বখতিয়ার আহমেদ
মাইদুল ইসলাম
১৯২৮ সালে, ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির মালিকানাধীন ইতালিতে, বিপ্লবী আন্তনিও গ্রামসিকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর যুক্তি হিসেবে সরকারি কৌঁসুলি (পাবলিক প্রসিকিউটর) বলেছিলেন, ‘ওনার মগজের কাজকারবার ২০ বছরের জন্য থামিয়ে রাখা দরকার।’
১৯২৮ সালে, ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির মালিকানাধীন ইতালিতে, বিপ্লবী আন্তনিও গ্রামসিকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর যুক্তি হিসেবে সরকারি কৌঁসুলি (পাবলিক প্রসিকিউটর) বলেছিলেন, ‘ওনার মগজের কাজকারবার ২০ বছরের জন্য থামিয়ে রাখা দরকার।’
১৯২৬ সালে গ্রেপ্তার হওয়া এই কুঁজো কমিউনিস্টকে মুসোলিনির আদালত ১৯২৮ সালে ঠিক ২০ বছরের সাজাই দিয়েছিলেন, প্রচলিত আইনকানুনকে প্রায় কাঁচকলা দেখিয়ে।
গ্রামসি ২০ বছর বাঁচেননি। পরের ১১টা বছর এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে, জটিল সব অসুস্থতার চিকিৎসা না পেয়ে, ১৯৩৭ সালে, ৪৬ বছর বয়সেই মরে যান তিনি।
মরার আগে গ্রামসির এই ‘অপরাধী মগজ’ তিরিশটা খাতা আর হাজার তিনেক পৃষ্ঠার খোলা কাগজে নিজের চিন্তাগুলো ইতস্তত লিখে রাখছিল। সেই খাতা আর পাতাগুলো গোপনে কারাগার থেকে বাইরে চলে আসে গ্রামসির বোনের উদ্যোগে। ১৯৫০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর ‘কারাগার ডায়েরিগুলো’। ১৯৭০ সালে প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। আর তিনি হয়ে ওঠেন গত শতকের সবচে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তুকদের একজন।
কারাগার কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য গ্রামসি প্রচলিত মার্ক্সীয় পরিভাষাগুলো এড়িয়ে যেতেন। তা করতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি মার্ক্সীয় চিন্তার কিছু গোড়ার গলদেই হাত দিয়ে ফেলেছেন। মানুষকে অর্থনৈতিক জীব ধরে নিয়ে চিন্তা করার ছক থেকে বেরিয়ে তার চৈতন্যগত সত্তা নিয়ে ভাবার ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছেন।
মুসোলিনির স্বৈর-সন্ত্রাসের নির্মম ক্ষত শরীরে নিয়েও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে তিনি নিপীড়নকে না, চিহ্নিত করলেন স্বৈরশাসনকে স্বাভাবিক আর অনিবার্য ভাবার পাবলিক কমনসেন্সকে।
গ্রামসিরও ৪০০ বছর আগে ফরাসি চিন্তুক আতিয়েনে দে লা বোয়েতিও একই মীমাংসায় আসছিলেন যে পাবলিকের আনুগত্যপ্রবণ ননসেন্স কমনসেন্স শুধু স্বৈরতন্ত্রের উর্বর জমিই না, সঙ্গে সার-পানি-কীটনাশক হিসেবে কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী কাঁটা ওপড়ানোর কাজেও লাগে। আমজনতার প্রশ্নহীন আনুগত্য কিংবা নিরাসক্তি স্বৈরশাসনাকুল পরিস্থিতি তৈরি করে যেকোনো শাসনকেই স্বৈরতন্ত্র করে তুলতে পারে।
১৯৪৯ সালে লেখা ‘কমিউনিজমবিরোধী’ লেখক জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘১৯৮৪’-তে স্বৈরাচারসেবী পাবলিকের গণগান্ডুগিরির একটা গা শিউরানো গল্প আছে। বিগ ব্রাদারের শ্বাসরোধ করা শাসনে অরওয়েল কল্পিত রাষ্ট্র ইউরেশিয়ার এক সরকারদলীয় কর্মী ঘুমের ঘোরে গালি দিয়েছিলেন বিগ ব্রাদারকে। তার আদরের মেয়ে, সরকারের কিশোর ব্রিগেডের নিবেদিত কর্মী, সেটা শুনতে পেয়ে ‘চিন্তা পুলিশে’র হাতে ধরিয়ে দেয় বাবাকে। চিন্তা পুলিশ তাকে ধরে চিরতরে গুম করে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যায় প্রতিবেশীর সঙ্গে। তার কাছে বিগ ব্রাদারের প্রতি নিজের মেয়ের আনুগত্য, যেটা নিজের বাপকেও ছাড় দেয় না, তা নিয়ে ব্যাপক গর্ব করে মরার জন্য রওনা দেয় এই লোক।
