ডক্টর তুহিন মালিক
পদত্যাগপত্র জমা দেয়া চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার মিডিয়াকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। সকালে পদত্যাগের পরও একজন মন্ত্রী হিসেবেই একটি অনুষ্ঠানে যোগও দিয়েছেন। অথচ গণমাধ্যমে পুরো দেশবাসী দেখেছে চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পদত্যাগ করেছেন।
আমাদের সংবিধানে ৫৮(১) নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ এখানে সংবিধানের ব্যাখ্যা অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেয়া মাত্রই মন্ত্রীদের পদ সংবিধান অনুযায়ী শূন্য হয়ে যাবে। সংবিধানের এই অনুচ্ছেদে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা শর্ত প্রয়োগ করা হয়নি। অন্য কোনো পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজনের কথাও বলা হয়নি। এই অনুচ্ছেদে কোনো ‘যদি’ বা ‘তবে’ বা কোনো ফর্মালিটির উল্লেখ করা হয়নি। মন্ত্রীরা পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র পৌঁছামাত্রই তাদের পদ শূন্য হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শুধু পোস্টবক্স হিসেবে কাজ করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেয়ার সাথে সাথে সাংবিধানিকভাবে চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের সবার পদ শূন্য হয়ে গেছে। এখন তারা আর কোনো ধরনের বেতন-ভাতা, বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার ও অন্যান্য সুবিধার কোনোটারই অধিকার রাখেন না। সংবিধানের ৫৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পদত্যাগ করার পর পদত্যাগী কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব পেতে হলে তাকে আবার সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নতুন করে আবার শপথ নিতে হবে ও শপথে স্বাক্ষর দিতে হবে।
আমাদের সংবিধান খুব পরিষ্কারভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও অন্যান্য মন্ত্রীর পদত্যাগকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখিয়েছে। খেয়াল করার বিষয় হলো- সংবিধানের ৫৭(১)(ক) অনুচ্ছেদ মতে, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয় রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করলে। অপরপক্ষে মন্ত্রীদের পদ শূন্য হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করলে।
প্রশ্ন জাগতে পারে- এ দুই ক্ষেত্রে ভিন্নতা কেন? জবাব হলো- সংবিধান মতে, রাষ্ট্রপতি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন। আর প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে ও বর্ণিত প্রক্রিয়ায় তিনি যেরূপ স্থির করবেন, সেরূপ মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এটা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারাধীন বিষয়। তাই সংবিধান প্রণেতারা প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ এই ক্ষমতা প্রয়োগের রক্ষাকবচের জন্যই মন্ত্রীদের পদ শূন্যের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক বলে রক্ষাকবচ দিয়েছেন। কেননা মন্ত্রীদের পদশূন্যতা যদি রাষ্ট্রপতির মর্জির ওপর শর্তযুক্ত থাকে, তা হলে সংসদীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী একজন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আসলে অহরহ সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংবিধান লঙ্ঘন করলেন। প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলেও তারা নিয়মিত বেতনভাতা পাবেন, অফিস করবেন এবং ফাইলেও যথারীতি স্বাক্ষর করবেন। এটা কেমন হুকুম! যেখানে পদত্যাগ করার পর মন্ত্রীদের প্রত্যেকের পদ সংবিধান মতে শূন্য ঘোষিত হলো, সেখানে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধভাবে মন্ত্রীরা যদি অফিস করেন এবং ফাইলে স্বাক্ষর দিতে থাকেন, তা হলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংবিধানের চরম লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। কেননা পদত্যাগী মন্ত্রীরা সম্পূর্ণ অবৈধ বিধায় তাদের কেউ আর কোনো বেতনভাতা, বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার, অফিস করা, ফাইলে স্বাক্ষর করা ও অন্যান্য সুবিধার কোনোটাই করার অধিকার রাখেন না।
সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সরকারি অর্থের রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ সংসদ দ্বারা প্রণীত আইনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত হবে। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করে পদত্যাগী মন্ত্রীদের ভরণ-পোষণের কোনো বিধান অদ্যাবধি তৈরি করেনি। তাই পদত্যাগী মন্ত্রীদের দেয়া সব বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা অবৈধ। তাদের নীতিনির্ধারণী, ফাইলে স্বাক্ষর ও নোটিংসহ সব কাজকর্ম অবৈধ।
আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, প্রধানমন্ত্রী এক দিকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে রাতকে দিনে রূপান্তরিত করছেন, অন্য দিকে ঠাণ্ডা মাথায় একের পর এক সংবিধান লঙ্ঘন করেই চলেছেন।
- লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
- কার্টসিঃ নয়াদিগন্ত/ ১১ নভেম্বর ২০১৮
No comments:
Post a Comment