‘ধারালে শোধাতে হয়’—আঞ্চলিক এই প্রবাদবাক্য তাঁদের জন্য যেন কথার কথা! এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে আর শোধ করছেন না। ঋণ দুর্বৃত্তদের অপকর্মের খেসারত গুনতে হচ্ছে খেলাপি হতে চান না—এমন ব্যবসায়ীদের। দেশে বিনিয়োগ কম হয় বলে নানা মহল থেকে যখন হতাশা ব্যক্ত করা হচ্ছে, তখন ঋণ জালিয়াতদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঋণ লাভে বেগ পেতে হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং এ অর্থের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ রাখা অর্থের ভার পড়ছে ‘ভালো’ ব্যবসায়ীদের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিতে দেখা যায়, গত এক দশকে খেলাপি ঋণের অঙ্কটি চার গুণ হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এসে পরিস্থিতির রীতিমতো অধঃপতন ঘটেছে। ২০০৭ সাল শেষে যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনায় ব্যবসায় লোকসানের কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা খেলাপি হতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে খেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বন্ধক রাখা জমি বা সম্পদ নিলাম করে ঋণের টাকা আদায় করে ব্যাংক। কিন্তু এখন অনেক ঋণগ্রহীতাই ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হচ্ছেন। তাঁরা বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম করে টাকা আদায়েও বাধা দিচ্ছেন। ফলে বিপাকে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক। আর লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বড় বড় কয়েকটি ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে বড় অঙ্কের কিছু ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ দেওয়া হলেও তাতে আশানুরূপ ফল দেয়নি। এই ঋণও আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করেও সুফল পাচ্ছে না। কারণ ঋণগ্রহীতারা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁরা প্রভাবশালী বিচারপতিদের দিয়ে মামলা পরিচালনা করান। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে যেন অনেকটা নিয়ত করেই ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন প্রভাবশালীরা। এতে ব্যাংক ব্যবস্থা ধসে পড়ছে। জনগণের করের টাকায় প্রতিবছর ব্যাংকগুলোর মূলধন পুনর্ভরণ করে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে।
কাগজে-কলমে দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের দাদা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ৮৮৯ কোটি টাকা। ওয়ান-ইলেভেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে তাঁদের ঋণ পুনর্গঠন করে নিয়েছিলেন। তাঁদের অনেকেই এর পর থেকে আর কোনো কিস্তি পরিশোধ করেননি। তবে সংসদে সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শীর্ষ ২৫ খেলাপির যে তালিকা দিয়েছে, এর মধ্যে হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা প্রভাবশালী গ্রুপগুলোর নাম নেই। অর্থাৎ এরই মধ্যে তারা আবারও পুনর্গঠন বা পুনঃ তফসিল করে নিয়েছে।
ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত একটি শিল্পগোষ্ঠীর চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ৩৮২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে জামানতের মূল্য ২৩১ কোটি টাকা। গ্রাহক ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর একবার এই ঋণ আট বছর মেয়াদে পুনঃ তফসিল করে নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত আর কোনো কিস্তি দেয়নি। এই ঋণ গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর আবার পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। তাতে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গ্রাহককে কোনো কিস্তি দিতে হবে না। কিন্তু এই গ্রাহকের ৩৮২ কোটি টাকা খেলাপির হিসাবে নেই। একই গ্রাহক নতুন করে ব্যাংকের কাছে ২২০ কোটি টাকার ঋণ চেয়েছে। যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য এই ঋণ চাওয়া হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছেন, পাঁচটি কম্পানিই বন্ধ রয়েছে। আবার হলমার্কসহ অনেক ঋণ জালিয়াতের কাছ থেকে আপাতত কোনো টাকা পাওয়া যাবে না ভেবে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ অবলোপন করে রেখেছে ব্যাংকগুলো। শীর্ষ ২৫ ঋণখেলাপির তথ্যে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলমার্কের মাত্র একটি কম্পানির (হলমার্ক ফ্যাশন) নাম রয়েছে, যে কম্পানিটির নামে ৩৩৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি রয়েছে। হলমার্ক গ্রুপের বাকি ঋণ অবলোপন করে রাখা হয়েছে।
হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের দায়ের করা মামলায় হলমার্ক গ্রুপের পক্ষে আদালতে লড়েছেন শুরুতে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, পরে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সর্বশেষ হিসাবে, অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে দুই লাখের মতো মামলা। তাতে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। আবার অর্থঋণ আদালতে নিষ্পত্তি হলেও এর বিরুদ্ধে আপিল করার পর উচ্চ আদালতে মামলাগুলো দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে। অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হওয়ার পরও তাঁকে যাতে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়, সে জন্য আগেই উচ্চ আদালতে রিট করে রায় নিয়ে এসে নতুন করে ঋণ নিচ্ছেন। উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা ঋণসংক্রান্ত বিপুলসংখ্যক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠনে উদ্যোগ নিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলেও তা এখনো গঠিত হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঋণখেলাপিরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ছে এবং ভালো ব্যবসায়ীদের ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে জালিয়াতি করে ঋণ দেওয়া ও নেওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, তাকে ‘ব্যাংক লুটপাট’-এর সঙ্গে তুলনা করছেন বিশ্লেষকরা। হলমার্ক ঋণের জন্য কোনো আবেদন না করেই ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে নিয়ে গেছে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিকরাও বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক চার হাজার কোটি টাকা কাদের দিয়েছে, তাদের সবার নাম-ঠিকানাও নেই ব্যাংকের কাছে। একসময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও এখন এ সংস্কৃতি বেশির ভাগ ব্যাংকেই ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংকাররাও ভুয়া কাগজে ঋণের নামে টাকা দিয়ে মোটা অঙ্কের কমিশন খাচ্ছেন। সরকারি বিভিন্ন বৈঠকেও ব্যাংক থেকে জাল-জালিয়াতি করে টাকা নিয়ে পরিশোধ না করার ঘটনাকে ‘লুটপাট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩৪তম বৈঠকে সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাটের ঘটনা কিভাবে ঠেকানো যায়, তার ওপর উপায় খুঁজে বের করতে আরো কার্যকর গবেষণা করার সুপারিশ গৃহীত হয়।’
