- ধানের ভালো ফলনের পরও কৃষকের মুখে হাসি নেই।
- শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা চাল বাজারে।
- বাম্পার ফলনের পরও কৃষকের স্বার্থে আমদানি শুল্ক বহাল হয়নি।
- প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে নেমেছেন।
- কৃষকের ধানের দাম কম হওয়া সত্ত্বেও বিক্রি হচ্ছে না।
সরকারি হিসাবে গত বছরের বন্যায় বড়জোর ১০ লাখ টন চালের উৎপাদন কম হয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরে সব মিলিয়ে ৩৭ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। আমদানির প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও ৪৫ লাখ টন। আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ও ব্যাংকঋণের সুবিধা নিয়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা মূলত ওই চাল আমদানি করছেন।
ওই বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির ফলে বিপদে পড়েছেন দেশের প্রায় এক কোটি বোরো চাষি। গত বছর বন্যা ও ধানে চিটার বিপদ এই বছর ছিল না। তবে উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু আমদানি করা চাল বাজার দখলে রাখায় বোরো চাষিরা হাটে-বাজারে ধান বেচতে করতে পারছেন না। চালকল মালিকেরা ধান না কেনায় দাম গেছে পড়ে, ফলে অনেক জেলায় উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের।
অন্যদিকে গত বছর ফসল মার খেলেও ধানের দাম ছিল বেশি। ফলে এ বছর কৃষক গত বছরের ক্ষতি পোষাতে বেশি বিনিয়োগ করে ও বেশি জমিতে বোরো ধান করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর গত সপ্তাহে প্রকাশিত বিশ্বের ফসলের উৎপাদনবিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এবার এর আগের বছরের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি ধান উৎপাদিত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এক লাখ হেক্টর বেশি জমিতে এবার ধানের চাষ হয়েছে, যা বিশ্বের মোট চালের উৎপাদনকে রেকর্ড পরিমাণে বাড়িয়ে দেবে।
গত বছরের মে মাসের শেষের দিকে প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এবার তা ৬০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় মণপ্রতি ৮৯৬ টাকা। ধানের দাম কম হলেও চাল প্রতি কেজি ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হওয়া এই চালের বেশির ভাগই ভারত থেকে আমদানি করা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বোরো ধান ওঠার এই সময়ে চাল আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনলে ভালো হতো। তিনি বলেন, ‘চালের আমদানি শুল্ক নির্ধারণের ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমাদের কাছে এ ব্যাপারে মতামত চাইলে অবশ্যই আমরা তিন-চার মাসের জন্য আমদানি শুল্ক আরোপ করার পক্ষে মত দেব।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সারা দেশে যেখানে গড়ে মোট দারিদ্র্যের পরিমাণ কমছে, সেখানে দেশের উত্তরাঞ্চলের চার জেলায় দারিদ্র্যের পরিমাণ বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে দেশের অর্থনীতিবিদ ও স্থানীয় কৃষকেরাও মনে করছেন, মূলত ফসলের দাম না পাওয়া ওই দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ বছর ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে ৬৫ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। উপকরণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর প্রতি কেজি ধানে ২ টাকা ও চালে ৫ টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে কৃষকের। গত বছর ফসল মার খাওয়ার পর এ বছর তাঁরা ধানের পেছনে বাড়তি বিনিয়োগ করেছেন। তাঁরা আশায় ছিলেন ভালো ফলন ও দাম পাবেন।
সরকার ৩৮ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন চাল কেনার ঘোষণাও দিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৯২ হাজার টন চাল সরকারি গুদামে ঢুকেছে। আগে থেকে সেখানে ছিল আরও নয় লাখ টন চাল। ফলে মজুত নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু গোলার ধান হাটে বিক্রি করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রায় এক কোটি বোরো চাষি।
দেশে কৃষকের ধানের দাম এত কম হওয়া সত্ত্বেও কেন তা বিক্রি হচ্ছে না—জানতে দেশের কয়েকজন শীর্ষ চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা জানান, চাল কেনার জন্য প্রতিবছর তাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। গত বছর সরকার চালের আমদানি শুল্ক ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে। এর পরপরই চাল ব্যবসায়ীরা আমদানির জন্য বিপুল পরিমাণে ঋণ তুলেছেন। তাই বোরো ধান কাটার এই সময়ে চালকল মালিকেরা প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে তাঁরা ধান কেনা শুরু করেননি।
সাধারণভাবে দেশের চাল আমদানির ব্যবসায় খুলনা, যশোরের নোয়াপাড়া, সাতক্ষীরা ও নওগাঁর কিছু ব্যবসায়ী যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী ১০ থেকে ১২টি শিল্প-ব্যবসায়িক গোষ্ঠী চাল আমদানিতে নামে। এই খাতে তারা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণও নেয়।
এ ব্যাপারে দেশের চালকল মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী প্রথম আলোকে বলেন, চালকল মালিকেরা ধান কেনার জন্য সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। এ বছর এমনিতেই সুদের হার বেড়ে গেছে। আবার এখন ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ পাওয়াও যাচ্ছে না। ফলে অনেক চালকলের কাছে ধান কেনার মতো অর্থ নেই। আর অনেক ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক ভারত থেকে কম দামে চাল এনে বাজারে ছেড়েছেন। অনেকের গুদামে বিপুল পরিমাণ আমদানি হওয়া চাল রয়ে গেছে। এগুলোর প্রভাবে ধানের দাম বাড়ছে না। তবে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তা চালকল মালিকেরা পূরণ করবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ভারতে গত আমন ও বোরোতে অতিরিক্ত উৎপাদন হওয়ায় চালের দাম প্রতি কেজি ৪৫ টাকা থেকে কমে ৩৫ টাকা হয়েছে। ফলে সেখান থেকে চাল আমদানি অস্বাভাবিক বেড়েছে। কিন্তু থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় চালের কেজি এখনো ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় রয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের মে মাসে অস্বাভাবিক বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার পর সরকার যৌক্তিকভাবেই চালের আমদানি শুল্ক ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। কিন্তু আমনে ভালো ফলন হওয়ার পর সরকারের উচিত ছিল বোরোর আগে কৃষক যাতে ভালো দাম পান, সে জন্য শুল্ক আবার বসানো।
চাল আমদানিতে আবার শুল্ক আরোপ না করার কারণ হিসেবে ‘আমদানি লবির’ প্রভাব থাকতে পারে উল্লেখ করে কে এ এস মুর্শিদ বলেন, গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হওয়ার পর এ বছর যদি কৃষক ধানের দাম না পান, তাহলে তা দেশের কৃষি অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
- কার্টেসিঃ প্রথম আলো/ জুন ২,২০১৮
No comments:
Post a Comment