সাইদ শাহীন|
মেয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পা রাখার আগ পর্যন্ত কখনো ঋণ করতে হয়নি নড়াইলের মহিষখোলা গ্রামের সাইফুল ইসলামকে। চার বছর আগে বড় মেয়ে তামসী লাইলা প্রাপ্তিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর পরই ঋণের জালে জড়িয়ে যান তিনি। মাসে মাসে টিউশন ফির টাকা জোগাড় করতে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হয়েছে তাকে। সেই ঋণ পরিশোধে প্রতি মাসে এখন ৮ হাজার টাকার কিস্তি টানতে হচ্ছে সাইফুল ইসলামকে।
ছোট একটি পোলট্রি খামার ছিল দিনাজপুরের রফিকুল ইসলামের। দুই বছর আগে স্ত্রীর ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর সেটি বিক্রি করে দেন তিনি। স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে একটি এনজিও থেকে ঋণও করতে হয় তাকে। সব খুইয়েও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। উল্টো ঋণের জালে জড়িয়েছেন। স্ত্রী-সম্পত্তি হারিয়ে কিস্তি পরিশোধের তাগিদে রফিকুল ইসলাম এখন ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন।
শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যয় সংকুলানে সাইফুল, রফিকুলের মতো অনেকেই এভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। আগে থেকেই যাদের ঋণ আছে, বাড়ছে তাদের ঋণও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬-এর প্রাথমিক তথ্য বলছে, ২০১০ সালে মোট ঋণের মাত্র ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ একজনকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করতে হয়েছিল। ২০১৬ সালে তা উন্নীত হয়েছে ১০ দশমিক ৯৬ শতাংশে। যদিও ঋণ গ্রহণ ও তা ব্যয় হওয়ার কথা মূলত ব্যবসা, কৃষি ও শিল্প খাতে।
প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাতীয়ভাবে ঋণ গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে এ বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৫ শতাংশ। ২০১০ সালে পরিবারপ্রতি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৬২ টাকা। ২০১৬ সালে তা উন্নীত হয়েছে ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকায়। ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশি ভূমিকা রাখছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বৃদ্ধি।
চিকিৎসার ব্যয়ভার সমাজের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসুখ-বিসুখ নিরাময়ে ব্যক্তিগত ব্যয়ের যে হার, সারা বিশ্বের মধ্যেই বাংলাদেশে তা অন্যতম সর্বোচ্চ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের প্রায় ৬৭ শতাংশই বহন করতে হয় ব্যক্তিকে। বিপুল এ স্বাস্থ্য ব্যয় সংকুলানেও অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
মেয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন নীলফামারীর দেবেন সরকার। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের টাকায় ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত মেয়ে বিপাসার (১৪) অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। এর বাইরে প্রতি মাসেই খরচ করতে হচ্ছে ওষুধ-পথ্য বাবদ মোটা অংকের অর্থ। মেয়ের চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে ঋণগ্রস্ত দেবেন সরকারের এখন নিঃস্ব হওয়ার দশা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সীমিত হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের সন্তানরাও এখন উচ্চশিক্ষার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। ভর্তি হওয়ার পর উচ্চব্যয় বহন অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে ঋণ করতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগভেদে স্নাতক প্রোগ্রামের টিউশন ফি ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। প্রতি সেমিস্টারেই টিউশন ফি বাড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
যেসব উৎস থেকে পরিবারগুলো এ ঋণ নিচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম গ্রামীণ ব্যাংক। ২০১৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মোট ঋণের ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ গেছে শিক্ষা খাতে। আর স্বাস্থ্য খাতে দেয়া হয়েছে ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ঋণেরও উল্লেখযোগ্য অংশ যাচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। ২০১৬ সালে ব্র্যাকের ঋণের ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ গেছে শিক্ষায়। স্বাস্থ্যে গেছে ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ডা. মুহাম্মাদ মুসা বণিক বার্তাকে বলেন, বিনিয়োগের বড় দুই খাত হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। সেখানে যদি কোনো ধরনের ঘাটতি থাকে, তাহলে ব্যক্তি খরচ বেড়ে যায়। আর সেটি মেটাতে ব্যক্তিকে অনেক সময় ঋণ গ্রহণ করতে হয়। চাহিদা থাকলে বেসরকারি খাত বিকশিত হয়। গত কয়েক বছর প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোও এতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারিভাবে ততটা চাহিদা মেটাতে পারছি না। আবার স্বাস্থ্য খাতে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান এখন বেশ এগিয়েছে। কিন্তু জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এটি মেটাতে গিয়ে মানুষকে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সেজন্যই স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই এখন দিতে হচ্ছে ব্যক্তি পকেট থেকে, যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক অর্থের চাহিদা মেটাতে যেমন কাজ করছে, তেমনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
আরেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশাও তাদের মোট ঋণের ২ দশমিক ৬২ শতাংশ দিয়েছে শিক্ষায়। স্বাস্থ্যে গেছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। অন্যান্য এনজিওর মোট ঋণের ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ গেছে শিক্ষায় ও ৭ দশমিক ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যে।
আশার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ডালেম চন্দ্র বর্মণ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারিভাবে যে হারে বিনিয়োগ দরকার, সেটি না হওয়ার কারণেই ব্যক্তি খরচ বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে তারা নানা উৎস ব্যবহার করছে। তবে ব্যক্তি খাত সেটিকে বিনিয়োগ হিসেবেই নিচ্ছে। আর চাহিদা মেটাতে ঋণ করেই সেটি পূরণ করছে। সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষিত জনসম্পদ ছাড়া এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো এগিয়ে এসেছে। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, যা স্বল্প মূল্যে মানুষের চাহিদা পূরণ করছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এনজিওর বড় উদ্যোগ রয়েছে। তবে অসংক্রামক বা জটিল রোগের ক্ষেত্রে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারণ করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণেরও বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে এ দুই খাতে। ২০১৬ সালে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া মোট ঋণের ৩ দশমিক ২২ শতাংশ ছিল শিক্ষা ও ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ স্বাস্থ্যে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। কিন্তু সেটিতে যে ঘাটতি রয়েছে, ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলে নিয়োগের সময়ই আমরা তা অনুধাবন করতে পারি। আবার স্বাস্থ্য খাতে এখনো ভালো মানের হাসপাতালের অভাব রয়েছে। মানুষজন তাদের ব্যয় মেটাতে এক খাতের ঋণ অন্য খাতে ব্যয় করছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ালে সাধারণ মানুষের এ দুটি খাতে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না। তখন ঋণগুলোও উৎপাদনমুখী বা মুনাফা বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করা যাবে।
তবে পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ পূরণ করছে মানুষ। বন্ধু কিংবা পরিজন থেকে নেয়া অর্থের ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ শিক্ষায় ও ২২ দশমিক ৮৪ শতাংশ স্বাস্থ্যে ব্যয় করছে তারা। আবার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নেয়া অর্থের ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষায় ও ১৮ দশমিক ২৫ শতাংশ স্বাস্থ্যে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারি বিনিয়োগের যেমন অপ্রতুলতা রয়েছে, তেমনি এ দুই খাতে ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অহেতুক ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, রোগীদের অযথা প্রেসক্রিপশন ও টেস্ট করানোর ফলে ব্যক্তি ব্যয় বাড়ছে। আবার শিক্ষা খাতে বাড়তি কোচিং ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চফির কারণে শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে।
Courtesy: BanikBarta Oct 16, 2018
No comments:
Post a Comment