২০১৮-র কোটা সংস্কার আন্দোলন, বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটাভিত্তিক নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন বা বিক্ষোভ। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীঘ চার দশকের বেশি চালু থাকা কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিক বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে আন্দোলনকারীরা।
বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। তবে নিয়ম অনুসারে এসব কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
এদিকে সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদসমূহে চাকরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরার জন্য সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যম ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি-এর মুখোমুখি হয়েছেন কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদ খান এবং নুরুল হক নুরু। যৌথ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ব্রেকিংনিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।
ব্রেকিংনিউজ: কোটা আন্দোলনের শুরুর কথা সম্পর্কে কিছু বলুন।
রাশেদ খান-নুরুল হক: কোটার মাধ্যমে চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন সময়ে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, তখনকার সময়ে সরকারের সাথে আলোচনাও করেছিল। কিন্তু এটা আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোটা নিয়ে এ পর্যন্ত তিনবার সরকারের পক্ষ থেকে তিনটা কমিশন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোটারই বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু মুখেই সংস্কারের কথা সীমাবদ্ধ ছিল। এ কারণে ধীরে ধীরে সবার মধ্যেই একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে সেজন আমাদের এই আন্দোলন। এর পরিপেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করি। কোটার কারণে যারা চাকরি পাচ্ছে না, পদগুলো ফাঁকা হচ্ছে অথচ আপনার-আমার যোগ্যতা আছে কিন্তু নিয়োগ হচ্ছে না। তারা আন্দোলনের জন্য কোনো প্লাটফর্ম পাচ্ছিল না বা নেতৃত্ব পাচ্ছিল না। আমরা যখন প্রথম ডাক দিই ১৭ ফেব্রুয়ারি তখন শাহবাগে শুধু মানববন্ধন করি। সেই মানববন্ধনে অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থী আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে যোগ দেয়। মানববন্ধন আমাদের সাহস জুগিয়েছিল যে এইভাবে যদি আমরা একটা জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি তাহলে কোটা সংস্কার হলেও হতে পারে। এরপর ১১মার্চ আমরা প্রচারের জন্য সাইকেল র্যালি করি। এরপর আমরা ঢাকার বাইরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের মতামতের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলি এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে একটা আহ্বায়ক কমিটি করি। শুধু ছাত্ররাই নয় শিক্ষক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সবাই আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে। ১-৭ এপ্রিল কোটা সংস্কার সপ্তাহ পালিত হয়। এই আন্দোলনের সবাই আমাদের সাথে এসে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। আমরা আগামী প্রজন্মকে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার ও যোগ্যদের যোগ্য স্থান দেয়ার জন্য এই আন্দোলন করছি।
ব্রেকিংনিউজ: ঢাবির ভিসির বাসায় হামলা সম্পর্কে কি বলবেন?
রাশেদ খান-নুরুল হক: হামলার পরে আমাদের ভিসি স্যার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমার বাসায় যারা হামলা করেছে তারা খুবই দক্ষ এবং পরিকল্পিতভাবে করেছে। এই হামলার সাথে আমার ছাত্ররা জড়িত নয়।’ এমনকি ডিএমপি কমিশনারও বলেছিলেন, এই হামলা দক্ষ লোক ছাড়া করতে পারে না। তাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়েই কিন্তু হামলার ব্যাপারে আমরা জড়িত না সেটি পরিষ্কার। একটা গোষ্ঠী আমাদের রাজনৈতিকভাবে জামায়াত-শিবিরের কর্মী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে কিন্তু আমরা বলেছি সারা বাংলার ছাত্রসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলন করছে এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। তারা প্রচার করেছিল যাতে আমাদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়। তারা ওই প্রচারে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা মনে করি তারাই ভিসি স্যারের বাড়িতে জঘন্য এই হামলা চালিয়েছে। নির্দিষ্ট করে বলা যায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মেহেদি হাসান ৮ এপ্রিল পুলিশের সাথে ছাত্রদের ধরে ধরে মেরেছে সেই ভিডিও ইউটিউবে আছে। আমাদের ধারণা ভিসির বাসায় হামলা মেহেদি হাসান ও তার নেতৃত্বে হয়েছে।
ব্রেকিংনিউজ: রাশেদ খানের কাছে প্রশ্ন, একটি গোষ্ঠী আপনাকে শিবিরের কর্মী বলে দাবি করছে এই ব্যাপারে কি আপনি বলবেন?
