Search

Thursday, October 4, 2018

বিনিয়োগে গতি বেড়েছে, রেলের গতি বাড়েনি


কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোর অন্যতম রেল। প্রায় অর্ধশত প্রকল্পের মাধ্যমে রেলের উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হচ্ছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। ৫০ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে ব্যয়ও হয়েছে। তার পরও গতি বাড়ছে না রেলের। এখনো ঘণ্টায় গড়ে ৫০ কিলোমিটারের নিচে আছে রেলের গতি। বাংলাদেশে রেলের এ গতি পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের চেয়ে বেশ কম।

বিভিন্ন দেশের রেলওয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পার্শ্ববর্তী ভারতে যাত্রীবাহী ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার। চীনেও হাইস্পিড বাদে যাত্রীবাহী সাধারণ ট্রেনের গড় গতি এখন ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটারের উপরে। অন্যান্য দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ট্রেন চলছে ঘণ্টায় গড়ে ৮০ কিলোমিটারের উপরে। পাকিস্তানে এ গতি ৭৫ ও থাইল্যান্ডে ৭০ কিলোমিটারের বেশি।

বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলের গতি না বাড়ার কারণ হিসেবে সুষম উন্নয়নের অভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সারা বিশ্বে ব্রড গেজ এমনকি স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ প্রধান হলেও বাংলাদেশে এখনো তা মিটার গেজনির্ভর। এর ওপর দীর্ঘদিনের পুরনো লাইন, পুরনো ইঞ্জিনের কারণেও কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না রেল। কোচের কারণেও অনেক সময় সর্বোচ্চ গতিতে চলতে পারছে না ট্রেন।

যদিও রেলওয়ে সূত্র বলছে, গত ৯ বছরে রেলপথে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয়েছে মূলধনি খাতে। চলমান প্রকল্পগুলো শেষ করতে আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে ট্র্যাক নির্মাণের মাধ্যমে নতুন নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলেও পর্যাপ্ত নতুন ইঞ্জিন না থাকায় চাইলেও সর্বোচ্চ গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

রেলের গতির বিষয়টি উঠে আসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায়ও। ২০১৬ সালে রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যানের নথির ভিত্তিতে এইচএম আহসান, এফ রহমান ও টি হায়দার ‘রেল কানেক্টিভিটি ইন বাংলাদেশ: প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখান, রেলের গড় গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের নিচে রয়েছে। এর দুই বছর পর বাংলাদেশ রেলওয়ের নথি পর্যালোচনায়ও প্রায় একই তথ্য পাওয়া যায়।

পূর্বাঞ্চল রেলের সবচেয়ে দ্রুতগতির ট্রেন সোনার বাংলা ও সুবর্ণ এক্সপ্রেস। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব ৩৩০ কিলোমিটার (ট্র্যাক ৩২১ কিলোমিটার হলেও রেলের হিসাবে ৩৩০ কিলোমিটার)। বিরতিহীনভাবে এ পথ পাড়ি দিতে ট্রেন দুটির সময় লাগে সোয়া ৫ ঘণ্টার মতো। অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো মানের ট্রেন দুটির গতিও ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটারের কম। এ পথে চলাচলকারী অন্যান্য ট্রেন বিবেচনায় নিলে রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগে গড়ে প্রায় ৭ ঘণ্টা। এ হিসাবে দেশের প্রধান এ রেলপথেও ট্রেনের গড় গতি এখনো ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের নিচে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ঢাকা থেকে রাজশাহীতে ২৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে গড়ে ৬ ঘণ্টার মতো। অর্থাৎ এ রেলপথেও ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের নিচেই।

