আহমেদ জায়িফ
বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল যখন গাড়িচালক আশরাফ আলীকে ধরে নিয়ে যায়, তখনো দিব্যি সুস্থ তিনি। কিন্তু ঢাকার মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে এক দিন ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করার পরই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়ার তিন ঘণ্টা পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর শরীরজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। স্বজনেরা বলছেন, ডিবি পুলিশের মারধরেই আশরাফের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬ মে বিকেলে আশরাফের মৃত্যুর পর তাঁর পরিচয়, কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এসব বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে চাননি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। উল্টো হাসপাতালে ভর্তির সময় আশরাফের পরিচয় গোপন করতে নাম লেখা হয় ‘আসলাম’। এ ছাড়া ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে চিকিৎসকের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু আশরাফের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকায় ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, গাড়িচালক আশরাফের (৪২) বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার চরপাকের দহন গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। তাঁর তিন স্ত্রী। ছোট স্ত্রীকে নিয়ে গাজীপুরের মির্জাপুরের পশ্চিম ডগরি এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন। ‘ডেকর ওয়েট প্রসেসিং লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানির কাভার্ড ভ্যান চালাতেন তিনি। ৪ মে মধ্যরাতে আশরাফ, তাঁর স্ত্রী রিপা ও দুই সন্তানকে ওই বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি। আশরাফ একসময় আশুলিয়া এলাকায় ডিবির তথ্যদাতা (সোর্স) হিসেবেও কাজ করতেন বলে স্বজনেরা জানান। তুলে নিয়ে যাওয়ার ৩৮ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান আশরাফ।
হেফাজতে থাকা অবস্থায় সুস্থ আশরাফের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ামুল নামের কাতারপ্রবাসী এক নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলেন আশরাফ। মুঠোফোন নম্বর ধরে তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতে আশরাফ ও তাঁর স্ত্রীকে তাঁরা ডেকে আনেন। একপর্যায়ে আশরাফ অসুস্থ বোধ করেন। তখন তাঁর স্ত্রী ডিবিকে জানান, আশরাফ হার্নিয়া রোগী। হাসপাতালে নেওয়ার পর একপর্যায়ে তিনি মারা যান।
মৃত ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্নের বিষয়ে আবদুল বাতেন বলেন, ‘আপনি বললে তো হবে না। ময়নাতদন্ত হবে। সেখান থেকে জানা যাবে কী হলো।’ হাসপাতালে ভর্তির সময় আশরাফের নাম কেন ‘আসলাম’ লেখা হলো, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাঁর আসল নাম কী আপনারা জেনে নিন।’
নিয়ামুল নিখোঁজের ঘটনাটি তদন্ত করছিলেন ঢাকা মহানগর ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মাহমুদ নাসের। আশরাফের বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
ময়নাতদন্তের পর আশরাফের লাশ তাঁর ভাই আবদুর রশিদের কাছে হস্তান্তর করেন ডিবির সদস্যরা। আশরাফের শরীরের আঘাতের চিহ্নের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘সারা শরীরে মাইরের দাগ ছিল। এ রকম মারলে কেউ বাঁচার কথা না।’
আশরাফ সুস্থ ছিলেন
গাজীপুরের পশ্চিম ডগরি এলাকার আবদুল হালিমের বাড়িতে থাকতেন আশরাফ। গত ২২ এপ্রিল সেখানে ওঠেন তিনি। ৯ মে বাড়ির মালিক এবং অন্য ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বাড়ির মালিক আবদুল হালিম বলেন, সেদিন (৪ মে) রাত একটার দিকে দুটি গাড়িতে করে ডিবির ১৫-২০ জন সদস্য আসেন। তাঁরা সব ভাড়াটের কক্ষে তল্লাশি চালান। আশরাফের কক্ষে গিয়ে আশরাফ ও তাঁর স্ত্রীর চোখ বেঁধে ফেলেন। তাঁকে কিছুক্ষণ মারধর করা হয়। ডিবি নিয়ে যাওয়ার সময় আশরাফ স্বাভাবিকভাবেই হাঁটছিলেন।
আশরাফের ভাড়া বাসার কাছেই তাঁর কর্মস্থল। তিনি যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালাতেন, তার পরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে আশরাফ তাঁদের গাড়ি চালান। এর মধ্যে কখনো অসুস্থতার কথা বলেননি, ছুটিও নেননি তিনি।
আশরাফের রোগ থাকার কথা পুলিশ বললেও তাঁর ভাই আবদুর রশিদ জানান, আশরাফের কোনো রোগ থাকার কথা তাঁরা জানতেন না।
সুরতহালে আঘাতের চিহ্নের প্রকৃত বর্ণনা নেই
