Search

Thursday, March 1, 2018

বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার


নারায়ণগঞ্জে প্রায় এক হাজার লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে অনেক অস্ত্র এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে ছিল বা আছে, যাঁরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁরা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করছেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে বর্তমানে লাইসেন্স পাওয়া অস্ত্রের মধ্যে শটগান ৫৯৫টি, পিস্তল ২২২টি, রিভলবার ৯৩টি ও টু-টু বোর রাইফেল ৬৩টি। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন নিজে শটগানের লাইসেন্স দেয়। অন্য অস্ত্রগুলোর ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে লাইসেন্স দেয় জেলা প্রশাসন।
লাইসেন্স করা অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহারের উদাহরণ দেখা যায় গত ১৬ জানুয়ারি। ওই দিন ফুটপাতে হকার বসানোকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর সাংসদ শামীম ওসমানের কর্মী-সমর্থকেরা হামলা চালান। শামীম ওসমানের ক্যাডার নিয়াজুল ইসলাম এবং মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ্ নিজামকে তখন প্রকাশ্যে পিস্তল নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে। তবে প্রদর্শন করা সেই অস্ত্রগুলো বৈধ বলে তাঁরা দাবি করেছেন।

নারায়ণগঞ্জে কারা কারা অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন, তা জানতে চেয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছিলেন প্রথম আলোর একজন প্রতিবেদক। কিন্তু গত বছর ১ জুন ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই তথ্য দেয়নি জেলা প্রশাসন।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, মেয়র আইভীর ওপর সশস্ত্র হামলা এবং প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনায় সেই অস্ত্রধারীদের অস্ত্রের লাইসেন্স এখনো বাতিল করেনি প্রশাসন। তিনি বলেন, বিভিন্ন দলের সময়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে নারায়ণগঞ্জে অধিকাংশ অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অবৈধ অস্ত্রবাজেরা বৈধভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স পেলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা থাকে না।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দেড় বছরের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি খুব কমসংখ্যক অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল না। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে শামীম ওসমান সাংসদ থাকার সময় নিয়াজুল ইসলাম ও শাহ্ নিজাম অস্ত্রের লাইসেন্স পান। নিয়াজুল সাংসদ শামীম ওসমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং মহানগর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক। এর আগে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষ ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই ছবি প্রকাশিত হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শামীম ওসমানের ওই দুই সহযোগীর অস্ত্রের লাইসেন্সও এখনো বাতিল করা হয়নি।

নিয়াজুল ১৯৮৮ সালে চাষাঢ়ায় জোড়া খুন মামলার আসামি ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত কয়েকটি হত্যা মামলারও আসামি ছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক বিবেচনায় সে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয় বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং আলোচিত সাত খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি নূর হোসেন এবং তাঁর সহযোগীদের কাছে ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। অস্ত্রগুলোর মধ্যে সাতটি শটগান, দুটি পিস্তল ও একটি করে রাইফেল ও রিভলবার রয়েছে। নূর হোসেন ও তাঁর ক্যাডাররা ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ওই অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স পায়। তারা ওই অস্ত্র ব্যবহার করে সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করত। 

নূর হোসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁর লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে অংশ নিতেন। সাত খুনের ঘটনার পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আনিসুর 

রহমান মিয়া ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল এবং অস্ত্রগুলো জব্দ করেন। বাতিল করা ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন এবং ফেরত চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছেন নূর হোসেনের ভাতিজা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল বাদল।

এ বিষয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই অস্ত্রের লাইসেন্স ফিরিয়ে দেওয়া হলে জননিরাপত্তা বিঘ্নের আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে চাষাঢ়ায় হকার ইস্যুতে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন ও অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা-পুলিশ তদন্ত করছে। 

আরেক ঘটনায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের দিন রূপগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবলীগ কর্মী সুমন আহমেদ মারা যান। এই ঘটনায় করা মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, কায়েতপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের লাইসেন্স করা পিস্তল থেকে ছোড়া গুলিতে সুমন মারা যান। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। 

সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, নূর হোসেনের কারণে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো ঘটনা ঘটেছে। এখন নিয়াজুল ও শাহ্ নিজামেরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ভীতি প্রদর্শন করছেন। প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের কারণেই এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

  • প্রথম আলো / ১ মার্চ ২০১৮ 

No comments:

Post a Comment