রেলের সর্বশেষ প্রকাশিত ওয়ার্কিং টাইমটেবিল অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলে সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার রাখা হয়েছে টঙ্গী-ঢাকা, আখাউড়া-টঙ্গী, ভৈরববাজার-টঙ্গী, চট্টগ্রাম-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-চিনকি আস্তানা, চিনকি আস্তানা-লাকসাম, লাকসাম-কুমিল্লা ও কুমিল্লা-আখাউড়া সেকশনে। এসব সেকশনে কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ ৭২ কিলোমিটার গতিতে মিটার গেজ রেলপথে ট্রেন চালানোর আদেশ থাকলেও পুরনো ইঞ্জিনের কারণে চলছে অনেক কম গতিতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে ট্রেনের গতি। এছাড়া ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৫০-৬৫ কিলোমিটার, টঙ্গী-দেওয়ানগঞ্জ বাজার ৫০-৬৫, আখাউড়া-কুলাউড়া ৬৪, কুলাউড়া-সিলেট ৬৪-৭২, সিলেট-ছাতক বাজার ৪৮, জামালপুর টাউন-সরিষাবাড়ী ৬৫, দেওয়ানগঞ্জ বাজার-বাহাদুরাবাদ ঘাট ৩২, সরিষাবাড়ী-জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ৩২, ভৈরববাজার-ময়মনসিংহ ৫৬-৬৫, শাখা লাইন গৌরীপুর ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ ৩২-৪৮ ও শ্যামগঞ্জ-জারিয়া ঝাঞ্জাইলে রেলের গড় গতি ঘণ্টায় ৩২-৪৮ কিলোমিটার। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য সংগ্রহে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যান্ড রোড-নিউমুরিং-গুপ্তখাল পর্যন্ত গতি ১৬ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম জংশন-সিএসডি সাইডিং পর্যন্ত ১৬, মার্শালিং ইয়ার্ড-স্টেশন ১৬, চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ড-ফৌজদারহাট ৩০-৩২, শাখা লাইন চট্টগ্রাম-ষোলশহর, ষোলশহর-ফতেয়াবাদ ও ফতেয়াবাদ-নাজিরহাট সেকশনে ২৪-৪০, ফতেয়াবাদ-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ ও ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার।

পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় কম হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, পুরনো ট্র্যাক, ইঞ্জিন ও কোচের কারণে রেলওয়ের গতি কম, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে রেলের যেসব প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেগুলোয় ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতির ট্র্যাক বসানো হচ্ছে। মিটার গেজ রেলপথের পরিবর্তে ব্রড গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের সব রেলপথ ব্রড গেজ হয়ে গেলে রেলের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। আশা করছি, কয়েক বছরের মধ্যে রেলের গতি ও সেবায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাবে।

রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা বিশ্বে এখন স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ভারতের ৯০ শতাংশ রেলপথই ব্রড গেজ। অথচ বাংলাদেশের ২ হাজার ৯২৯ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ১ হাজার ৮৪৫ কিলোমিটারই মিটার গেজ। বাকি ১ হাজার ৮৪ কিলোমিটার ব্রড গেজ রেলপথ (৪৩২ কিলোমিটার ডুয়াল গেজ)। অর্থাৎ মোট রেলপথের ৩৭ শতাংশ ব্রড গেজ হলেও ট্রেনের গতিসীমা পার্শ্ববর্তী দেশের অর্ধেক হওয়ায় ট্রেনের পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। যার ফলে লোকসানের মধ্যেই আছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

যদিও ২০০৯ সালের পর রেলকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় সরকার। গঠন করা হয় আলাদা মন্ত্রণালয়। ৪৮টি প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ৫৪ হাজার ২০১ কোটি টাকা ব্যয়ও হয়েছে। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতের ব্যয় ৩৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর উন্নয়ন খাতে প্রায় সমপরিমাণ ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে রেলওয়ের। অবকাঠামো খাতে অত্যধিক ব্যয় সত্ত্বেও শুধু প্রকল্প পরিকল্পনা সুষম না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, রেলের জন্য যেসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, তার সবই অবকাঠামোগত উন্নয়ন। তবে গতি বাড়াতে প্রয়োজন পরিচালনগত উন্নয়ন। বিষয়টির দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। অথচ রেলকে জনপ্রিয় করে তুলতে এটিকে আগে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। তাছাড়া পরিচালনগত উন্নয়নের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয়ও তুলনামূলক কম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, রেলের উন্নয়নে ব্যয় বাড়লেও তা সঠিক পরিকল্পনায় হচ্ছে না। রেলের ইঞ্জিন সংকট এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্র্যাক সংস্কার ও রেলপথ বাড়ানো হলেও দীর্ঘদিনের পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেনের গতি বাড়ানো সম্ভব নয়। এর ওপর পুরনো কোচে অত্যধিক যাত্রী পরিবহন করায় নিরাপত্তার স্বার্থেই গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে হয়। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন, কোচ আমদানির মাধ্যমে পুরো রেল নেটওয়ার্ক ব্রড গেজ বা স্ট্যান্ডার্ড গেজে রূপান্তর করা হলে বাংলাদেশেও ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব।

  • Courtesy: BanikBarta /Oct 04, 2018

No comments:

Post a Comment