বাংলাদেশে ব্যাংক লুটপাট ও খেলাপির ভয়ংকর এ চিত্র এক দশক আগেও চোখে পড়েনি। তখন ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ প্রকৃত অর্থেই লোকসান করে খেলাপি হতেন। খুব কমসংখ্যক ব্যবসায়ীই ঋণ নিয়ে ইচ্ছা করে খেলাপি হতেন। খেলাপি ঋণ ‘মহামারি আকার’ ধারণ করেছে মূলত ২০১২ সাল থেকে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ২২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১৩.২৩ শতাংশ ছিল। ২০০৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকায় নামে, খেলাপির হার দাঁড়ায় ১০.৭৯ শতাংশ। এই ঋণ ও এর হার পরের বছরগুলোতে ছিল এ রকম : ২০০৯ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.২১ শতাংশ। ২০১০ সালে ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা এবং মোট ঋণের ৭.২৭ শতাংশ, ২০১১ সালে ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা (৬.১২ শতাংশ), ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা (১০.০৩ শতাংশ), ২০১৩ সালে ৪০ হাজার ৫৮৩ টাকা (৮.৯৩ শতাংশ), ২০১৪ সালে ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা (৯.৬৩ শতাংশ), ২০১৫ সালে ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা (৮.৭৯ শতাংশ) এবং ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা (৯.২৩ শতাংশ)। আর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা (মোট ঋণের ১০.৬৭ শতাংশ)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম ত্রৈমাসিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) ৭৩৯ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ছয় হাজার ১৫৯ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বাড়ে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এটি যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০০৩ সালের পর থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো আদায় হওয়ায় অবলোপন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের মধ্য থেকে বড় বড় কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ১৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ দীর্ঘ মেয়াদে পুনর্গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে ওই ঋণগুলো খেলাপি ঋণের মধ্যে পড়ছে না। এ ছাড়া অনেক ঋণখেলাপি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে নিজেদের খেলাপি হিসেবে দেখানোর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন বলেও জানা যায়। এতেও বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েও খেলাপির হিসাবে যোগ হচ্ছে না। এই ঋণগুলো যোগ হলে খেলাপি ঋণের চিত্র আরো ভয়াবহ হবে বলে মনে করেন ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব এবং ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাবসহ নানা কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার বেশি। সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের মতো কিছু ব্যাংক বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে উচ্চ খেলাপি ঋণে জর্জরিত। এ ছাড়া সম্প্রতি কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করছে। চলতি অর্থবছরেই রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে ব্যাংকগুলোকে দুই হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগান দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাকি টাকা জোগান দেওয়া হবে আগামী অর্থবছর, জনগণের করের টাকা থেকে। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মোট ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে সরকার।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, খেলাপি ঋণ বন্ধে ঋণ বিতরণকালে ব্যাংকারদের সঠিক গ্রাহক বাছাই করা উচিত। আর যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে খেলাপি সংস্কৃতি কমবে না। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়লে ভালো গ্রাহকদের দুর্ভোগই সবচেয়ে বেশি। কারণ যাঁরা খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের নেওয়া ঋণের সুদাসল না পেয়ে ব্যাংক ভালো গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার সময় সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে কারণে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েই চলেছে।’ সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ মঞ্জুর করায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায়, তা কারো জানা নাই। সরকারি ব্যাংকে ব্যাপক ঋণ অনিয়মের পর এবার বেসরকারি ব্যাংকেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরা নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারায় অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেওয়া হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। এসব ঋণের বড় একটি অংশ আদায় হচ্ছে না।’
এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ বলেন, হঠাৎ যারা ফুলেফেঁপে বড়লোক হতে চাচ্ছে, তারাই এ কাজ করছে। প্রভাবশালীদের মধ্যেই ফাঁকিবাজি বেশি। ব্যাংক অনেক সময় ভালো গ্রাহক মনে করেই ঋণ দেয়। কিন্তু ঋণের টাকা হাতে পাওয়ার পরই ঋণগ্রহীতার চেহারা পাল্টে যায়। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করার কথা ভুলে যায়।
বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের চারজন এবং টানা ৯ বছর থাকার বিধান চালু হওয়ায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে মনে করেন তিনি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণ ছিল সাত লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়া ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকার ২৯.২৫ শতাংশ ঋণই ছয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের। পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২.৪১ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের দেশীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ৫.৯৭ শতাংশ। জুনের তুলনায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
তথ্যে আরো দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল দুই হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এই ব্যাংকগুলোর ৭.৮৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি। একইভাবে সেপ্টেম্বরে কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল পাঁচ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। এই ব্যাংকগুলোর ২৩.৭৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি।
বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্প্রতি বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাটা খুবই উদ্বেগজনক। এভাবে ঋণ বিতরণ করলে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যেতে পারে।’
- কালের কণ্ঠ/12-3-18
No comments:
Post a Comment