উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি যেন ইতিহাসের অংশ হতে চলেছে। এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মন্ত্রী-সচিবরা উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে সরকারি কেনাকাটায় আগ্রহী নন। এর বদলে সরাসরি কেনাকাটায় আগ্রহী তারা। তাদের যুক্তি, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করলে কাজ দ্রুত হয়। কারণ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ ঠিকভাবে খরচ করতে না পারলে তিরস্কৃত হতে হয়। তবে কাজের মান নিয়ে কিছু বলেন না তারা।
এরই মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সরাসরি কেনাকাটা করে চলেছে। এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), মৎস্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকারি কেনাকাটায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করছে। অর্থাৎ ওপেন টেন্ডারিং মেথড (ওটিএম) বা উন্মুক্ত দরপত্রের বদলে এখন সবাই ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে (ডিপিএম) বা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ঝুঁকছে। অদৃশ্য কারণে ওটিএম পদ্ধতিতে এখন সরকারি কাজের কার্যাদেশ দিতে চান না মন্ত্রী বা সচিবরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনায় প্রকৃত দামের দুই বা তিন গুণ বেশি দেখিয়ে ডিপিএমের মাধ্যমে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হচ্ছে। আর এর মাধ্যমে লুটপাট হচ্ছে সরকারি কোষাগারের টাকা। টাকার ভাগ নিয়ম করে ‘উপর পর্যায়’ পর্যন্তও পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পরিণামে দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তা সাজার বদলে উল্টো নানাভাবে পুরস্কৃত হচ্ছেন। বিদ্যুৎ বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ও মাতারবাড়ি প্রকল্পসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানির স্পেয়ার পার্টস কেনাকাটায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থের অপচয় হচ্ছে। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রপাতি কিনেছে। এ কোম্পানি সিরাজগঞ্জ ও খুলনা অঞ্চলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করেছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কেনা হয়েছে। এছাড়া রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় বালু ভরাটসহ সব কাজ সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও নদীর তীর নির্মাণসহ মন্ত্রণালয়টির বিভিন্ন কাজ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। দরপত্র প্রক্রিয়া করতে দেরি হবে। তাই কাজ দ্রুত করতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অবলম্বন করেন তারা। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের জলাবদ্ধতা নিরসন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পের কাজও এখন ওপেন টেন্ডারে হচ্ছে না। সিলেট অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন বাঁধ নির্মাণের কাজ এখন ওটিএমের বদলে ডিপিএমে হচ্ছে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি নিয়ে প্রকল্প পরিচালকদের যুক্তি, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দিলে ভালো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় না। ডিপিএমের মাধ্যমে সরাসরি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি কেনা যায়। এতে অরিজিনাল পার্টস পাওয়া যায়। মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় দামও কম পড়ে। এ ছাড়া তারা ১৫ বছর ধরে এসব পণ্য সরবরাহ করবে ও বিক্রয়োত্তর সার্ভিস দেবে। ওপেন টেন্ডার করলে ঠিকাদাররা ইন্ডিয়া-দুবাইয়ের খারাপ যন্ত্রপাতি গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। বিক্রয়োত্তর সেবাও সেভাবে পাওয়া যাবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কাজগুলো তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন দফায় সরকারি অর্থের অপচয় হয়। এনিয়ে সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা কিছু বলতে চান না। তবে সব ধরনের ঝামেলা এড়াতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিকে বেছে নিতে চান।
- মানবজমিন / সোমবার, ৫ মার্চ
No comments:
Post a Comment