সম্পাদকীয়
আমদানিনির্ভরতা হ্রাসে উদ্যোগ নিন
অনেক বছর ধরে জ্বালানিসামগ্রীর দাম বিশ্ববাজারে বলা চলে সহনীয় পর্যায়ে আছে। সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা বাড়লেও বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেনি। তাই বলে তেলের দাম কম থাকার সুবিধা বাংলাদেশের ভোক্তারা সেভাবে পায়নি। না পাওয়ার কারণ সরকার কম দামে বিদেশ থেকে তেল কিনলেও ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে। এর জন্য সরকার অতীতের লোকসানের দোহাই দিলেও তা কতটা গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। ডলারের দাম বাড়ার প্রবণতাসহ নানা নেতিবাচক প্রভাবের কথা ভেবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবার জ্বালানি খাতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছে। তাই শঙ্কা থেকেই সরকার আবার জ্বালানির দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
সরকারের এই ভাবনা সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। জ্বালানি খাতে যে পুকুরচুরি হচ্ছে, সেটি বন্ধ করলেই এর চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয় করতে পারে সরকার। কিন্তু সেই দুরূহ পথে না গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হয়তো দাম বাড়িয়ে লোকসানের দায় ভোক্তাদের ওপর চাপানোর সহজ উপায় খুঁজছেন। বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে যে বিশ্ববাজারে তেল ও ডলারের দাম বাড়লেও যাতে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি খাতের স্থিতি নষ্ট না হয়। অন্যদিকে জ্বালানির দাম যে অনির্দিষ্টকাল সহনীয় অবস্থায় থাকবে, তা–ও ধরে নেওয়া সমীচীন হবে না। অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক স্থিতির সঙ্গে জ্বালানি তেলের দামের নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জ্বালানির দাম কমার পর সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকা (২০১৪-১৬) মুনাফা করলেও জনগণ তা থেকে প্রত্যক্ষ সুবিধা পায়নি। এমনকি সরকার দেশীয় জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে ঔদাসীন্য দেখিয়েছে।
অথচ কাজ কী কী করতে হবে, তা অনেক আগেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। যেমন কারও অজানা ছিল না যে বাংলাদেশ তেলসম্পদ আহরণে সুবিধা করতে পারবে না। তাকে গ্যাস ও কয়লা সম্পদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। বাপেক্স শতাধিক কূপ খননের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিল অনেক আগেই। গ্যাসের মজুত যে তলানিতে ঠেকতে পারে, তা–ও অজানা ছিল না। সমুদ্রে গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ আহরণে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল; যদিও তার কোনো লক্ষণ নেই। কয়লা সম্পদনির্ভর কয়েকটি প্রকল্প নিকট ভবিষ্যতে চালু হবে। কিন্তু তা থেকে প্রাক্কলিত জ্বালানি চাহিদা মিটবে না। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, অনেক দেশ তার অভ্যন্তরীণ জ্বালানি চাহিদার সিংহভাগ আমদানি করেও দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে পেরেছে। সুতরাং ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নিজস্ব সামর্থ্য বাড়ানো সম্ভব না হলে বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারের কোনো আকস্মিক দুর্বিপাকে কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। বাপেক্সের দক্ষ জনবল নেই এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকেরা ওয়াকিবহাল এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরিকল্পনাও চূড়ান্ত। কিন্তু মুশকিল হলো, বছরের পর বছর যায়, বাস্তবে কিছুই ঘটে না। রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে যৌথ উদ্যোগের কথা আলোচিত হলেও তার অগ্রগতি ঘটছে না।
সরকারকে ধরে নিতে হবে যে জ্বালানি তেল ও ডলারের মূল্য যদিও এ মুহূর্তে বড় ধরনের বৃদ্ধির পূর্বাভাস নেই, কিন্তু এটা ঘটতে কতক্ষণ! তাই জ্বালানি সম্পদের অনুসন্ধান ও আহরণকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আলসেমি বা গাফিলতি মার্জনা করা যাবে না। নির্বাচন সামনে রেখে সরকার তেলের দাম আপাতত না বাড়ালেও ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ বাড়াতে না পারার দায়ে কারা অভিযুক্ত, সেটা চিহ্নিত হওয়াও দরকার।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ০৭ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment