সম্পাদকীয়
নির্বাচন কমিশনের সভায় নির্বাচনসংশ্লিষ্ট যেকোনো প্রাসঙ্গিক আলোচনা করা নির্বাচন কমিশনারদের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গত সোমবার নিজের পাঁচ দফা প্রস্তাব নিয়ে কথা বলার সুযোগ না পেয়ে আপত্তি জানিয়ে কমিশনের বৈঠক বর্জন করেন। এ ধরনের ঘটনা নির্দেশ করে যে ইসির বৈঠকে মুক্ত আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
এই ঘটনার একটি আইনি এবং একটি রাজনৈতিক দিক রয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা মঙ্গলবার আশ্বস্ত করেছেন যে মতবিরোধ থাকলেও নির্বাচন করা ‘কঠিন হবে না’। কিন্তু তাঁর এই আশ্বাস ইসির প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াবে, তা মনে করার কারণ নেই। আমরা বিশ্বাস করি যে মাহবুব তালুকদারের পাঁচ দফা প্রস্তাব আলোচনা করলে নির্বাচন কমিশনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না। আলোচনার প্রস্তাব শুনেই তিন কমিশনারের বিরোধিতা ছিল অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণুতার লক্ষণ। কোনো বিষয়ে আলোচনা হওয়ার অর্থ সেটি গ্রহণ করা নয়। ইসিতে সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। কিন্তু ওই তিন কমিশনার এতটুকু ধৈর্য কেন ধরতে পারলেন না, সেটি প্রশ্ন বটে। উপরন্তু নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কমিশনারের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়া এবং টানা দেড় মাস ইসির কোনো বৈঠক না হওয়া ইসির সামর্থ্যহীনতার নির্দেশক।
২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিলেন, ইসি ‘কম্পোজিট বডি’ (সমন্বিত সংস্থা) হিসেবে কাজ করবে। একজন কমিশনার কমিশন দ্বারা দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলে তাঁর পক্ষে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ কিছুই করার সুযোগ নেই। সুতরাং এটা পরিষ্কার ছিল যে আলোচনার বিষয়বস্তু ভোটাভুটিতে দিলে মাহবুব তালুকদার হয়তো তাঁর পাঁচ দফা প্রস্তাবের একটিও অনুমোদন করাতে সক্ষম হতেন না। কিন্তু এখন তাঁকে আলোচনা করতে না দেওয়ায় তাঁর আইনি, সাংবিধানিক এবং মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। এবং বাস্তবতার নিরিখে এর দায়িত্ব প্রধানত সিইসিকেই নিতে হবে।
এটা লক্ষণীয় যে পাঁচটি প্রস্তাবের মধ্যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, ইসির সক্ষমতা বাড়ানো, সংলাপের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা—এই চারটি প্রস্তাবই বহুল আলোচিত এবং এতে নতুনত্ব বলতে কিছু ছিল না। এমনকি জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে, তা ‘আগে থেকেই নির্ধারণ’ করার মতো বিষয়ও একটি রুটিন কাজ হিসেবে গণ্য করা চলে। কারণ, আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে, সেই ঘোষণা সিইসি আগেই স্পষ্ট করেছেন। একটি বৈঠকে কোনো বিষয়ে আলোচনা করলেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয় না।
কেউ অবশ্য যুক্তি দিতে পারেন যে সিইসি এখানে রেফারির ভূমিকা পালন করে থাকতে পারেন। কারণ, অপর তিন কমিশনার চিঠি দিয়ে মাহবুব তালুকদারের বিষয়গুলো আলোচ্যসূচি না করতে সিইসিকে অনুরোধ করেছিলেন। সেদিক থেকে দেখলে সিইসি সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের পক্ষে থেকেছেন। কিন্তু আমরা এই অনুমান নাকচ করতে পারি না যে তিন কমিশনার সিইসির মনোভাব আঁচ করতে পেরেই হয়তো তাঁদের ভিন্নমত লিখিতভাবে অবহিত করেছেন। অন্যদিকে আলোচ্যসূচিতে না থাকলেও মাহবুব তালুকদারকে ইসির সভায় তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ মত প্রকাশ করতে দেওয়া যেত। আর সেটাই স্বাভাবিক ও শোভন হতো। এখানে সিইসিসহ চার কমিশনার পরমতসহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। গত ৩০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের আগের সভায় আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আইন সংশোধনের প্রস্তাবে আপত্তি দিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন মাহবুব তালুকদার। সেখানেও আমরা সিইসিকে নির্বিকারভাবে ইভিএম আমদানির প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকতে দেখেছি।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের যে আস্থার সংকট আছে, তা আরও বাড়িয়ে দেবে।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১৭ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment