আব্দুল বায়েস
হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের একটি বিখ্যাত উক্তি এ রকম: রিকশা চালিয়ে উপার্জন করলে মানুষ দেখে ফেলবে, মান-ইজ্জতের বালাই থাকবে না। তার চেয়ে অন্ধকারে চুরি করা অনেক ভালো। কেউ দেখবে না; উপার্জন হবে, মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় যে হরিলুট চলছে, তাতে বহুব্রীহি নাটকের উক্তিটি বারবার মনে পড়ে। ব্যাংকের সবাইকে অন্ধকারে রেখে অন্ধকার পথে ডাকাতি করে বড় হওয়ার বাসনা বড় বড় লোকের। এরা সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি, সংসদ সদস্য। এদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে আকুলতা সবার।
নানা বাহানায় বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বর্তমানে প্রায় ৬০টি ব্যাংক কাজ করছে এবং শোনা কথা, ডজনখানেক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে বেশ জোরেশোরে সাফাই গাইতে অর্থমন্ত্রীর কোনো রাখঢাক নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ যারা অনুমোদন পাচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই সরকারের সমর্থক; কিন্তু মুশকিল হয় যখন সরকারের স্বার্থ ও দেশের স্বার্থ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে একটি ব্যাংকেরও অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত ব্যাংক যে কত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তার বড় প্রমাণ অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি। ব্যাংকগুলোয় পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকল্পে স্বয়ং সরকার উদগ্রীব। সোনালী, বেসিক, জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি শেষে সম্প্রতি মাথা তুলেছে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি। আর এসব ঘটছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনে। অথচ এরা অর্থবাজারের অভিভাবক। বাংলাদেশ ব্যাংক মুখে কুলুপ এঁটে মনে মনে গাইছে, ‘আমার বলার কিছু ছিল না না গো... চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিরূপাক্ষ পাল থেকে ধার করা বক্তব্য দিয়ে মূল আলোচনায় যাওয়া যেতে পারে। স্যার আইজাক নিউটন নাকি একবার দরজায় বড় একটা গর্ত খুঁড়েছিলেন তার বিড়ালটি আসা-যাওয়ার জন্য। এগুলোকে বলে পেট ডোরস বা পোষা প্রাণীর দরজা। সাধারণত দরজার নিচে থেকে এ দরজায় তিনি আবার অন্য একটা ছোট গর্ত খোঁড়েন বিড়ালছানা আসা-যাওয়ার জন্য। আমরা নিশ্চিত নই, সত্যি সত্যি নিউটন ওই কাজটা করেছিলেন কিনা; তবে এ রূপক থেকে একটা শিক্ষা বেরিয়ে আসে। তা হলো এই যে, বড় বিড়াল ও বিড়ালছানা যদি একই গর্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারে তাহলে ছোট গর্ত অর্থহীন। তেমনি আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় যদি ব্যাংকিং খাতের সব দেখাশোনা করতে পারে তাহলে আলাদা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার কোনো যুক্তি আছে কি? বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিরূপাক্ষ পালের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অফিসের এক কোণে বাংলাদেশ ব্যাংককে জায়গা দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। এটা শুধু ব্যয়সাশ্রয়ী হবে না, এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার আপাত প্রতীয়মান দূরত্বকে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবে বলে আমাদের ধারণা। ইদানীং বাংলাদেশের ব্যাংকিং বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কথাই যেন সরকার শুনতে আগ্রহী নয়। সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় যা করছে, তা অর্থনৈতিক বিবেচনাপুষ্ট নয়। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সরকারের কাছে ‘গুড বয়’ ইমেজ রক্ষা করতে গিয়ে বাজারবহির্ভূত অসঙ্গতিগুলো গিলতে বাধ্য হচ্ছে, যেমন— নতুন ব্যাংকের জন্ম ও ব্যাংক প্রশাসনে পরিবারতন্ত্রের পুনর্জন্ম ইত্যাদি।