রাশেদ খান-নুরুল হক: এনএসআই, ডিজিএফআইসহ সকল গোয়েন্দা বিভাগ যারা নেতৃত্বে আছি আমাদের সবাইকে নিয়ে তদন্ত করেছে। আন্দোলনের গত তিনমাসে তারা কেউই কোনো সময় বলেনি আমরা কেউ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের কিংবা আমাদের পরিবার রাজনীতির সাথে জড়িত অথবা স্কুল-কলেজে ছাত্র রাজনীতির কোনো পোস্টে ছিল। এ ধরনের কথা কোনো পত্রিকাও দেখাতে পারেনি। ইত্তেফাকের মতো পত্রিকা আমার শিবিরের যে সম্পৃক্ততার কথা লিখেছিল সেটি ভুয়া প্রমাণ হয় এবং পরে তারা ক্ষমাও চেয়েছে। আমার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রী। আমার বাবা অথবা আমার পরিবারের কারো কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যদি সম্পৃক্ত থাকে তাহলে কেউ প্রমাণ করতে পারে আমি চ্যালেঞ্জ করছি ছাত্রসমাজ ও দেশবাসীর কাছে আমি ক্ষমা চাইবো।
ব্রেকিংনিউজ: যে ৫টি দাবি করে কোটা আন্দোলন চলছিল তার সবগুলো যদি সরকার না মেয়ে নেয় তাহলে আপনাদের ভূমিকা কি হবে?
রাশেদ খান-নুরুল হক: আমাদের ৫ দফা দাবির ব্যাপারে সরকারের প্রতিনিধি দলের সাথে কথা হয়েছে। তারা আমাদের দাবির ৫৬% থেকে কমিয়ে ১৫% করতে চেয়েছে। এখানে আমরা ৫% ছাড় দিয়েছি। ১৫% করে হলেও দ্রুত আমরা দ্রুত প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন চাই।
ব্রেকিংনিউজ: ছাত্রলীগ কি আপনাদের সাথে আছে?
রাশেদ খান-নুরুল হক: আন্দোলনের শুরু থেকে ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মীরা আমাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। ছাত্রলীগ যেহেতু একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন সেহেতু তাদের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর ৮ এপ্রিলের পর থেকে সরাসরি তারা আমাদের সাথে নেই। তবে ছাত্রলীগের একটি বৃহৎ অংশ আমাদের সাথে এখনও রয়েছে। আপনারা জানেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ থেকে কোটা সংস্কার আন্দলোনের জন্য অনেকেই পদত্যাগ পর্যন্ত করেছে।
ব্রেকিংনিউজ: আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কি আপনারা সন্তুষ্ট?
রাশেদ খান-নুরুল হক: এই আন্দোলনটা ছিল সাধারণ ছাত্রদের। যদি এই আন্দোলনে জামায়াত-শিবির ঢুকে থাকে তাহলে প্রশাসন শুধু তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা নিত। কিন্তু কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে ঢুকে গুলি চালাবে? রাবার বুলেট নিক্ষেপ করবে? কেন টিয়ারশেল মারবে? কেন হলের মসজিদে ঢুকে আমাদের উপর হামলা চালাবে? আমরা মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই আন্দোলনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ তাদের ক্যাম্পাসে তাদের অনুমতি ছাড়া কিভাবে পুলিশ রাতভর সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা চালালো? সেদিন শুধু পুলিশই নয় অনেক বহিরাগত ক্যাম্পাসে রামদা চাপাতি নিয়ে শোডাউন দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়নি?
ব্রেকিংনিউজ: কোটা প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে সর্বশেষ আপনাদের অবস্থান কি?
রাশেদ খান-নুরুল হক: বিভিন্ন কুচক্রীমহল আমাদের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়েছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। বারবার বলেছি আমরা কখনই সরকারবিরোধী নয় আমরা সরকারের উন্নয়নের সহযোগী। যে কারণে যখনই সরকার আমাদের আশ্বাস দিয়েছে আমরা তখনই তাদের কথা শুনেছি। তার বড় প্রমাণ হল- গত ৯ এপ্রিল সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও মাননীয় সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ডেকেছিলেন আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলাম এবং ২৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম ন্যাম ভবনে ডেকেছিলেন সেখানেও আমরা আলোচনার জন্য গিয়েছি। তারা আমাদের প্রজ্ঞাপনের ব্যাপারে ৭ মে পর্যন্ত ঘোষণা দেয়ার পরও কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ার পর আমরা আবারও সোমবার (১৪ এপ্রিল) আন্দোলনে নামি এবং মঙ্গলবার (১৫ মে) সারা দেশে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে যে নির্দেশনে দেন তার উপরে আর কোনো নির্দেশনা থাকে না বলে আমরা মনে করি। প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পরেই আমরা আনন্দ মিছিল করেছি এবং তাকে আমরা ‘মাদার অব এডুকেশন’ নামেও ঘোষণা দিয়েছি। আমরা মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটার ব্যাপারে যে কথা বলেছেন তা দ্রুতই বাস্তবায়ন হবে।
ব্রেকিংনিউজ: সময় দেয়ার জন্য আপনাদের দুজনকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
রাশেদ খান-নুরুল হক: ব্রেকিংনিউজ ও আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
- কার্টেসি — breakingnews.com.bd
No comments:
Post a Comment