সম্পাদকীয়
অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় উচ্চ দামে আমদানি নয়
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতিতে হবে না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাও বলেছিলেন, ‘সবাই চাইলে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট হবে, না চাইলে হবে না।’ রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিষয়টি বাদ দিলেও কারিগরিভাবেও নির্বাচনের আগে ইভিএম চালু করা সম্ভব নয়। তারপরও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ইভিএম কেনা নিয়ে যে কাণ্ড ঘটছে, তা অগ্রহণযোগ্য, এমনকি স্বেচ্ছাচারিতা বললেও কম বলা হয়। সব থেকে বড় কথা, ইভিএম বিতর্কমুক্ত নির্বাচনবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবে বিশ্বে এখনো সাধারণভাবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। অনেক উন্নত দেশ এটি চালু করেও পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং ইভিএম নিতে হলে বেশি হুঁশিয়ার থাকতেই হবে। বিষয়টিকে আমরা কেবল উচ্চমূল্যে আমদানির জায়গা থেকেই উদ্বেগজনক মনে করি না।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) নাটকীয়ভাবে ইভিএম কিনতে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস করে। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ওই প্রকল্পে ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৯২ শতাংশ। আগামী ছয় বছরে তিন পর্যায়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার ঘোষণা দেওয়া হলেও চলতি অর্থবছরেই ১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইসিকে নতুন ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। ইতিমধ্যে চীন ও হংকং থেকে ইভিএমের মূল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আনার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে বিএমটিএফ। তবে আমদানির প্রক্রিয়া ভিন্ন বলে ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ইভিএম আমদানির জন্য এ ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দিতে হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইসির জন্য যে ইভিএম তৈরি করেছিল, তার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২০-২২ হাজার টাকা। বাংলাদেশি টাকায় ভারতের ইভিএমের দাম পড়ে ২১ হাজার ২৫০ টাকা। এর অর্থ প্রতিবেশী ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দামের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দিয়ে চীনা প্রতিষ্ঠান থেকে এগুলো কেনা হচ্ছে। এসবই দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ইভিএমে কন্ট্রোল ইউনিট, ব্যালট ইউনিট ও ডিসপ্লে ইউনিট আছে। এতে ভোটারের নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করতে আঙুলের ছাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিসপ্লেতে ওই ভোটারের ছবিসহ যাবতীয় তথ্য চলে আসবে। ব্যাটারির মাধ্যমে ইভিএম চলবে। কিন্তু যে জিনিসটি নেই, তা হলো ইভিএম তৈরির ক্ষেত্রে কারিগরি কমিটি যে ইভিএমে ভোটার ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) সুবিধা। অথচ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি এটি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। নির্বাচন কমিশন সেটি বাদ দিয়েছে। ফলে এ কথা বলার সুযোগ নেই যে কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইভিএম কেনা হচ্ছে।
আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টও ভিভিপিএটি অন্তর্ভুক্ত করার শর্তে ইভিএম ব্যবহারের নির্দেশ দিলে ভারতীয় ইসি তা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনেছিল। সবচেয়ে মানসম্পন্ন ইভিএম তৈরি এবং তা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের যুক্তি নিশ্চয় গ্রহণযোগ্য। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দামের তুলনা করে তারা দাবি করছে, বাংলাদেশের ইভিএমের দাম তুলনামূলক কম পড়ছে। কিন্তু জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার করা দরকার যে, তুলনার ভিত্তি কী। কারণ প্রযুক্তিগত উপকরণ ও ব্যবহারিক সুবিধার রকমফেরের মানদণ্ডে বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত ইভিএমের মধ্যে কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্যগত ফারাক থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কারিগরি কমিটিকে পাশ কাটিয়ে যে উপায়ে ইভিএম আমদানির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগী হয়েছে, সেটা অনভিপ্রেত।
তাড়াহুড়ো করে উচ্চ দামে ইভিএম কেনার এই বিলাসিতা বন্ধ হোক।
- কার্টসিঃ প্রথম আলো/ ১৭ অক্টোবর ২০১৮
No comments:
Post a Comment