বাংলাদেশের পতাকাহীন ১৫ বছরের আয়ুস্কাল ও ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান সংবলিত ৩,৫০০ কেজির প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ, বঙ্গবন্ধু-১ নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে ৩০ ডিগ্রি পূর্বে প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় তার কক্ষপথ ১১৯.১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে স্পেসএক্সের ফ্যালকন রকেট ৯-এর মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে।
বাণিজ্যিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মঙ্গোলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উপগ্রহগুলোর কথা ধরলে বাংলাদেশের সে প্রয়াসটি কতখানি অর্থনৈতিক ফলপ্রসূ হবে, সেটি প্রশ্ন। কেননা যে ১১৯.১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ উপগ্রহটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, তা যেমন একদিকে নিজস্ব ভূখন্ড থেকে ৩০ ডিগ্রি পূর্বে অবস্থিত, তেমনি সেটির কক্ষপথটি অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও মঙ্গোলিয়ার উপর দিয়ে গেছে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ বাংলাদেশের জনগণের জন্য সতর্কতা সংকেত প্রদানসহ অপরাপর উপকার কতখানি হবে, তা ভবিতব্যই বলবে। এছাড়া ওই কক্ষপথের অাওতাধীন বা কাছাকাছি দেশ, যেমন রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ইস্ট তিমুর, ব্রুনাই, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, পপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার কি সহজেই বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের ২০টির বাণিজ্যিক গ্রাহক হবে? এসব দেশের কী সহায়ক বাণিজ্যিক কোনো প্রতিযোগী উপগ্রহ নেই? এ বিষয়ে ২০০২ সালের ৯-১১ ডিসেম্বর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘স্যাটেলাইটস ইন আইপি অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া’ ওয়ার্কশপে এশিয়া-প্যাসিফিক স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কাউন্সিলের তদানীন্তন সভাপতি ইয়াসু ওটাকি তার ‘স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনস ইন দ্য এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিওন, টুডে অ্যান্ড টুমরো’ শীর্ষক মূলপ্রবন্ধ পাঠ করেন, যা অনলাইনে সকলের জন্য বিদ্যমান। এতে নানাবিধ বিষয়ের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে কী করে ১১০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত জাপানের ‘বিস্যাট-২’ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কোরিয়াস্যাট-৩’, ‘ইনটেলস্যাট-৯০২’, ‘ইনটেলস্যাট -৯০৪’, ‘ইনস্যাট-৩সি’, ‘জেসিস্যাট-৮’, ‘বিস্যাট-২এ’, ‘এন এসটিএআরসি’, ‘এনএসএস-৬’, ‘আইপিএসটিএআর’ ও ‘ইটিএস-৮’ এর ফলপ্রসূ ব্যবহার। পাশাপাশি ইউরোপের অ্যারিয়েনস্পেস কর্তৃক বিশ্বের অর্ধেকের বেশি বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎক্ষেপন উপগ্রহের আধিপত্যটি বিবৃত, যেমন : ‘এরিয়েন ৫ইসিএ’ ও ‘এরিয়েন ৫’। বলাবাহুল্য, বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হচ্ছেন হংকংয়ের গ্রেগ ডাফনার। অপরাপর পরিচালকরা হচ্ছেন : হংকংয়ের বাইঝং হুয়াং, ইন্দোনেশিয়ার ধানী ইন্দরা, যুক্তরাষ্ট্রের ডেরেল মসম্যান, সিঙ্গাপুরের দীপক মাথুর, যুক্তরাষ্ট্রের এডি কাটো, জাপানের হিরোশি কোয়ামা, হংকংয়ের জিম সিম্পসন, যুক্তরাষ্ট্রের কেভিন রিস্, সিঙ্গাপুরের খেং ঘি ন্যাং, জাপানের মিটসুটোসি আকাও, ফ্রান্সের স্যান্ডি গিলিও, দক্ষিণ কোরিয়ার তাইসুং লিম, সিঙ্গাপুরের টেরি ব্লিকলি, যুক্তরাষ্ট্রের টম অচিনেরো, সিঙ্গাপুরের ভিভিয়ান কুইনেট। তাতে দেশভিত্তিক পরিচালকদের তালিকা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে উপগ্রহের বাণিজ্যিক ব্যবসায় কে কতখানি আধিপত্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া স্যাটেলাইট বাণিজ্যিক জগতের অনন্য প্রতিষ্ঠান নদার্ন স্কাই রিসার্চ, সংক্ষেপে ‘এনএসআর’-এর ২০১৭ সালের ১৭ মে প্রকাশিত ‘এশিয়ান স্যাটেলাইট মার্কেট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, চীনের বিনিয়োগের কারণে এশিয়ার স্যাটেলাইট বাজার বর্তমানে যে কোনো সময়ের চেয়ে স্থিতিশীলতার পরিবর্তে অস্থিতিশীল, তারই উল্লেখ রয়েছে।
এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিবেচনাটিও যথেষ্ট গুরুত্ববহ। কেননা ১৫ বছরের আয়ুসম্পন্ন ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ বাস্তবায়নে মোট খরচ হয়েছে বা হচ্ছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। তাতে সরকারি তহবিল থেকে গেছে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। বাকি ঋণ হিসেবে ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা দিয়েছে এইচএসবিসি ব্যাংক। এই পুরো অর্থের বড় অংশটি অর্থাৎ ১ হাজার ৯৫১ কোটি স্যাটেলাইট সিস্টেম বাবদ নিয়েছে ফ্রান্সের থেলিস অ্যালেনিয়া স্পেস সংস্থা। আর যে কক্ষপথে এই উপগ্রহটি প্রদক্ষিণ করবে, সেটি ২১৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক প্রতিষ্ঠান থেকে। বাকি ৮০০ কোটি টাকা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হচ্ছে।
— লেখক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ইমেইল — bukhari.toronto@gmail.com
No comments:
Post a Comment