মওদুদ রহমান
১০৪ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ডেভিড গোডাল সুইজারল্যান্ডে এসে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করলেন গেল মে মাসে। বেঁচে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে ওঠা ডেভিডের সঙ্গে যমদূতের দেখা করিয়ে দেওয়ার খরচ জোগাতে অনলাইনে উঠেছিল ১০ লাখ টাকারও বেশি চাঁদা। অথচ বাংলাদেশের সড়কে বিনা খরচাতেই তিনি দেখা দেন। প্রায় প্রতিদিনই তাঁর কাছ থেকে আমাদের পালিয়ে বাঁচতে হয়। যাঁরা কোনো কারণে পারেন না, তাঁরা মারা পড়েন, হয়ে যান নিহত হওয়ার ‘সংখ্যা’। এবারের রোজার ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার মাঝে মাত্র ১৩ দিনে মারা গেছেন ৪০৫ জন। এর মধ্যে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩৯। এই মৃত্যুগুলোর ওপর দুর্ঘটনার ট্যাগ লাগিয়ে দিলে অনেকেরই দায় খালাস হয়, এমনকি কিছু টাকার বিনিময়ে মামলা পর্যন্ত আপসরফা হয়ে যায়!
২০১১ সালে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সিগনাল, মানুষ, গরু ও ছাগল চিনতে পারার ক্ষমতাকে চালকদের লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। একই সময়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা ছাড়াই বাস-ট্রাকের জন্য নতুন করে ২৪ হাজার পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের সুপারিশে মদদ দেওয়ার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কতজন লাইসেন্স পেয়েছিলেন কিংবা কেবল গরু, ছাগল, সিগনাল আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারার যোগ্যতায় কতজন চালকের আসনে বসে এখন সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই পরিসংখ্যান না থাকলেও মৃতের টালিখাতার হিসাব বলছে, বর্তমানে প্রতিদিন সড়কে কমপক্ষে ৬৪ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। আর পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ (প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল, ২০১৮)।
কোনো ঘটনার মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। একই ক্রিয়ার নিয়মিত পুনরাবৃত্তিতে জনমনে প্রতিক্রিয়া আর জমে না। ঠিক তাই পত্রিকায় প্রতিদিন সড়কে মানুষ মারা পড়তে থাকার খবর আমাদের কাছে এখন শুধুই ‘সংবাদ’। নিহত ব্যক্তিদের এখন আর ব্যক্তি নামে মনে রাখার উপায় নেই, ‘বড়’ কোনো নাম জড়িত না থাকলে শুধু সংখ্যা উল্লেখেই দায়িত্ব শেষ করে ফেলে সংবাদমাধ্যমগুলো। আর দুই বাসের মাঝে রাজীব হোসেনের কাটাপড়া হাত ঝুলতে থাকার মতো ছবি প্রকাশ পেলে অনলাইনজুড়ে শুরু হয় কয়েক দিনের মাতম। সেই মাতম ঢাকা দিতে কখনো দেওয়া হয় চাকরির আশ্বাস, আবার কখনোবা খরচ হয়ে যাওয়া জীবনের দামের দফারফা হয় টাকার লেনদেনে (ইত্তেফাক, ২৪ জুন, ২০১৮)। কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনাগুলো লাগাতার কেন ঘটেই চলেছে, কী কারণে এই মৃত্যুমিছিল থামানোর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, কোন বাধায় রেল ও নৌ যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম দুটি বিকশিত হতে পারছে না—এসব প্রশ্ন উত্তরহীনই থেকে যাচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার যেকোনো আলোচনায় প্রধান বিষয় হয় চালকের অদক্ষতা, অসচেতনতা, আইন অমান্য করা এবং পথে বহু প্রাণের জিম্মাদার হয়েও বেপরোয়া মনোভাবের মতো বিষয়গুলো। অথচ তাদের কথা শোনার সময় আমাদের হয় না।
চার বছর আগে এক গবেষণাকাজে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন রুটের চালকদের সঙ্গে কথা বলি, জানার চেষ্টা করি তাঁদের কথা। অধিকাংশ চালকই জানিয়েছিলেন, তাঁদের একার আয়ে সংসার চলে না। স্ত্রী এবং কোনো কোনো সময় ছেলেমেয়েদেরও অর্থ উপার্জনে নানা কাজে যুক্ত হতে হয়।
জানিয়েছিলেন সুপারভাইজারদের প্রতিটি ট্রিপের সময় বেঁধে দেওয়ার কথা, সড়কে হয়রানি আর পুলিশি-অপুলিশি চাঁদাবাজির কথা। পুরোনো চাকা ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়া এবং সড়ক বিভাজক আর রোডমার্ক না থাকার মতো কারিগরি বিষয়গুলোও যে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, এ কথা তাঁরা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করেন। কেউ কেউ আমাকে পালটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী আসলে কে?’ (সর্বজনকথা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।
সড়কে রোজার ঈদের আগে-পরে হতাহত হওয়ার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ছয়টি নির্দেশনা জারি করেছেন। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, কমিটি গঠন, অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি, বিশেষজ্ঞ সুপারিশ প্রস্তুত করার মতো কাজগুলো এ পর্যন্ত কম হয়নি। অথচ সরষের ভেতরেই থেকে যাওয়া ভূতের কারণে অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হয়েছে। সিস্টেমের এই ভূত বাঁচিয়ে সড়কে মানুষের মৃত্যু কেবল কয়েকটি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে যে বন্ধ করা যাবে না, তা বলে দেওয়াই যায়। অন্তত নিকট অতীতের ইতিহাস আমাদের সেটাই বলছে। আর এ কারণেই ১৯৯৭ সালে প্রথম সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক অ্যাকশন প্ল্যানের পর ২০১১ সাল পর্যন্ত পরপর ছয়টি প্ল্যান অনুমোদন পেলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
ঘটনা ঘটার সব রকম পরিবেশ আর অব্যবস্থাপনা জারি রেখে ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে দুর্ঘটনা হিসেবে প্রচার করতে পারলেই বাংলাদেশে দায়িত্ববানরা দায়মুক্তি পান। এ কারণেই বছর হাজারে হাজারে মানুষ মরলেও কারও কোনো বিকার হয় না, বিচার তো দূরের কথা! বেঘোরে প্রাণ হারিয়ে সংখ্যার ফ্রেমে বন্দী হয়ে যাওয়া মানুষগুলো বারবার জানিয়ে যাচ্ছে, এ দেশের সড়কে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। তারপরও ভোঁতা হয়ে যাওয়া অনুভূতির দোষে সড়কে নেমে কোনোমতে বেঁচে বাড়ি ফিরতে পেরেই এখন আমাদের খুশি থাকতে হয়। আর নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব শেষ হয় কিছু লোকদেখানো নির্দেশনা জারি করার মাধ্যমে। অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার চলতে থাকা এই দুষ্টচক্র না ভাঙলে হয়তোবা ভবিষ্যতে সড়কে মৃত্যুই হবে এখন বেঁচে থাকা অনেকের নিয়তি। কাজেই দুষ্টচক্র ভাঙার চেষ্টা এই মুহূর্তে অনেক বেশি জরুরি।
- মওদুদ রহমান। প্রকৌশলী, গবেষক।
- কার্টেসিঃ প্রথম আলো/ জুলাই ১,২০১৮
No comments:
Post a Comment