গেল অর্থবছরের জুনে সরকার ‘পুঁজি পুনঃকরণ’ (রিক্যাপিটালাইজেশন) ঘোষণা করে। তার আগে ২০০৯ থেকে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পুঁজি পুনঃকরণের পুরো অর্থ ময়লার নালায় প্রবাহিত হয়েছে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, প্রায় পুরো অর্থ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও দুর্নীতিবাজ লোকদের পকেটস্থ হয়েছে। এখন আবার তারা চাইছে পুনঃপুঁজিকরণ অর্থ, পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো; যা এ বছরের বাজেট বরাদ্দের চেয়ে দ্বিগুণ। তাদের এ দাবি কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের ব্যবহার উচ্ছন্নে যাওয়া বখাটে ছোকরার মতো, যে প্রত্যেক সময় বাবার টাকা আকাশে উড়িয়ে আবার বাবার কাছে হাত পাতে। পার্থক্য এটুকুই যে, বখাটে ছেলেটিকে বাবা তার পকেট থেকে টাকা দেন আর বখাটে ব্যাংকগুলোকে সরকার অর্থ দেয় জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে। প্রসঙ্গত, কেউ কেউ ভারতের সাম্প্রতিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের পুঁজি পুনঃকরণ প্রসঙ্গ টেনে আনেন। আমরা ভালো ভালো দীক্ষা নিতে দুঃখ পাই, অথচ মন্দ উদাহরণ টেনে মহানন্দে থাকি। ভারতে ঋণখেলাপের প্রধান কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে মেগা প্রকল্প শেষ হতে দেরি হওয়া এবং এর ফলে বিনিয়োগকারীর আর্থিক ক্ষতি। অন্যদিকে বাংলাদেশে ঋণখেলাপির কোনো প্রকল্পই থাকে না। যা-ও থাকে তা মিথ্যা প্রকল্প, মিথ্যা দলিল আর সত্যি শক্ত রাজনৈতিক প্রশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশে ঋণখেলাপির জন্ম। তাছাড়া ভারতে পুঁজি পুনঃকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বহুমাত্রিক সংস্কারসাধনের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশে তা হয় না; বরং চোখ বুজে পুঁজি পুনঃকরণ করা হয়।
বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তুলে নেয়ার জন্য ওই ব্যাংকের বোর্ডের কোনো সদস্যকে জেল খাটতে ও জরিমানা গুনতে হয়নি। এদিকে একই ব্যক্তির বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্পে জনতা ব্যাংক অর্থ ঢেলেছে। প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ এর বোর্ড সদস্য বা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা এ পর্যন্ত রুজু করা হয়নি। সোনালী ও অন্যান্য ব্যাংকের কথা না হয় না-ই তোলা হলো। ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ইত্যাদির সব বোর্ড সদস্য ও চেয়ারম্যানকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি না দিলে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে রক্ত ঝরতেই থাকবে। যথাযথ সংস্কার ছাড়া অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের মানে দাঁড়ায় পচা ব্যাঙ কুয়ায় রেখে পানি সেচা।
অথচ আমরা তেমনটি চাই না। কেন্দ্রীয় তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। উন্নয়ন চেতনা, আর্থিক জগতে অভিনবমূলক ও নীতি বাস্তবায়নে অধিকতর কঠোর হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেয়া। পুরো আর্থিক বাজারের উন্নতি ও অবনতির দায়ভার বাংলাদেশ ব্যাংকের। সরকার শুধু তার কর্তব্য পালনে সহায়তা করবে মাত্র।
বহুদিন আগে একটা বইতে সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পর্ক নিয়ে একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে, ওই বইতে বলা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা ভালো গৃহবধূর মতো। ভালো গৃহবধূ স্বামীর সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্কাতর্কি, ঘ্যানরঘ্যানর করে, তবে শেষমেশ স্বামীর সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এই বলে যে, পতি পরমেশ্বর। ঠিক তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একেবারেই যে কিছু বলে না তা নয়, তবে শেষমেশ মেনে নেয় যে সরকারই শেষ কথা। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা একজন ভালো গৃহবধূর মতোই। সমস্যাটা ওখানেই। আমরা চাই, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ভালো গৃহবধূ না হয়ে অর্থবাজারের অর্থবোধক অভিভাবক হিসেবে দাঁড়াক। নয়তো আর্থিক সুনামির তোড়ে ভেসে যাবে সবাই।
শেষ কথা। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল শ্রেয়। এতগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থাকার প্রয়োজন আছে কি নেই, তা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। প্রয়োজন থেকে থাকলেও ওগুলো শুধু আমানত সংগ্রহে কাজে লাগানো যায় কিনা, সেটাও ভাবার বিষয়। মোটকথা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈপ্লবিক সংস্কার না ঘটা পর্যন্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। একমাত্র ব্যাপক সংস্কারসাপেক্ষে রুগ্ণ কোনো ব্যাংকের জন্য সীমিত মাত্রায় পুনঃপুঁজিকরণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে যে শর্তহীনভাবে পুনঃপুঁজিকরণ প্রক্রিয়া ব্যাংক রুগ্ণ হওয়ার অন্যতম উৎসাহদাতা। সুতরাং শেয়ার মার্কেটের ধসের মতো ব্যাংকিং খাতে যাতে সুনামি না আসতে পারে, তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় পস্তাতে হবে সবাইকে।
- বনিক বার্তা/ মার্চ ০১, ২০১৮
No comments:
Post a Comment