সম্পাদকীয়
ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযানের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও কৃষকের স্বার্থে এটি চালু রাখার পক্ষে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু গেল কয়েক বছরে কর্তৃপক্ষের সময় ও দাম নির্ধারণে অদূরদর্শিতা ও অপরিপক্বতায় কৃষকরা উৎসাহজনক দাম পাননি। বাজারে চালের দাম বাড়তি থাকলেও ধান বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন ব্যয়ও ওঠাতে পারেননি অধিকাংশ সময়। এবার আমন মৌসুমে তো সরকার চালের দাম কমিয়ে ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছে, যা গেল বছর ছিল ৩৯ টাকা। চাষের ব্যয় বাড়লেও চালের দাম কেন কমিয়ে নির্ধারণ করা হলো, তার যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যাও দাঁড় করাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। সরকার প্রতিবারই এমন সময় ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে, যখন কৃষকের ঘরে এর কোনোটিই থাকে না। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরকার চালের এমন নিম্নদাম নির্ধারণ করেছে, যার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক নেই। বাজারে চালের দাম বাড়ছে, আর সরকার গেল বছরের চেয়ে কম দাম নির্ধারণ করেছে। এতে চাষীরা উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। আর চাষীরা ধানের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হলে ব্যাংকঋণ, মহাজনি ঋণ কিংবা এনজিও থেকে নেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবেন। এর ওপর আবার ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরে জীবন নির্বাহ ব্যয় বেড়ে চলার ফসল বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ কোনোভাবে কৃষককে মানসম্মত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব ও সরকার প্রদত্ত সুবিধাগুলো সময়মতো না দেয়ায় চালের বাজারের ন্যায্যমূল্য কৃষকের কাছে সবসময়ই অধরা থেকেছে। বিপণন জটিলতা ও সরকারের শিথিল ভূমিকা পালনের কারণে বেশির ভাগ সময়ই চালের বাজারের সুবিধাপ্রাপ্ত হন মধ্যস্বত্বভোগী এবং মিল মালিকরা; যা রোধে কৃষকদের অর্থায়ন ও মজুদ সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। চালের বাজারে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার পরও সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং রহস্যজনক। কৃষক ও ভোক্তা দুই পর্যায়ে মূল্য সহায়তা দিয়ে থাইল্যান্ড যদি চালের বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে সে পন্থা অবলম্বন করতে আমাদের বাধাটা কোথায়? এডিবির গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পাশের দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা অতিমাত্রায় মুনাফা অর্জন করছে এবং চালের দামের ৪০ শতাংশই যাচ্ছে তাদের পকেটে।
মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এক্ষেত্রে আবার ছোট ও মাঝারি কৃষকরা বড় কৃষকদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে খরচ হয়, সে অনুযায়ী দাম পান না কৃষকরা। লাভ তো পরের কথা, অনেক সময় উৎপাদন খরচও ওঠে না। তবু বাধ্য হয়ে কৃষিতেই থাকতে হচ্ছে তাদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি মূল্য কমিশন গঠন করা দরকার। মুনাফালোভী মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণও প্রয়োজন। চাল সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতাগুলো মূল্যায়ন করা দরকার। কৃষককে ন্যায্যমূল্য প্রদানের কথা বলে চাল সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা হাস্যকর বটে। ধান-চালের পুরো বাজারটিই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ হওয়া উচিত কৃষকের অনুকূল আর সিন্ডিকেটের প্রতিকূল।
চাল কেনার পরিবর্তে সরকারকে ধান কিনতে হবে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ কিছু দেশ এ নীতিতে সাফল্যও পেয়েছে। থাইল্যান্ডে ধান-চালের দাম নির্ধারণে সরকারের নীতিমালা রয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাজার পর্যবেক্ষণ ও তদারকিসহ কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে চাল উৎপাদনে দেশটি অনেক এগিয়েছে, কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন ফসল উৎপাদন করে। কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও জনবল আমাদের কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা এবং নীতি-পরিকল্পনার পরিবর্তন। গতানুগতিকভাবে চাল সংগ্রহ অভিযানের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিতের পদক্ষেপ ভ্রান্ত বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত। এখন প্রয়োজন যুগোপযোগী পদক্ষেপ, যাতে কৃষক সরাসরি উপকৃত হন এবং সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আশা করি, নতুন সরকার যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিতে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সাফল্য ও ব্যর্থতা পর্যালোচনাপূর্বক যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
- Courtesy: Banikbarta /Jan 15, 2019
No comments:
Post a Comment