Search

Sunday, May 13, 2018

ফারমার্স ব্যাংক দুর্নীতি - চিশতীর নামেই জালিয়াতি!

ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর নামেই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তার নাম মাহবুবুল হক চিশতী। পাসপোর্ট করেছেন বাবুল চিশতী নামে। প্রকৃত নাম কোনটি- দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রিমান্ডে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে তিনি বলেছেন, দুটিই। 

সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে এনআইডি করেছে। আর আপনি আপনার নাম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। কেন করছেন? রিমান্ডে দুদক কর্মকর্তাদের এই বক্তব্যে হতচকিত হন তিনি। 

দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নামেই যার জালিয়াতি তার জীবনটাও প্রতারণা, জালিয়াতিতে ভরা। রিমান্ডে দুদককে দেওয়া জবানবন্দিতে চিশতীর জীবনের অনেক অজানা সত্য বেরিয়ে এসেছে। জবানবন্দির প্রতিটি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিটের সঙ্গে জবানবন্দিটিও আদালতে পেশ করা হবে। জবানবন্দি নিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম ও উপসহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন। 

রিমান্ডে চিশতী জানান, ১৯৭৪ সালে তিনি বগুড়ার দারুল ইসলাম নৈশ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে এসএসসি পাস করেছেন। বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, তার কোনো একাডেমিক সনদ নেই। রিমান্ডে তিনি এও বলেছেন, তিনি ইংরেজি বোঝেন না। ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সময় ইংরেজিতে দক্ষ একজন ব্যক্তিকে পাশে রাখতেন। 

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, বগুড়ার গ্যারিসন সিনেমা হলের সহকারী হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। পরে সাত লাখ টাকা পুঁজি জোগাড় করে মালপত্র সাপ্লাই ও রাখি মালের ব্যবসা শুরু করেন। স্ত্রী রুজি চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী ও মেয়ে রিমি চিশতীর নামে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলস। 

এরপর মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হয়েছেন ২০১৩ সালে। পরে ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাংকের গুলশান শাখার বিভিন্ন হিসাব থেকে বকশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলসের হিসাবে জমা হয়েছে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। 

দুদকে দেওয়া লিখিত জবানবন্দিতে বলা হয়, তার শ্যালক মোস্তফা কামাল তারই সহায়তায় ব্যাংকের গুলশান শাখায় রিমি এন্টারপ্রাইজের নামে একটি হিসাব খুলেছিলেন। চিশতী অডিট কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালে মোস্তফা কামাল এই ব্যাংকের সাজসজ্জার কাজের নামে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া বিল পেশ করে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজে ও পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ গ্রহণ করে মেসার্স এসটুআরএস করপোরেশনের হিসাবে ৩৮ কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করেছেন। চিশতীর পুত্রবধূ ফাহানা আহমেদের ফারমার্স ব্যাংকের হিসাবে ৩০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। শ্যালক মোস্তফা কামাল ও গোলাম রসুলের হিসাবেও মোটা অঙ্কের অবৈধ লেনদেন হয়েছে। মেসার্স জাহান ট্রেডার্স ও তনুজ করপোরেশনের দুটি হিসাব থেকে ৫৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে চিশতী ও ব্যাংকের সমালোচিত বিতর্কিত একজন শীর্ষ কর্মকর্তা আত্মসাৎ করেছেন। পরে ওই টাকায় ব্যাংকের শেয়ার ক্রয় করা হয়। 

রিমান্ডে বলা হয়, চিশতী ও বিতর্কিত শীর্ষ ওই কর্মকর্তার হিসাবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় দেড়শ' কোটিরও বেশি টাকা জমা হয়েছে। রিমান্ডে তিনি এও বলেছেন, তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে তিনি ও শীর্ষ ওই কর্মকর্তার আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। 

চিশতীকে দুটি পর্যায়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৫ থেকে ১৯ এপ্রিল ও ২০ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। পরে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালতের আদেশে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। 

গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে চিশতীর নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাতের অভিযোগে চিশতীসহ ছয়জনকে আসামি করে দুদক ঢাকার গুলশান থানায় মামলা করে গত ১০ এপ্রিল। মামলার দিনেই চিশতীসহ চার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত অন্য তিনজন হলেন- বাবুল চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ব্যাংকের ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মাসুদুর রহমান খান ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়া উদ্দিন আহমেদ। চারজনই বর্তমানে জেলে আছেন। 

অন্য দুই আসামি হলেন- চিশতীর স্ত্রী রুজী চিশতী ও ব্যাংকের এসইভিপি ও গুলশান শাখার সাবেক ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন। এরই মধ্যে রুজী চিশতী হাইকোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন নিয়েছেন। চিশতীও জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভুয়া সনদ জোগাড় করেছেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন পদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, চিশতী জামিনে মুক্ত হলে মামলার তদন্তে প্রভাব বিস্তার করবেন। ব্যাংকে সংরক্ষিত মামলার আলামত নষ্ট করার তৎপরতা চালাবেন। এতে মামলার তদন্ত কার্যক্রম দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

সূত্র জানায়, চিশতী ও বিতর্কিত ওই শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে হাতে হাত মিলিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি করেন। ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এই পর্যায়ে দুদক চিশতীর অনিয়ম, দুর্নীতি অনুসন্ধান করে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। মামলাটির তদন্ত পর্যায়ে চিশতীর অর্থ আত্মসাতের আরও তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। 
দুদক সূত্র জানায়, ব্যাংকটির গুলশান শাখায় চিশতীর হিসাবে বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের হিসাব থেকে নগদে ও পে-অর্ডারের মাধ্যমেও অর্থ জমা হয়। একই শাখায় চিশতীর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ের নামে খোলা ২৫টি হিসাবেও নগদে ও নানাভাবে অর্থ জমা হয়। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবগুলোতে মোট ১৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে ওই টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪নং ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 

দুদকের মামলায় ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী কাউকে আসামি করা হয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের মানুষ কমিশনের নেতিবাচক সমালোচনাও করেছেন। 

ব্যাংকটির পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতি, ঋণের কমিশন নেওয়া, গ্রাহকের হিসাব থেকে নিজের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর ও অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি এই ব্যাংকে ঋণ অনিয়ম, জালিয়াতি, সন্দেহজনক লেনদেন, ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে উঠে আসে। কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ায় অবশেষে তোপের মুখে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদত্যাগ করেছেন। 

চিশতীসহ সংশ্নিষ্ট ১৭ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীর এই নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত। 
  • Somokal/may12 2018

No comments:

Post a Comment