এত কিছু এখন মাথায় আসছে শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাসে সরকারের সমালোচনার দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুলকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার খবর শুনে। কিছুতেই নিজের মাথার ভেতর এসব ‘ক্রাইম থিংকিং’ ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ততোধিক একজন পাবলিক শিক্ষক হিসেবে আমি ক্লাস নিচ্ছি, নির্বিকারভাবে কাজ করছি, যেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ডজন শিক্ষক সমিতি–করা কয়েক হাজার শিক্ষক মাইদুলকে নিয়ে নীরব। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই আছেন স্বাভাবিক কর্মতন্দ্রায়। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরক্ষার মধ্যে থেকে চিন্তার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পাওয়া শিক্ষকেরা যখন সুযোগ-সুবিধার আরামের লোভে কিংবা আরাম হারাম হওয়ার আশঙ্কায় স্বেচ্ছায় বিবেককে ঘুম পাড়ান, তখন বুঝতে হয় যে সমস্যার শিকড় শুধু সরকার কিংবা শাসনপ্রণালিতে না, স্বৈরতন্ত্রে স্বীয় স্বার্থ নিহিত থাকা এই স্বেচ্ছাসেবীদের কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যেও ঢুকে আছে।
ফেসবুকে স্ট্যাটাসে প্রকাশিত চিন্তাই যদি গ্রেপ্তার করবার মত যথেষ্ট বড় অপরাধ হয়, তাহলে রিমান্ডে নিয়ে কী করা হবে? মাইদুলের মগজের ফরেনসিক টেস্ট হবে? তাঁর মাথায় আর কী কী চিন্তাপরাধ আছে, সেটা কোন ‘যন্তর-মন্তর’ ঘরে নিয়ে পরীক্ষা করা হবে? শেষমেশ কি কোনো মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রে মগজধোলাই হবে? মাইদুলের মগজের বিরুদ্ধেও কি রায় হবে? রায় দিয়ে কি চিন্তা থামানো যাবে? চিন্তার ফৌজদারি করে কারও মর্যাদা রক্ষা করা যাবে? শাসন কিংবা শাসানি দিয়ে কোথাও কখনো কারও সম্মান কি রক্ষা করা গেছে? আইন কিংবা শাস্তি দিয়ে কারও মর্যাদা রক্ষার দরকার যখন পড়ে, তখন আসলে তাঁর মর্যাদার কতটুকুই-বা অবশিষ্ট থাকে?
মাইদুল সমাজতত্ত্বের শিক্ষক। নিজে সমাজবিদ্যার ছাত্র বলেই জানি মাইদুলের মাথায় সমাজ-সরকার-রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে শতসহস্র সংশয়ী চিন্তা থাকতে পারে। দলীয় মতাদর্শ কিংবা তৎপ্রসূত মাখনের ভাগে আগ্রহ না থাকলে যেকোনো নিষ্ঠাবান সমাজবিজ্ঞানীর মাথাতেই হাজারো মতামত থাকতে পারে, যেগুলো সরকার কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স বেবার, যাঁকে ছাড়া দুনিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই আধুনিক সমাজবিদ্যা সিলেবাস হয় না কিংবা পড়ানো হয় না, তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র মূলত একটা সন্ত্রাসী সংস্থা যার বৈধ সন্ত্রাসের একচেটিয়া কারবার আছে। সরকারের নজরদারি, খবরদারি, দখলদারি নিয়ে গবেষণা দুনিয়ার সব দেশেই চর্চিত সমাজবিদ্যা কিংবা মানববিদ্যার অংশ। কোনো চিন্তা, মতামত কিংবা বিশ্লেষণ কোনো সরকারের বিরুদ্ধে গেলেই যদি অপরাধ হয়ে যায়, তাহলে তো সমাজবিদ্যা কিংবা মানববিদ্যা মাত্রই অপরাধী বিজ্ঞান। সরকারের সমালোচনা অপরাধ হলে তো সমাজবিদ্যার বইপত্র মাত্রই ‘অপরাধমূলক চিন্তা’! বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া মাত্রই চিন্তাপরাধ (থট ক্রাইম)। ভিন্নমত অপরাধ হলে তো সমাজবিদ্যার নিষ্ঠাবান পড়ুয়া মাস্টার মানেই চিন্তাপরাধের মাস্টার মাইন্ড!
