মনজুরুল ইসলাম
মালয়েশিয়ায় কাজের অনুমতিপ্রাপ্তদের দেশটিতে প্রবেশের শেষ সময় ছিল ৩০ নভেম্বর। বেঁধে দেয়া এ সময় শেষ হলেও জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে ২৫ হাজার কর্মীকে পাঠাতে পারেনি ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি। এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন এসব বিদেশ গমনেচ্ছু। যদিও তাদের কাছ থেকে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি সংগ্রহ করেছে ৭৫০ কোটি টাকার বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে শ্রমিক পাঠাতে না পারলে চাহিদাপত্র বাতিল হওয়ার কথা উঠেছে। এটি হলে অপেক্ষমাণ শ্রমিক, ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেকেই বিপাকে পড়বেন।
‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে গত দেড় বছর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে আসছিল ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট। এ পদ্ধতিতে সিন্ডিকেটটি সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের অতিরিক্ত আদায় করেছে শ্রমিকপ্রতি গড়ে ৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে অনিশ্চয়তায় পড়া ২৫ হাজার বিদেশ গমনেচ্ছুর কাছ থেকে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি আদায় করেছে ৭৫০ কোটি টাকার বেশি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত এ সিন্ডিকেটের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি হলো— ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ।
সিন্ডিকেটভুক্ত একটি রিক্রুটিং এজেন্সির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, এখনো প্রায় ২৫ হাজার কর্মী যাওয়ার অপেক্ষায়। তাদের নামে কলিং ও মেডিকেলসহ সবকিছুই সম্পন্ন হয়েছে। তার পরও যেতে পারছেন না। এ সময়ের মধ্যে ঢাকার মালয়েশিয়ান হাইকমিশন থেকে ঠিকমতো স্ট্যাম্পিং না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। নতুন করে যদি মালয়েশিয়া সরকারের কাছ থেকে সময় বাড়িয়ে নেয়া না যায়, তাহলে এসব কর্মীর যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
তবে চাহিদাপত্র পাওয়া এ কর্মীরা যাতে দ্রুত দেশটিতে যেতে পারেন, সে লক্ষ্যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে জরুরি ভিত্তিতে ‘স্পেশাল সেল’ খোলা হয়েছে। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। যেসব কর্মীর কলিং ও ভিসা স্ট্যাম্পিং হয়েছে, তারা আসতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে দূতাবাস কাজ করছে।
রিক্রুটিং এজেন্সি সূত্রে জানা গেছে, অপেক্ষমাণ শ্রমিকের বিষয়ে মালয়েশিয়া থেকে একটি মেইল পাঠানো হয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে। তাতে বলা হয়েছে, যেসব শ্রমিকের নামে বৈধ ভিসা ও ডকুমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে, তাদের মালয়েশিয়া আসার (ফ্লাইট) অন্তত তিনদিন আগে সিনারফ্যাক্স অফিসে বিস্তারিত তথ্য পাঠাতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। তবে মালয়েশিয়া সরকারের ভাষ্য নয় এটি।
২০১২ সালে জিটুজি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে চুক্তি করে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে ১০টি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিকে জিটুজি প্লাসের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে দেশটিতে ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন বাংলাদেশী শ্রমিক যান। আর ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি পাঠিয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৯ জন শ্রমিক। ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে গত ১৪ আগস্ট এক বিশেষ কমিটির বৈঠকে জিটুজি প্লাস থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। মূলত ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত ছিল মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গড়া একটি সংঘবদ্ধ চক্র। বাংলাদেশ অংশে কাজ করেছে এ ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটটি। এ চক্র ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মীপ্রতি আড়াই থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা অতিরিক্ত আদায় করেছে।
হঠাৎ করে কর্মী নেয়া বন্ধের সিদ্ধান্তে ১ সেপ্টেম্বরের আগে কাজের অনুমতি পাওয়া ৭০ হাজার কর্মীর মালয়েশিয়ায় যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় দুই দেশের মন্ত্রিপর্যায়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া বাতিল হলেও গত ৩০ আগস্টের আগে যেসব বাংলাদেশী কাজের অনুমতিপত্র পেয়েছেন, তাদের সবাই মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে তাদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার ব্যবস্থা করবে দেশটির সরকার। তবে এখন পর্যন্ত যেতে পারেননি অনুমতিপত্র পাওয়া প্রায় ২৫ হাজার কর্মী।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে জিটুজি সমঝোতায় মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার খরচ নির্ধারণ করা হয় সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের জুনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক অফিস আদেশের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পুরুষ কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দেয়। সেখানে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় নির্মাণ বা কারখানা শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬০ হাজার ও কৃষি শ্রমিকের জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণের জন্য জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় আলোচনা করে চূড়ান্ত করার কথা জানানো হয়। যদিও জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় মালয়েশিয়ায় পুরুষ শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় বাড়ানোর বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তাই জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নির্ধারিত খরচ এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৫৭৫ টাকাই বহাল রয়েছে।
- কার্টসিঃ বণিক বার্তা/ ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮
No comments:
Post a Comment