ঢাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কায় রয়েছে নগরবাসী।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ মানুষের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার কিছু বিধিমালা নির্ধারণ করে দিলেও তার কোন প্রয়োগ নেই ভবনগুলোতে।
সেটারই প্রতিফলন পাওয়া যায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে।
তারা মূলত ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিং মল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দুই হাজার ৬১২টি ভবনের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে।
সেখানে মাত্র ৭৪টি ভবন ছাড়া বাকি সবকটি ভবন, অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে।
ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীতে কেনাকাটার জন্য বেশ জনপ্রিয় বনানী সুপার মার্কেট। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে প্রায় কিছুই নেই।
প্রতি তলায় একটি করে মাত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশার। তাও সেটা একেক তলায় একেক স্থানে রাখা হয়েছে। যেটা অনেক সময়ই চোখেই পড়েনা।
মার্কেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ জসিম দুটি অগ্নি বহির্গমন বা ইমার্জেন্সি এক্সিট সিঁড়ি দেখিয়ে দেন।
কিন্তু এই সিঁড়ির জন্য কোন পথ ধরে যেতে হবে সেটা নিয়ে কোথাও কোন নির্দেশনা নেই।
এছাড়া সিলিংয়ে বৈদ্যুতিক তারগুলোকে এমন খোলা ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখা যে যেকোনো সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
এক্ষেত্রে এই ভবনটিতে যদি আগুন লাগে তাহলে নিরাপত্তার উপায় কি?
এ বিষয়ে জানতে কথা বলেছিলাম মার্কেটটির সিকিউরিটি সুপারভাইজার মোহাম্মদ জসিমের সঙ্গে।
তিনি জানান যে, ভবনে আগুন লাগলে কি করতে হবে সে বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারা।
আগুন ধরতে দেখলেই তিনিসহ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সবাই বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন এবং ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে আগুন নেভান।
কিন্তু এতো বিশাল পরিধির একটি মার্কেটে এতো সীমিত ফায়ার এক্সটিংগুইশার কি যথেষ্ট?
তাছাড়া ভবনের কেন্দ্রীয় সতর্কতা অ্যালার্মটি রয়েছে ছাদের কাছে। তাই ওপরের কোন তলায় আগুন ধরলে অ্যালার্ম বাজানো হবে কিভাবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে মিস্টার জসীম বলেন, তাদের চেষ্টা থাকে যা আছে সেটা দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেয়া।
তারসঙ্গে কথা বলার মধ্যেই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে এগিয়ে আসেন বনানী সুপার মার্কেটের ব্যবস্থাপক গাজী মতিউর রহমান।
এতো জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ভবনের এই বেহাল দশা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
"এই স্থানটিতে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন, মার্কেট কর্তৃপক্ষসহ তিনটি পক্ষ কাজ করছে। মার্কেটটি এখনও নির্মাণাধীন, তাই কিছু সমস্যা রয়ে গেছে"
কিন্তু এই সময়ের মধ্যে যদি কখনও আগুন লাগে তাহলে সেটা মানুষের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে তিনি স্বীকার করেন।
একই চিত্র ঢাকার প্রায় বেশিরভাগ ভবনের। ঢাকায় অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি কেন এতো উপেক্ষিত?
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের শামীমা প্রধান বলেন, "যখন আমরা কোন ভবন নির্মাণ করি, তখন আমরা এই অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টিকে আমলে নেই না। এটা আমাদের প্র্যাকটিসের সমস্যা। আমাদের সচেতনতা না থাকার সমস্যা। কোন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যতক্ষণ না কারও জীবনে ঘটছে, তার আগ পর্যন্ত কেউ সচেতন ভূমিকা রাখছেন না।"
ঢাকার নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সেইসঙ্গে পুরানো ভবনগুলোয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন না করলে যেকোনো মুহূর্তে ঢাকা ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়তে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মহা পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ।
এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান তিনি।
জেনারেল আলী আহমেদ বলেন, "বাংলাদেশে একটা সংস্কৃতি আছে যে কোন বড় ধরণের দুর্যোগ না হলে সচেতনতা সৃষ্টি হয়না। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ভবন, বিশেষ করে পুরানো ভবনগুলোর অবস্থা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।"
"আমরা এই বিষয়গুলোকে আইনের আওতায় এনেছি। মোবাইল কোর্ট করেছি। পেনাল্টিও দিয়েছি। অনেক ভবন কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে সময় চেয়েছে। আমরাও তাদের সময় বেঁধে দিয়ে চাপে রেখেছি। "
তবে এ ব্যাপারে ভবন মালিকদের পাশাপাশি সাধারণ পর্যায়ে প্রতিটি মানুষকে যার যার নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জেনারেল আলী আহমেদ।
- বিবিসি বাংলা/ ১৪ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment