Search

Sunday, October 7, 2018

অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করছে বিপুল সঞ্চয়পত্র

হাছান আদনান

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাবদ সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি। ছয় বছর আগেও এ বাবদ ঋণ ছিল মাত্র ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অংকের এ সঞ্চয়পত্র বিক্রির কারণে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বিনিয়োগ মন্দায় ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজারও। উচ্চসুদের এ বিপুল সঞ্চয়পত্র সরকারের ব্যয়ও বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা অদূরভবিষ্যতে অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংকঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার। মূলত জনগণকে সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করা, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, নারী, প্রবাসী বাংলাদেশী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার জন্যই সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার। যদিও বাংলাদেশে সরকারের ঘাটতি অর্থায়নের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে এ সঞ্চয়পত্র।

জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে সরকারের ঋণ ছিল ৬৩ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে নিট ৪৭৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এরপর ২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৭৭২ কোটি টাকার। এর পর থেকেই লাগামহীন গতিতে বেড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে ১১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ওই অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।

২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারের ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ২৮ হাজার ৭৩২ কোটি টাকার। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। গত অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে আরো ৫ হাজার ৩৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার। সব মিলিয়ে জুলাই শেষে সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারের ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।


সঞ্চয়পত্রে সুদহার না কমালে এর বিক্রি বাড়তেই থাকবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তাই সুদহার কমিয়ে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি সীমিত করার পক্ষে মত দেন তিনি। ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের কারণে সরকারের ঋণের ভার বাড়ছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ঋণের ভার সরকার তিন-চার গুণ বেশি বড় করে ফেলেছে। উচ্চহারের সুদে এটি বড় করা হচ্ছে। এর দায়ভার আগামীতে জনগণকেই নিতে হবে। সঞ্চয়পত্রের কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকে টাকা না গিয়ে সঞ্চয়পত্রে চলে যাচ্ছে। পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছে। এতে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা চলছে। ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুদহার না কমার পেছনেও সঞ্চয়পত্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে।

বর্তমানে দেশে ১৭ ধরনের সঞ্চয়পত্র ও সরকারি বন্ড বিক্রি করে সরকার। সঞ্চয়পত্রে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের নির্দেশনায় তিন মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে ব্যাংকগুলো। সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদহারে বিশাল ঘাটতি মানুষকে ব্যাংকবিমুখ করে তুলছে। ফলে মানুষ ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সঞ্চয়পত্র কিনছে। সুদহারের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সংখ্যা কমিয়ে এর বিক্রি সীমার মধ্যে রাখার কথা বলছেন ব্যাংকাররা।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকের আমানত সঞ্চয়পত্রে চলে গেছে। এ কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। ব্যাংকের কাছে আমানত না থাকায় বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে। গত কয়েক মাসে ব্যাংকের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক পরিস্থিতিতে চলে গেছে। সরকারের নির্দেশনার কারণেই আমরা ঋণ ও আমানতের সুদহার কমিয়ে এনেছি। আমানতের সুদহার কমার কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্র কিনছে।

সঞ্চয়পত্রের কাঠামো ও সুদহারে সংস্কার প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব না হলে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য হোঁচট খাবে। ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব না হলে দেশের প্রবৃদ্ধিতেও ধাক্কা লাগবে। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ না বাড়িয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ ব্যয় অনেক কমে আসত।

সঞ্চয়পত্রের উচ্চসুদের ধাক্কা সইতে হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারকেও। গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স রেট হিসেবে সঞ্চয়পত্রের উচ্চসুদ বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত রিটার্ন বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কস্ট অব ইকুইটি বেড়ে যাচ্ছে। অনেক বিনিয়োগকারীই পুঁজিবাজারের বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রে লগ্নি করছেন। উদ্যোক্তা শ্রেণীর পাশাপাশি দেশের পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডাররাও তাই দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন।