কী অদ্ভুত! যে শব্দবন্ধগুলো দিয়ে ১৯৪৯ সালে অরওয়েল ‘১৯৮৪’ সালের এক কল্পিত রাষ্ট্র, কথিত আছে স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন মাথায় রেখে, স্বৈরতন্ত্রের জাঁতায় মানুষের মগজ পিষে ফেলার বীভৎস বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে ভাষাতেই আজকের পরিস্থিতি পরিষ্কার বর্ণনা করা যাচ্ছে!
‘থট পুলিশ’, ‘থট ক্রাইম’, ‘ক্রাইম থিঙ্ক’ যখন আইনি বলপ্রয়োগের যুক্তি হয়ে মানুষের চিন্তাকে শাসাচ্ছে তখন আমাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে, ‘মনে অপরাধ না থাকলে’ ভয়ের কিছু নেই। মনে মনেই যদি অপরাধ করা যায় এবং সেই সম্ভাব্য অপরাধের জন্য যদি আইন বানানো যায়, এসব আইন যাঁরা বানান, সেই শাসকদের মন কিংবা চিন্তাভঙ্গী নিয়ে ভয় তো আর ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
তাহলে কি মাস্টারিটা নামমাত্র করে, মাস্টারের মর্যাদাবোধকে মুক্তচিন্তার কাজে না লাগিয়ে মোসাহেবির লেবাস না বানালে যে-কেউ এখন যেকোনো সময় জেলে যেতে পারেন? মাস্টারদের মগজে যেভাবে কারফিউ জারি করা হচ্ছে, অধিকাংশ মাস্টার যেভাবে সেটা হামাগুড়ি দিয়ে মেনে চলছেন, সর্বোচ্চ সতর্কতায় তা পালন করছেন কিংবা আরও একধাপ এগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত দমানোর পেয়াদা বনে যাচ্ছেন, তাতে মাইদুলের মতন হাতে গোনা কয়েকজন মাস্টারকে আর জেলে নিয়ে কাজ কী? বিশ্ববিদ্যালয়কে তো সরকারসেবী সংখ্যাগুরু শিক্ষকেরা চিন্তার কারাগার বানিয়েই ফেলেছেন। কিছু আন্তর্জাতিক বদনাম ছাড়া তো মাস্টারদের রিমান্ডে পাঠানোয় আমি সরকারের আর কোনো লাভ দেখি না।
আর যদি এটা মাইদুলের মতন কামাই কিংবা কামিয়াবির কমনসেন্সের বাইরে থাকাদের ভয় দেখানোর জন্য হয়, তাহলেও বেশি বাড়াবাড়িই হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা করার ক্ষমতা কিংবা সাধারণকে সরকারবিরোধী শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা এই গুটি কয়েক মাস্টারের নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পাবলিকের কোনো মাথাব্যথা না থাকলে এই মাস্টারদেরও বড় কোনো জানবাজির দায় নেই। বড়জোর ওনারা পাবলিকের দেওয়া বেতনের দায় মেটাতে মাস্টারিটা নিষ্ঠার সঙ্গে করার চেষ্টা করতে পারেন। কপালের ফেরে বিজনেস কিংবা ন্যাচারাল সায়েন্সের মাস্টার না হয়ে আর্টস কিংবা সোশ্যাল সায়েন্সের মাস্টার হলে স্রেফ সৎ মাস্টারির দায়েই মাঝেমধ্যে মামলা-মোকদ্দমা-রিমান্ড-জেল কিংবা ফৌজদারি মারধরের শিকার হতে পারেন।
কী আর করা! মাস্টারি, মগজ আর মতামত আলাদা আলাদা পাত্রে রেখে, চিন্তাভাবনা সন্তর্পণে ঢেকেঢুকে চলতে না পারলে ঝামেলা কিছু তো পোহাতেই হবে এই রাষ্ট্রীয় আবহে।
- বখতিয়ার আহমেদ: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
- * এই লেখা প্রকাশের সময় উচ্চ আদালত মাইদুল ইসলামের জামিন মঞ্জুর করে। এর আগে নিম্ন আদালত তাঁকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠায়। কীভাবে কোন আইনী প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্ত হন, তা এখন দেখার অপেক্ষা।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১০ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment