নাটোরের লালপুরে অবৈধ ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে সর্বস্বান্ত নয় গ্রামের অন্তত ৬০০ আমবাগান মালিক। অপরিপক্ব আম নিচের অংশ পচন ধরে শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগ প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে।
কয়েক’টি আক্রান্ত বাগান ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যেকটি গাছের নিচে নষ্ট আম পড়ে আছে। গাছে ঝুলছে অর্ধেক পচা আম। বাগান মালিকরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে এ এলাকায় আমের আকার ছোট হয়ে আসছিল, কিন্তু এভাবে মড়ক ধরেনি। নাটোরের লালপুর উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের বিশম্ভরপুর, মমিনপুর বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের মহরকোয়া, রহিমপুর, প্রধানপাড়া, আড়বাব ইউনিয়নের অমৃতপাড়া, ঘোষপাড়া, আকবরপুর ও কৃষ্ণরামপুরসহ মোট নয়টি গ্রামের ছয় শতাধিক বাণিজ্যিক আমবাগান আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ইটভাটার কাছাকাছি বসতবাড়ির আমগাছগুলোও রক্ষা পায়নি।
চাষীদের অভিযোগ, আধা কিলোমিটারের মধ্যে আটটি অবৈধ ইটভাটার কারণে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন তারা। মৌসুমের মাঝামাঝি এসে এ বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
বাগান মালিকরা জানান, প্রথমে আমের নিচের অংশে কালো হয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই সেটি শুকিয়ে একসময় ঝরে পড়ছে। কোনো কীটনাশকেও যখন কাজ হয়নি, তখন তারা কৃষি অফিসকে জানান। ১০-১২ দিন আগে তারা এসে নমুনা নিয়ে যান।
উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, আমচাষীদের অভিযোগ পেয়ে নমুনা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক আম গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। পরীক্ষা শেষে পাঠানো প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইটভাটার ধোঁয়া ও গ্যাসের কারণে ‘ব্ল্যাক টিপ’ নামের রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে আবাসিক এলাকা ও বাগানের আশপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকা ভাটা স্থানান্তরসহ বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মহরকোয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিক ওবায়দুর রহমান বলেন, ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় একটি বাগান কিনেছিলেন। কিন্তু সব আম পচে ঝরে যাচ্ছে। অন্যান্য বাগানেরও একই অবস্থা। ঘোষপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিক এনামুল হক গত বছরও এমন ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। তখন বুঝতে পারেননি যে, এর জন্য ইটভাটাই দায়ী। এবার যখন বুঝতে পেরেছেন ততক্ষণে সব শেষ!
আমবাগান লিজ নিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী। কামরুল ইসলাম নামে এমন এক ব্যবসায়ী বলেন, আমার মতো অনেক ব্যবসায়ীর ৫-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। এবার সব পুঁজি চলে যাবে।
এদিকে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের দাবিতে স্থানীয় লোকজন ও আমবাগান মালিকরা একাধিকবার মিছিল, মানববন্ধন করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, ইউএনও বরাবর অভিযোগও দেয়া হয়েছে। তবে ভাটার মালিকরা দায় নিতে রাজি নন। এ বিষয়ে ভাটামালিকরা কথা বলতেও রাজি হননি। ভাটামালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নঈম উদ্দিন সেন্টুর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দাবি করেন, শিলাবৃষ্টির কারণে আমের ক্ষতি হয়েছে। এতে ভাটার কোনো সম্পর্ক নেই। লোকজন এভাবে মিছিল-মিটিং মানববন্ধন করে কিছুই করতে পারবে না!
ভাটার ধোঁয়ার কারণে আমের ক্ষতির তথ্য নিশ্চিত করে লালপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, লালপুর উপজেলায় অন্তত ২৬টি ইটভাটা রয়েছে, সবক’টিই অবৈধ। এগুলোর কারণে আগামী দিনে কৃষিতে আরো বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি জানান, লালপুরে ১ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৮০ টন। কিন্তু ভাটার কারণে ৮৭ হেক্টরের আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ৮৭০ টন আম কম উৎপাদন হবে। প্রাথমিকভাবে ৬০০ ক্ষতিগ্রস্ত চাষীকে শনাক্ত করা হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ২ কোটি টাকা।
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে কৃষি বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে জানিয়ে লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, এখানে সব ইটভাটাই অবৈধ। অবৈধ ভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনও।
- কার্টেসিঃ বনিক বার্তা/ মে ২১,২০১৮
No comments:
Post a Comment