আইএলওর প্রতিবেদন
বদরুল আলম
দেশে মোট কর্মসংস্থানের ৭৫ দশমিক ২ শতাংশই অরক্ষিত। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ মূলত আত্মকর্মসংস্থান। বাকি ২২ দশমিক ৬ শতাংশ হচ্ছে পারিবারিক কর্মসংস্থান। অরক্ষিত ও অনানুষ্ঠানিক এসব কর্মসংস্থানে নিযুক্তদের দায়িত্ব কম, আয়ের নিরাপত্তাও কম। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আইএলও গত সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল আউটলুক ২০১৮: গ্রিনিং উইথ জবস শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জেনেভা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির বাংলাদেশ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাক্ট শিটস অংশে দেশে কর্মসংস্থানের গতি-প্রকৃতির চিত্র উঠে এসেছে। ফ্যাক্ট শিটসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে মোট জনগোষ্ঠীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ। আর কর্মক্ষম জনসংখ্যা অনুপাতে কর্মসংস্থানের হার ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বেকারত্বের হার ৪ শতাংশ। এর মধ্যে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ।
আইএলও বলেছে, কর্মসংস্থানের বিষয়টি প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। কৃষি, মত্স্য, বনজ সম্পদ, পর্যটন ইত্যাদি খাত এবং ওষুধ, বস্ত্র, খাদ্য ও পানীয় শিল্পে কর্মসংস্থান পুরোপুরিই স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু রূপান্তরের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। এ কারণে প্রতি বছরই তীব্র গরম ও দাবদাহের ব্যাপ্তি বাড়ছে। এভাবে কাজের অনুপযোগী দিনের সংখ্যা আগামী দিনগুলোতেও বাড়তে থাকবে। কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে, অর্থনৈতিক উন্নতির সুবাদে সৃষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগগুলো পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে হারিয়ে যাবে। এ কারণেই কর্মসংস্থানের জগতটি পরিবেশগত বিচারে টেকসই করা জরুরি বলে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থাটি উল্লেখ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় চার কোটি পূর্ণকালীন কর্মীর উৎপাদনশীলতা বার্ষিক ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হারে কমবে। কৃষি খাতে এর প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। তাপমাত্রা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের কৃষকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আইএলও ফ্যাক্ট শিটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের কর্মসংস্থান কৃষি ও সেবা খাতে ৪০ শতাংশের কিছু বেশি। আর শিল্প খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে ২০ শতাংশের। দক্ষতার মান বিচারে উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন কর্মসংস্থান ২০ শতাংশেরও কম। মাঝারি দক্ষতার কর্মসংস্থান ৬০ শতাংশের কিছু বেশি। আর নিম্ন দক্ষতার কর্মসংস্থান ২২ শতাংশের মতো।
দেশের টেকসই কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আলোকপাত করতে আইএলও পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় নিয়েছে। এর মধ্যে আছে— পরিবেশ কর্মসংস্থান, দক্ষতার মাত্রা, কাজের দুর্বলতা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কর্মসংস্থান এবং পরিবেশগত পারফরম্যান্স সূচক। সংস্থাটি জানিয়েছে, পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির অনুকূল নীতি বাস্তবায়ন হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীর অঞ্চলে ১ কোটি ৪০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হবে। এগুলো হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং টেকসই নির্মাণ, উৎপাদন ও কৃষি খাতে।
আইএলওর উপমহাপরিচালক ডেবোরাহ গ্রিনফিল্ড বলেছেন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও সেবার ওপর নির্ভর করে। সবুজ বা পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি লাখো মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বেরোনোর পথ দেখাতে পারে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবিকাও নিশ্চিত করতে পারে।
দেশে অরক্ষিত কর্মসংস্থানের কথা এসেছে সরকারের শ্রমশক্তি জরিপেও। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী, কর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত। কৃষি খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৯৫ দশমিক ৪, শিল্প খাতে ৮৯ দশমিক ৯ এবং সেবা খাতে এখনো ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মী অনানুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট সোস্যাল আউটলুক ট্রেন্ডস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অরক্ষিত শ্রম খাতে আলোকপাত করে আইএলও। সেখানে বলা হয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় কর্মসংস্থানে অপ্রাতিষ্ঠানিকতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে, যা দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারত, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও নেপালে প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিকই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এসব দেশে নির্মাণ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, আবাসন এবং খাদ্য সেবা শিল্পের মতো অকৃষি খাতগুলোতেও অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের প্রবণতা ব্যাপক।
আইএলওর ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৭৫ শতাংশের উপরে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান রয়েছে নেপাল, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে। অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা তিনটি দেশ হলো নেপাল, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসংস্থানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। মূলত দেশে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কর্মসংস্থান যা হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে যতটা প্রবৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটা হয়নি বলে তারা জানান।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. বরকত ই খুদা বলেন, আইএলওর প্রতিবেদনের তথ্য সঠিক এবং এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ এবং আমাদের মতো অন্য দেশগুলোয় এ অবস্থা বিরাজ করছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ মানেই হলো কাজটি ডিসেন্ট বা শোভন না। এ ধরনের কাজের কোনো নিরাপত্তা নেই। মজুরি কাঠামোও প্রযোজ্য হয় না এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে। কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা, অবসর ভাতার মতো বিষয়গুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নেই। এ ধরনের কর্মসংস্থানে নিযুক্তদের শিক্ষার হার ও মান ভালো না। আবার এদের উৎপাদনশীলতাও সীমিত। এ কারণে অর্থনীতিতে এদের অবদান কম। অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আমরা যদি শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারি, তাহলে অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাওয়া সম্ভব।
আইএলওর প্রতিবেদনের চিত্র বাংলাদেশ ও অন্য দেশগুলোর জন্য বিপজ্জনক মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন সাধারণ শিক্ষার চেয়ে পেশাগত-কারিগরি শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমরা যদি দক্ষতা বাড়াতে পারি, তাহলে শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে অর্থনীতির গতিশীলতা অনেক বাড়াতে পারব।
- কার্টেসিঃ বনিক বার্তা/ মে ২১,২০১৮
No comments:
Post a Comment