আশরাফের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন সংগ্রহ করে দেখা যায়, স্বজনদের বর্ণনা অনুযায়ী তাঁর শরীরের আঘাতের বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। তাঁর দুই হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পুরোটাই রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। তাঁর ভাই আবদুর রশিদ ও দ্বিতীয় স্ত্রী নাসিমার বর্ণনামতে, শরীরের অন্যান্য স্থানেও ছিল আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হরিচাঁদ হাজরা ও মোশাররফ হোসেন লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে এসবের কিছুই উল্লেখ করেননি। আঘাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁরা শুধু লিখেছেন, ‘দুই পায়ে হালকা কালচে দাগ পরিলক্ষিত হয়েছে।’
৭ মে সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আশরাফের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়। কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের তিন সদস্যের বোর্ড ময়নাতদন্ত করে। সোহেল মাহমুদ বলেন, মৃত ব্যক্তির দুই পায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাঁর পেটে নাড়ি পেঁচিয়ে ছিল। ভিসেরা পরীক্ষার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
পরিবারের সদস্য ও লাশবাহী গাড়িকে ডিবির পাহারা
আশরাফের লাশ নিতে ৭ মে সকালে তাঁর ভাই আবদুর রশিদ উত্তরা থেকে এবং বড় দুই স্ত্রী আশুলিয়া থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন। তাঁদের আসার তথ্য জেনে ডিবির কয়েকজন সদস্য হাসপাতালে আসেন। পরে তাঁদের মাইক্রোবাসে তুলে মিন্টো রোডে ডিবির কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবদুর রশিদ বলেন, ডিবির ‘বড় বড়’ কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। খাওয়াদাওয়া করান। এরপর বেলা দুইটার দিকে তাঁকে এবং আশরাফের তৃতীয় স্ত্রী রিপার বাবাকে ডিবির গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত আটটা পর্যন্ত হাসপাতালের বাইরে ডিবির সদস্যদের সঙ্গে তাঁরা ওই গাড়িতে ছিলেন। তিনি বলেন, কিছু কথা লেখা আছে এমন একটি কাগজে এবং একটি সাদা কাগজে ডিবির সদস্যরা তাঁর সই নেন। এরপর আশরাফের লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
আবদুর রশিদ বলেন, ডিবির সদস্যরা তাঁদের সামনেই ছয় হাজার টাকা দিয়ে একটি মাইক্রাবাস এবং সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। এর একটিতে লাশ অন্যটিতে তাঁদের উঠিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলেন তাঁরা। ডিবির সদস্যরাও একটি গাড়িতে করে তাঁদের সঙ্গে রওনা হন। গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ডিবির গাড়ি তাঁদের অনুসরণ করে।
নিখোঁজ কাতারপ্রবাসী
২৬ এপ্রিল রাতে রাজধানীর শাহ আলী থানায় নাজমুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি তাঁর ভাই নিয়ামুল হোসেন নিখোঁজ হয়েছেন বলে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিটি তদন্ত করছিলেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অনুজ কুমার সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জিডির বর্ণনা অনুযায়ী নিয়ামুল মিরপুর ১ নম্বরে তাঁর চাচাতো বোনের বাসায় বেড়াতে যান। ২৫ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ওই বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে তিনি নিখোঁজ।
এসআই অনুজ কুমার বলেন, ৩০ এপ্রিল ডিবির এডিসি মাহমুদ নাসের তাঁর কাছ থেকে নিয়ামুলের মুঠোফোনের কললিস্টসহ অন্যান্য তথ্য নেন। এরপর তিনি আর কোনো তদন্ত করেননি।
এদিকে আশরাফের মৃত্যুর পর ৬ মে রাতে শাহ আলী থানায় অপহরণের মামলা করেন নিখোঁজ নিয়ামুলের ভাই নাজমুল হোসেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, মামলায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। নিয়ামুলের মুক্তিপণ বাবদ ১০ লাখ টাকা চাওয়ার তথ্য উল্লেখ করেছেন বাদী।
আশরাফের অপরাধ
নিয়ামুলের ভাই নাজমুল বলেন, আশরাফ আসলে তাঁর ভাইকে অপহরণের ঘটনা সম্পর্কে জানতেন না। প্রতারণা করার জন্য ফোন করে দাবি করেছিলেন, নিয়ামুল কোথায় আছেন, তা তিনি জানেন। তিনি মুক্তিপণও চেয়েছিলেন।
আশরাফকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর বাবা মো. খলিল কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এই প্রতিবেদক আশরাফের তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এটি এখন সম্ভব নয়।
আশরাফের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না পরিবার। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নাসিমা বলেন, অপরাধ করে থাকলে আশরাফের বিচার হতে পারত। তা না করে পিটিয়েই আশরাফকে মেরে ফেললের ডিবি পুলিশ।
- Source — প্রথম আলো/ শনিবার, মে ১২, ২০১৮।
No comments:
Post a Comment