সঞ্চয়পত্রের সুদহার ও পুঁজিবাজারের সূচকের ঐতিহাসিক সম্পর্ক তুলে ধরে তারা বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদ কমায় ২০০৬-০৭ সালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগপ্রবাহ অনেক বেড়েছিল। সঞ্চয়পত্রের সুদহার বৃদ্ধির পর তা আবার কমতে থাকে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করা ও উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারী সব মহলের কাছে এর আকর্ষণ বাড়াতে বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্টরা যেসব পরামর্শ তুলে ধরছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো তার মধ্যে অন্যতম।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বণিক বার্তাকে বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহারের সঙ্গে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি থাকলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবে না। তাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সঞ্চয়পত্রের সুদহার সামঞ্জস্যপূর্ণ করা প্রয়োজন।

সঞ্চয়পত্রের ওপর সরকারের অতিরিক্ত নির্ভরতাকে দেশের অর্থনীতির জন্য সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ও সমস্যা নিয়ে প্রকাশিত চলতি বছরের জুন সংখ্যার প্রতিবেদনে এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সংস্থাটি। সংকট সমাধানে পাকিস্তানের উদাহরণ তুলে ধরে সংস্থাটি বলেছে, পাকিস্তানে চলতি শতকের শুরুর দিকেও ৩০ ধরনের বেশি সঞ্চয়পত্র ছিল। উচ্চ রিটার্নের জন্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি সব পক্ষই সেখানে বিনিয়োগ করছিল। ২০০০ সালে দেশটির সরকার সঞ্চয়পত্র সংস্কারের পদক্ষেপ নেয়। এ সংস্কার সরকারের সুদব্যয় কমানো, আর্থিক বাজার সুশৃঙ্খল করা, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ানোর মতো উদ্দেশ্যগুলো অর্জনে সফল হয়।

বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্রের বাড়তি সুদহার অর্থনীতির জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কিছুটা কমানো হলেও সরকারি বন্ড বা গ্যারান্টি হিসেবে যেকোনো ব্যাংকের এফডিআরের চেয়ে এটি মানুষের কাছে বেশি লোভনীয় হবে। দেশে নির্ভরশীল মানুষের জন্য তেমন কোনো আর্থিক নিরাপত্তা উপকরণ নেই। এ কারণে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত টাকা যখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়, তখন এর লক্ষ্য ব্যাহত হয়। এটি মূলত প্রশাসনিক সমস্যা। সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের শর্তগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। কারা এটি কিনছে, তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করা সম্ভব হলে মানুষ ব্যাংকমুখী হবে।

প্রতি বছর বাজেটে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, তা অর্জিত না হওয়ার কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর জোর দিতে হচ্ছে সরকারকে। বাজেটে রাজস্ব আহরণের বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও কয়েক বছর ধরেই তা আহরণে ব্যর্থ হয়ে সংশোধনের পথে হাঁটতে হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। সর্বশেষ অর্থবছরে মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে সংশোধন করে ২৫ হাজার কোটি টাকা কমানো হলেও অর্থবছর শেষে সে লক্ষ্যও পূরণ করতে পারেনি সংস্থাটি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার মূল লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সাময়িক হিসাবে এনবিআরের রাজস্ব এসেছে ২ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সর্বশেষ অর্থবছর শুধু এনবিআরের ঘাটতি মূল লক্ষ্যমাত্রার ৪১ হাজার কোটি টাকা; এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব যোগ করে ঘাটতি হিসাব করলে যার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও মূল লক্ষ্য থেকে রাজস্ব কম এসেছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরটিতে ২ লাখ ১০৩ কোটি টাকার মূল লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২০ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম রাজস্ব পেয়েছে সংস্থাটি। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক মিলিয়ে এ দুই মাসে ৩৫ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর আহরণ করেছে ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এ দুই মাসে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। পুরো অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় প্রায় ৩২ শতাংশ।

  • কার্টসিঃ বনিক বার্তা/ ০৭ অক্টোবর ২০১৮

No comments:

Post a Comment