উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হোক
৭ শতাংশের উপরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আজকাল খুব হইচই হচ্ছে। কেউ কেউ হিসাব করছেন, এ হারে জিডিপি বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যেই উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে। এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছোট হলেও এর জনসংখ্যা ১৬ কোটি, তাই মোট আয়ের বিচারে এর জায়গা বিশ্বের অনেক দেশের উপরে থাকবে।
শুধু মাথাপিছু আয় বা জিডিপির দিকে তাকালে বাংলাদেশের অনগ্রসরতার পুরো চিত্রটি পাওয়া যাবে না। মাথাপিছু আয় একটি গড় হিসাব মাত্র। দেশের দুই কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, যাদের দৈনিক আয় ১ ডলারের নিচে। সভ্যজগতের উপযুক্ত অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও তাদের মিলছে না। উপরতলার একটি শ্রেণী প্রবৃদ্ধির সুবিধা উপভোগ করে ফুলেফেঁপে উঠছে।
শহরে প্রকৃত মজুরিহার মোটের ওপর বেড়েছে সত্য, কিন্তু সত্যিকারে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে একেবারে উপরের ভাগে। আর সব থেকে নিচের ভাগে প্রকৃত মজুরি প্রায় বাড়েনি বললেই চলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গেল কয়েক বছরে প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। ফলে এ কথা স্পষ্ট, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আলো দেখা গেলেও তা এখন পর্যন্ত মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে আলোকিত করছে, বাকিরা যে তিমিরে ছিল, আজো সেই তিমিরে। ইতিহাস বলছে, দেশে যত উন্নতি ঘটে, তত ছোট হয়ে আসে কৃষিক্ষেত্র। জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে ছোট হয়ে আসে, আবার কর্মসংস্থানের দিক থেকেও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকে। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোয় কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকের অনুপাত মোট কর্মসংস্থানের ২-৪ শতাংশের বেশি নয়।
আমাদের সমস্যাটা এখানেই, আমাদের জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে কৃষির অবদান কমে এলেও মোট শ্রমিকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, শ্রমিকদের একটি বড় অংশ উন্নয়নের চৌহদ্দির বাইরে কৃষিক্ষেত্রে রয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রবৃদ্ধির হার নিতান্তই শ্লথ। বস্তুত বাংলাদেশের জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। এছাড়া আছে গার্মেন্টস ও কৃষি। অনানুষ্ঠানিক খাতের ভূমিকাও কম নয়। অথচ এসব ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের আয় এবং জীবনের নিরাপত্তা দুটিই অনিশ্চিত। দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়লে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বড় দেখায়, জিডিপি বাড়ে।
উপযুক্ত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-স্বাস্থ্যসেবা জুগিয়ে দেশের পিছিয়ে পড়াদের নতুন পরিবর্তনের উপযোগী করে তুলতে হবে। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা যদি অর্থনীতির সব দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকি, তাহলে কিছুই বদলাবে না।
কিছু ব্যক্তি রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে অর্থনীতির সুফল ভোগ করে যাবে, যেমন অতীতে হয়েছে, আর বাকিদের বিশেষ করে গরিবদের অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যাবে— সে স্থবিরতা আমাদের কাম্য নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ভালো হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, কৃষক-শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না।
নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ভালো হওয়া মানে দেশের বেশির ভাগ মানুষের কল্যাণ হচ্ছে— এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সম্প্রতি দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) আয়োজিত এক সেমিনারে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির পেছনে উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি ও অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে।
জনগণের জীবনমান উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় বৈষম্য। যেসব নীতি ও ব্যবস্থার ফলে সমাজে বৈষম্য কমে আসতে পারে, তা কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন— সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, শহর ও গ্রামের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা। সর্বব্যাপী দুর্নীতি বৈষম্যকে আরো প্রকট করেছে। এসব নিয়ে সরকারি, বেসরকারি, জাতীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে যেতে পারে, দারিদ্র্য বিমোচনের গতি রুদ্ধ না হলেও ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা এবং সর্বোপরি সামাজিক সংহতি ও শান্তি বিনষ্ট হতে পারে। এসব কারণে সব পর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরা যায়। সেক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পরিবর্তন আনা জরুরি।
- Courtesy: Editorial/ BanikBarta/ May 07, 2018
No comments:
Post a Comment