানা সত্ত্বেও তাহলে কিসের ভিত্তিতে শ্রীলঙ্কা, নেপাল বাংলাদেশ থেকে পয়সা দিয়ে ট্রান্সপন্ডার সার্ভিস কিনবে?

ভারতের ফ্রি স্যাটালাইট সার্ভিস নিতে বাংলাদেশ চুক্তি সাক্ষর করেছে (পড়ুন -  https://bit.ly/2ISMtbU)

তাছাড়া শ্রীলঙ্কার নিজের স্যাটেলাইট আছে। সে কেন কিনবে ?

এমনকি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জিওস্টেশনারি যে লোকেশান তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া পড়েছে, তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে।

এবং আগামী দুই তিন বছরে ভারত যদি এই রিজিয়নে আরো ফ্রি সার্ভিস দেয়, তখন কার কাছে এই ট্রাসপন্ডার সার্ভিস বেচা হবে ? সেই গুলো তখন অবিক্রিত থাকলে তার দায় কে নেবে ?

বেচার যদি সুযোগ থাকতোই তাহলে একটাও চুক্তি সাক্ষর বা নিদেন পক্ষে এমওইঊ সাইন না করে, এই ভাবে, আশাবাদের ভিত্তিতে, ৩ হাজার কোটি টাকা খরচের মানে কি ?

এখন যদি বেচতে না পারি, তার দায় কে নেবে।

প্লাস স্যাটেলাইট ইন্ডাস্ট্রিতে এশিয়াতে যে বড় বড় প্রাইভেট অপারেটর আছে, তদের প্রফিট ইতিমধ্যে কমে আসছে, কারণ অনেকগুলো স্যাটেলাইট লাঞ্চ হওয়াতে এই সারভিসের ওভার ক্যাপাসিটি শেষ হয়ে গ্যাছে। 

ওভার-ক্যাপাসিটির জন্যে এশিয়াস্যাটের প্রফিট কমে আসার লিংক। [https://www.satellitetoday.com/…/asiasat-revenues-flat-fir…/]

এবং এই ক্যাপাসিটি দিনে দিনে বাড়ছে, ফলে, দুইটা জিনিষ হবে, এই ট্রান্সপ্ন্ডার সারভিসের দাম কমবে। এবং আমরা সেল করতে পারলেও সরকার যে প্রফিটের কথা বলছে, সেটা হবে না। এবং প্রাইভেট অপারেটরদের সাথে আমাদের দুর্নীতিপরায়ণ অযোগ্য কর্মকর্তাদের দিয়ে, হয়তো দেশের আরো বড় বারোটা বাজানো হবে।

আরো প্রশ্ন আছে, প্রথমেই আমাদের ফিক্সড কস্ট অনেক বেশ‌ি হয়ে গেছে কিনা।

১২ টা কু ব্যান্ডের ,২.৫ টনের মোটামুটি একই পে-লোডের এই সাউথ এশিয়ান ফ্রি স্যাটেলাইট বানাতে ভারতের মোট খরচ হয়েছে , ৬৯ মিলিয়ন ডলার। 

আমাদের স্যাটেলাইট বানাতে থেলস এলায়ন্সের সাথে চুক্তির পরিমাণ, ২৩০ মিলিয়ন ডলার। প্রায় চার গুণ বেশি ? কেন ? (পড়ুন - https://en.wikipedia.org/wiki/South_Asia_Satellite) 

এই যে প্রতি দিন আগামীকাল থেকে, স্যাটেলাইটের ক্যাপাসিটি ফ্রি বসে থাকবে যার ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন তুলতে প্রতি দিন ৫৫ লক্ষ টাকা আয় করতে হবে, এবং যার জন্যে এইচএসবিসি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে যা সুদে আসলে বাড়তে থাকবে, তার দায় কি এই স্যাটেলাইটের সিদ্ধান্ত গ্রহীতা নেবে ? 

নাকি তার দায় আমরা করদাতারা  নেবো যার জন্যে আমাদের গ্যাস বিদ্যুৎ দুধ সব কিছুর খরচ বাড়বে ?

এই প্রশ্নের জবার কে দেবে?

রিয়ালিটি হচ্ছে আমরা আমরা হাততালি পাওয়ার জন্যে একটা স্যাটেলাইটের ক্যাপাসিটি আকাশে তুলে রাখছি,এবং বলছি, এ থেকে বছরে এতো কোটি টাকা পাওয়া যাবে। কিন্ত বেচা বিক্রির কাজ এখনো শুরুও তো হয় নাই।

অনেকে বলতেছেন,এতে ভাবমূর্তি বাড়বে। বাংলাদেশের নাগরিকেরা বিদেশে যখন এয়ারপোর্টে এয়ারপোর্টে দঁড়িয়ে থেকে, ইমিগ্রেশান ফর্ম পুরণ করতে পারে না, আশেপাশে শিক্ষিত বাঙালি খোঁজে  সেখানে কেউ তাদের জিজ্ঞেস করবে না, আমরা আকাশে স্যাটেলাইট তুলছি কিনা। 

শিক্ষাখাতকে ধ্বংস করে এখন আমরা ভাবমূর্তি বেচবো ।

বাস্তবতা হচ্ছে এটা বাংলাদেশ নয়, আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তির প্রজেক্ট। যেই ভাবমূর্তির ট্যাক্সের দায় এবং অর্থনৈতিক উশৃঙ্খলতার দায় আমাদেরকে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম বইতে হবে। এখুনি যার চাপে, নাগরিকের নাভিশ্বাস উঠেছে।

আর আমরা এমন বলদ জাতি নিজের ট্যাক্সের পয়সায় স্যাটালেইট দেখে উন্নয়ন চেতনায় জাম্প দিয়ে যাচ্ছি, কিন্ত কোন দিক থেকে এই চেতনার গ্লিসারিণ সাপোজিটারি ঢুকছে টের পাচ্ছিনা।

পড়ুন - বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট — আকাশে অশ্বডিম্ব প্রেরণ (পার্ট ১)

— লেখক সাড়া জাগানো ব্লগার ও তরুন উদ্দ্যোক্তা। 

No comments:

Post a Comment